গত শতাব্দীতে মানুষ যখন বিদ্যুৎ কে রহস্য মনে করে ভয় পেতো, তিনি তখন বিদ্যুৎ কে নিয়ন্ত্রণ করেছেন হাতের তালুতে রেখে।
পৃথিবীতে তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন সহজলভ্য বিদ্যুৎশক্তির যুগ, যাঁর উদ্ভাবিত এসি জেনারেটর ও মোটরের শক্তি দিয়ে শুরু হয় ব্যাপক শিল্পোৎপাদন। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছে রোবট ও অটোমেশনের যুগ, যা মানুষের কায়িক শ্রম হ্রাস করে যন্ত্রকে মানুষের দাসে পরিণত করেছে।
আজ কথা বলবো বিদ্যুৎ মানবের এমন কিছু প্রকল্প নিয়ে যা তিনি অর্থের অভাব ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারনে বাস্তবায়ন করতে পারেন নি।
ভূমিকম্প যন্ত্র
১৮৯৩ সালে টেসলা একটি বাষ্প-চালিত যান্ত্রিক অসিলেটর পেটেন্ট করেছিলেন, যা বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে উচ্চ গতিতে উপরে এবং নীচে কম্পন সৃষ্টি করবে।
তার আবিষ্কারের পেটেন্ট করার কয়েক বছর পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে একদিন তার নিউ ইয়র্ক সিটির গবেষণাগারে থাকা বিল্ডিংয়ের কম্পনের সাথে তার যান্ত্রিক অসিলেটরটি মধ্যে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করার সময় তিনি ভূমি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
পরীক্ষার সময় তিনি দেখতে পান তার আশেপাশের জিনিসপত্র নড়তে শুরু করে দিয়েছে। আশেপাশের বিল্ডিং গুলোতেও ভূকম্পন অনুভূত হয়।
ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার সাথে সাথেই সেখানে পুলিশ, এম্বুলেন্স ও মানুষের হট্টগোল লেগে যায়। টেসলা তার সহকারীদের চুপ থাকতে বলেছিল এবং পুলিশকে বলেছিল যে এটি অবশ্যই একটি ভূমিকম্প ছিল।
টেসলা পরবর্তীতে এই যন্ত্রটি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেন। বড় পরিসরে এই যন্ত্র ব্যবহার করে পুরো পৃথিবীতেই ভূমিকম্প সৃষ্টি করা সম্ভব হতো। কিন্তু এই আবিষ্কারে কেবল ধ্বংসই হতো। মানব জাতির ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি নিজের আবিষ্কার নিজেই ধ্বংস করেছেন।
চিন্তা রেকডিং করা ক্যামেরা
১৮৯৩ সালে নিজের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানিরীক্ষা করার সময় ‘থট ক্যামেরা’-র তৈরির কথা ভেবেছিলেন টেসলা। যদিও তার দীর্ঘকাল পরে এ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেন তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে টেসলা বলেন, ‘‘আমি নিশ্চিত যে আমাদের চিন্তা-ভাবনার ছবি চোখের মণিতে ফুটে ওঠে।’’ তর্কের খাতিরে টেসলার কথায় বিশ্বাস করা গেল। তবে সে ছবি কী ভাবে ক্যামেরাবন্দি করা যাবে? সে উত্তরও দিয়েছেন টেসলা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিবর্ত ক্রিয়ার দ্বারাই আমাদের চিন্তা-ভাবনার ছবি মণিতে দেখা যায়। যথাযথ যন্ত্রের সাহায্য সেই ছবি দেখা সম্ভব।
কী সেই যন্ত্র? এখানেই ‘থট ক্যামেরা’র প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন টেসলা। তিনি জানিয়েছেন, চোখের মণিতে ভেসে ওঠা মনের ভাবনার প্রতিচ্ছবি একটি কৃত্রিম অক্ষিপটে (রেটিনায়) ফেলে তার ছবি তোলা যায়। এবং সেই ছবি কোনও পর্দায় ভাসিয়ে দিলে ওই মানুষটির মনের কথা জেনে ফেলা সম্ভব।‘থট ক্যামেরা’ প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে টেসলা বলেছেন, ‘‘যদি মনের ছবি এ ভাবে পর্দায় ভাসিয়ে তোলা যায়, তবে ওই মানুষটি কী চিন্তা-ভাবনা করছেন তা সহজেই জেনে ফেলা যাবে।’’
অনেকের দাবি, ১৮৯৩ সালে নয়, গত শতকের তিরিশের দশকে ‘থট ক্যামেরা’-র কথা ভেবেছিলেন টেসলা। ওই ক্যামেরার সাহায্যে মানবমনের চিন্তা-ভাবনার ছবিও স্লাইডশোয়ের মতো দেখা যাবে। সাল-তারিখ নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। তবে টেসলার এই উদ্ভাবনী চিন্তা যে অভূতপূর্ব, তা নিয়ে দ্বিমত ছিল না। টেসলার কথায়, ‘‘এ ধরনের ক্যামেরার সাহায্যে প্রতিটি মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলা যাবে। এবং তা করা গেলে আমাদের মন আক্ষরিক অর্থেই খোলা বইয়ের আকার নেবে। যা সকলেই পড়তে পারবেন।’’ যদিও টেসলার এই ভাবনা সাফল্য পায়নি।
তারবিহীন বিদ্যুৎ
