বাবা আনুজকার আসল নাম আনা ডি পিসতেনজা, তবে তিনি তার আসল নামের চেয়ে বাবা আনুজকা এই নামেই বেশি পরিচিত। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৩৮ সালে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ায় (বর্তমান আধুনিক সার্বিয়ায়)। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অপেশাদার রসায়নবিদ এবং ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিষ প্রয়োগ করে প্রায় ১৫০ জন মানুষ হত্যা করেছিলেন।
১৯২৮ সালে বাবা আনুজকা তার অপরাধের জন্য গ্রেফতার হয়। ততদিনে তার বয়স হয়ে গেছে ৯০ বছর। তাকে তার অপরাধের জন্য ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু কারাদণ্ডাদেশের ৮ বছরের মাথায় বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মুক্তি পান।
প্রারম্ভিক জীবন এবং বিবাহ
আনুজকার প্রারম্ভিক জীবন সম্পর্কে যেসকল তথ্য পাওয়া গেছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তার ভাষ্যমতে ১৮৩৮ সালে তিনি রোমানিয়ার এক ধনী পশুপালকের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৪৯ সালের দিকে তার পরিবার অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশ ভ্লাদিমিরোভাকে চলে আসেন।
তিনি প্যানচেভোতে একটি বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। আনুজকার যখন ২০ বছর বয়স তখন তিনি একজন তরুণ অস্ট্রিয়ান সামরিক অফিসারের প্রেমে পড়েন। কিন্তু সেই তরুণ তার প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।
প্রেমে প্রত্যাখান হওয়ার পর আনুজকা রসায়ন শাস্ত্রে আগ্রী হয়ে উঠেন তিনি বিভিন্ন লতা পাতার মিশ্রণ দিয়ে ঔষধ ও বিভিন্ন পথ্য তৈরিতে মনযোগ দেন। ভেষজ বিষয়ে জ্ঞান ছাড়াও আনুজকার আরেকটি বিশেষ জ্ঞান ছিলো। তিনি প্রায় ৫ টি ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
আনুজকা পরবর্তীতে পিস্তভ নামে এ ভূস্বামী কে বিয়ে করেছিলেন। তাদের ঘরে ১১ সন্তান হয়েছিলো। কিন্তু মাত্র ১ জন সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। আনুজকা নিজের সন্তানের উপরেও বিষের প্রযোগ করেছিলেন কিনা তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা রয়েছে। বিয়ের ২০ বছরের মাথায় আনুজকার স্বামীর মৃত্যু হয়।
ভেষজবিদ্যার পরীক্ষা-নিরীক্ষা
আনুজকার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি তার বাড়িতে ভেষজ ঔষধ তৈরি করতে একটি পরীক্ষাগার তৈরি করেন। ১৯ শতকের শেষ দিকে তিনি অসুখ নিরাময় কারী ও ভেষজবিদ হিসেবে খুব নাম করেন। তিনি কৃষকদের স্ত্রীদের কাছেও জনপ্রিয় ছিলেন যারা স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য তার সাহায্য চাইতো। ভেষজ ঔষধ বিক্রি করে আনুজকা বেশ মোটা অর্থ আয় করেন।
তবে তার এই ভেষজ ঔষধের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি ভালোর চেয়ে খারাপই করেছেন বেশি। সেসময় যেসকল নারী তাদের স্বামীর সাথে অসুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতেন তারা তাদের স্বামীকে হত্যা করতে আনুজকার কাছ থেকে চড়া দাম দিয়ে একধরনের বিষ কিনতেন, তারা সেটিকে নাম দিতেন ‘ভালোবাসার পানীয়’ এই পানীয় পান করলে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ফিরে আসবে এই বলে সেসব নারী তা তাদের স্বামীকে পান করাতো। পান করানের পর তাদের মৃত্যু শুরু হতো খুব ধীর পক্রিয়ায়, প্রায় ৮ দিন লাগতো মৃত্যু হতে। বুঝারই কোনো উপায় ছিলো না যে তার মৃত্যু বিষ প্রয়োগের ফলে হয়েছে। মানুষজন ভেবে নিতো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আনুজকা তার এই কার্যক্রম শুরু করে ১৯ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে।
১৯২০ এর দশক থেকে আনুজকা লজুবিনা মিলানকভ নামে একজন মহিলাকে নিজের সেলস এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন। যারা কাজ ছিলো ক্লায়েন্ট খুঁজে বের করা যাদের সংসারে অশান্তি চলছে। আনুজকার সেলস এজেন্ট সেসব সংসারের মহিলাদের আনুজকার কাছে নিয়ে আনতো। আনুজকা তার ম্যজিক ওয়াটার মানে ভালোবাসার পানীয় সেসকল মহিলাদের কাছে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার যুগোস্লাভিয়া দিনারে বিক্রি করতেন (আজকের দিনে এই টাকার অঙ্কটা ছিলো প্রায় লক্ষের কাছাকাছি)।
মোমিরভ হত্যাকান্ড
অনুজকা তার ‘ম্যাজিক ওয়াটার’ ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে স্ট্যানা মোমিরভ নামের এক মহিলার কাছে ২৩০০ দিনারে বিক্রি করে। স্ট্যানা তার স্বামী লাজার লুডোস্কিকে মিশ্রণটি খায়িয়েছিলেন এবং তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কয়েকদিন পর মারা যান। স্টানা পরে একই গ্রামের আরেকজনকে বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্বামীর এক ধনী চাচা কয়েক মাসের মধ্যে একই পরিস্থিতিতে মারা যান। পুলিশ স্ট্যানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং সে অনুজকাকে দোষারোপ করে।
আনুজকা পরবর্তীতে ১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সীমা মোমিরভ এবং তার স্ত্রী সোফিজার কাছে তার ‘ম্যাজিক ওয়াটার’ বিক্রি করেন। সেই বিষাক্ত পানীয় দিয়ে সিমা মোমিরভ তার ৭০ বছর বয়সী পিতা নিকোলা কে হত্যা করে। এই হত্যার কারণ ছিল পারিবারিক কলহ। সীমা মোমিরভের ভাস্যমতে নিকোলা প্রচন্ড পরিমানে মদ্যপ থাকতো এবং তার স্ত্রী ও সন্তানের সাথে খারাপ আচরণ করতো।
সীমা মোমিরভ এই বিষ আনুজকা থেকে কিনেছিলেন এক মহিলার কথা শুনে। এই বিষের জন্য তিনি আনুজকা কে ৫,০০০ দিনার দিয়েছিলেন। সীমা মোমিরভের স্ত্রী সোফিজা এই বিষাক্ত পানীয়টি তার ১৬ বছর বয়সী কন্যা ওলগা স্টুরজাকে দিয়ে নিকেলার কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। বুড়ো নিকোলা সেটিকে ওষুধ ভেবে পান করে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৫ দিন পরে মারা যান।
বিচার
হত্যার জন্য বিষ প্রদানের জন্য ১৯১৪ সালের জুন মাসে অনুজকার প্রথম বিচার করা হয়, কিন্তু বিচারে তাকে খালাস করে দেওয়া হয়।
১৯২৮ সালের মে মাসের ১৫ তারিখ আনুজকা কে দ্বিতীয় বারের মতো গ্রেফতার করা হয়; তখন আনুজকার বয়স ৯০!
১৯২৮ সালে আনুজকা ছাড়াও স্ট্যানা, সোফিজা এবং সিমা মোমিরভ, লুবিনা মিলানকভ, ড্যানিকা স্টোজিক এবং ওলগা স্টুরজাকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং নিকোলা মোমিরভ এবং লাজার লুডোস্কির হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
আদালত কর্তৃপক্ষ বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ে ময়নাতদন্তের জন্য নিহতদের মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে।
১৯২৯ সালের জুন মাসে পানচেভোর জেলা আদালতে বিচার শুরু হয়। এবং ১৮ ও ১৯ জুন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
বিচার চলতে থাকে ১ জুলাই যখন অনুজকার বাড়িতে পাওয়া নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়, সেই সময়ে প্রসিকিউটর এবং ডিফেন্স অ্যাটর্নিরা সমাপনী বিবৃতি দিয়েছিলেন। প্রসিকিউটর স্টুরজা ব্যতীত সকল আসামীর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলেন, যিনি হত্যার সময় একজন নাবালিকা ছিলেন এবং যার জন্য তিনি কারাদণ্ড চেয়েছিলেন।
সোফিজা এবং সিমা মোমিরভ বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন। তারা দাবি করেছিল যে তারা জানত না যে ‘ম্যাজিক ওয়াটারে’ বিষ রয়েছে। তারা এটিকে আনুজকার অতিপ্রাকৃত পানীয় মনে করতো।
স্ট্যানা মোমিরভ দাবি করেছিলেন যে তিনি কেবল তার স্বামীকে মদ্যপান থেকে নিরাময় করতে যাদু জল চেয়েছিলেন এবং তিনি জানেন না যে ইহা পান করলে তার স্বামীর মৃত্যু হবে। অনুজকা ক্রমাগত অভিযোগ অস্বীকার করে, তিনি দাবি করে যে তিনি কখনোই কোনো জাদু জল বিক্রি করেনি এবং তার বিরুদ্ধে পুরো মামলাটি লুবিনা মিলানকভ দ্বারা বানোয়াট অভিযোগ ছিল। যিনি অনুজকাকে তার নিজের অপরাধের জন্য দোষ দিতে চেয়েছিলেন। স্টুরজা নিজেকে রক্ষা করেছিলেন, দাবি করেছিলেন যে তিনি একজন নাবালিকা ছিলেন এবং তিনি জানতেন না যে এই পানীয় তার দাদাকে হত্যা করবে; কিন্তু তার মা সোফিজা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে স্টুরজা পুরো ঘটনা সম্পর্কে ভালভাবে অবগত ছিলেন।
ময়নাতদন্তের পর ডাঃ ব্রাঙ্কো ভুর্দেলজা আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে উভয় শিকারের দেহেই আর্সেনিকের চিহ্ন পাওয়া গেছে। হত্যার রায় ১৯২৯ সালের ৬ জুলাই দেয়া হয়েছিল। উভয় হত্যাকাণ্ডে সহযোগী ভূমিকার জন্য অনুজকাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। প্রধান অপরাধী হিসেবে স্ট্যানা এবং সোফিজা মোমিরভকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সিমা মোমিরভকে ১৫ বছর এবং লুবিনা মিলানকভকে ৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ওলগা স্টুরজা এবং ড্যানিকা স্টোজিচ বেকসুর খালাস পেয়েছিল।
বার্ধক্যজনিত কারণে আট বছর কারাভোগের পর ৯৮ বছর বয়সে মুক্তি পান অনুজকা। তিনি মুক্তির ২ বছর পরে মারা যান তখন তার বয়স হয়েছিলো ১০০ বছর!