১৯০১ সালে টেসলা টেসলা লং আইল্যান্ডের উত্তর তীরে একটি ১৮৫ ফুট লম্বা, মাশরুম আকৃতির টাওয়ার নির্মাণের জন্য আমেরিকান অর্থলগ্নিকারী জেপি মরগানের থেকে ১,৫০,০০০ মার্কিন ডলার নেন। তার লক্ষ ছিলো বাতাসের মাধ্যমে পুরো শহরে বিদ্যুৎ সেবা দেওয়া। কিন্তু এই টাওয়ারের অর্ধেক কাজ চলার সময় মর্গান অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেন। কারণ ছিলো সেসময় যারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরবরাহ করতো তারা প্রচুর দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে জনগণের কাছ থেকে বিশাল মুনাফা আয় করতো।
টেসলার এই প্রজেক্ট সফল হলে তাদের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যেতো। ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে তারা টেসলার অর্থের যোগান বন্ধ করে দেন, যেনো সে সফল হতে না পারে।
১৯০৬ সালে টেসলা এই প্রজেক্টে হাত দিয়েছিলেন আর বেশকিছুদিন পরই তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৭ সালে টেসলার তারবিহীন বিদ্যুৎ এর ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার ভেঙে দেওয়া হয়।
কৃত্রিম জোয়ার ঢেউ
নিকোলা টেসলা বিশ্বাস করতেন যে যুদ্ধ প্রতিরোধে বিজ্ঞানের শক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
১৯০৭ সালে নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড টেসলার আরেকটি সামরিক উদ্ভাবনের বিষয়ে তথ্য দেয়, সেখানে বলা হয় ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি সমুদ্রে উচ্চ বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে যাতে এত বিশাল জোয়ারের তরঙ্গ তৈরি হয় যে তা শত্রুর সমস্ত নৌবহরকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।
সংবাদপত্রটি আরো জানিয়েছে যে কৃত্রিম জলোচ্ছ্বাস নৌবাহিনীকে কাগজের নৌকার মতো অকেজো করে তুলতে পারার সক্ষমতা থাকবে। অনেকটা শিশুদের বাথটব বা পুকুরে কাগজের নৌকোর মতো।
দুর্ভাগ্যক্রমে সে সময় মার্কিন নৌবাহিনীর গবেষণা প্রধান ছিলেন টমাস আলভা এডিসন। তিনি ‘এটি কোনো কাজে লাগবে না’ বলে নাকচ করে দেন। ১৯৩০-এর দশকে এমিলি গিয়ারডিউ একই নীতিতে রাডার (জঅউঅজ) উদ্ভাবন করেন।
বৈদ্যুতিক চালিত সুপারসনিক এয়ারশিপ
নিকোলা টেসলা চিন্তা-ভাবনায় তার সময়ের থেকে কয়েক দশক এগিয়ে ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান সময়ে আমাদের প্রজন্ম তাদের ট্যাবলেট এবং স্মার্টফোনগুলো ওয়্যারলেস টেকনোলজিতে চার্জ দিতে পেরে ভাবছে এটি একটি প্রযুক্তির যুগান্তকারী ব্যবহার; কিন্তু, সেই ১৯১৯ সালে টেসলায় মাথায় খেলা করেছিল কিভাবে এমন একটি সুপারসনিক বিমান বানানো যেগুলোকে বিনা তারের বৈদ্যুতিক চার্জ দেয়া যেতে পারে।
মোবাইলের টাওয়ারের মাধ্যমে রেডিও সিগন্যাল ব্রডকাস্টের ধাঁচে বিদ্যুৎকেও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ঐ বিমানগুলোকে চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা – এটাই ছিল নিকোলা টেসলার পরিকল্পনা।
বিমানগুলো ভূপৃষ্ট হতে ৪০,০০০ হাজার ফুট উপরে ঘণ্টায় ১,০০০ মাইল বেগে চলার উপযোগী করে তৈরী করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল – এই গতিতে ছুটে নিউইয়র্ক থেকে রওয়ানা দিয়ে লন্ডন পৌঁছাতে সময় লাগত ৪ ঘণ্টারও কম।
দ্য ডেথ রে (মৃত্যুর রশ্মি)
টেসলার সৃজনশীল মন তার জীবনের শেষের দিকে নতুন এক ভাবনা জাগিয়েছিল। তিনি তার ৭৮ তম জন্মদিনে, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটি নিয়ে এসেছেন। যা “লক্ষ লক্ষ সৈন্যদলকে তাদের ট্র্যাকে মারা যেতে পারে।
আবিষ্কারটি? একটি সামরিক অস্ত্র যা একটি ভ্যাকুয়াম চেম্বারের অভ্যন্তরে শব্দের 48 গুণ গতিতে পারদ কণাকে ত্বরান্বিত করবে এবং একটি উচ্চ-বেগের রশ্মিকে “মুক্ত বাতাসের মধ্য দিয়ে গুলি করবে, এমন প্রচণ্ড শক্তিতে যে এটি মুহূর্তে ১০,০০০ শত্রু বিমানের বহরকে নিমেষে শেষ করে দেবে।
প্রেস মিডিয়া তাদের সংবাদপত্রে এটিকে “মৃত্যুর রশ্মি” বলে অভিহিত করেছেিল। কিন্তু টেসলা এই রশ্মির নাম দিয়েছিলেন “শান্তির রশ্মি” বা Peace Ray।
পৃথিবী যদি গোল না হয়ে সমতল হত, তবে এই রশ্মি সক্ষমতা ছিল পৃথিবীর পরিধি ভেদ করে যেতে পারত সুদূরে; আর এর সামনে যা পড়ত, সবই ধূলিসাৎ হয়ে যেত।
তার এই নতুন আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তিনি অনেকের দারস্ত হয়েছিলেন; এমনকি তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন এক গবেষণাগারে ১৯৩৯ সালে এটির পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। কিন্তু, বিধি বাম! তার এই আইডিয়াকে তিনি সফলতার মুখ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।