১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের নবনির্মিত শহর কলকাতা আক্রমণ করলেন। সিরাজের আক্রমণে ইংরেজদের নবনগরী ভেঙে গেলো খান খান হয়ে। খড়ের মতো এক ঝটকায় উড়ে গেলো দূলুর্গ। ইংরেজ কেপ্টেন ড্রেকের নেতৃত্বে প্রাণ রক্ষার জন্য ইংরেজ নর-নারীরা আশ্রয় নিলো ফলতায়।
কলকাতা হয়ে গেলো নবাবের আলীনগর, আর ফলতা হলো ইংরেজদের রিফিউজি ক্যাম্প। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আদেশে রিফিউজি ক্যাম্পের খাবার সরবরাহ ও বন্ধ হয়ে গেলো। ফলতার এর দিকে কেউ পথ ও মারাতো না তখন, অনাহারে, ক্ষুধায় ইংরেজ সাহেবদের তখন বেহাল দশা, ক্রমে ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা।
ইংরেজদের কোনো বন্ধু নেই, কেউ একটু খাবার দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না। রাত্রির অন্ধকারে চুপিচুপি একজন এগিয়ে গেলো কলকাতা থেকে ইংরেজদের ফলতার রিফিউজি ক্যাম্পে। টোকা দিলো ইংরেজের দরজায়, খাবার দিয়ে বললো এই খাবার। খাবার পেয়ে অপরিচিত এই বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো তারা।
খাবার পেয়ে দুর্দিনে ত্রাতা হয়ে আসা বন্ধু কে ইংরেজ জ্ঞিসেল করলো, তুমি কে?
অজ্ঞাত সেই ব্যক্তি প্রতিত্তোরে বললো, আমার নাম পেট্রাস আরাটন। কলকাতার একজন আরমেনিয় ব্যবসায়ী। পেট্রাসের নাম গোপনে সবার কাছে রটে গেলো। পেট্রাস গোপনে পরামর্শ করলেন উমিচাঁদের কাছে। চিঠি লিখে যোগাযোগ করলেন মানিক চাঁদের সাথে। যোগাযোগ হয়েছিল জগৎ শেঠের মতো নবাব সিরাজউদ্দৌলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে। রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়াটসন কলকাতা এসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত এই আর্মেনিয় ব্যবসায়ী আরব্য উপন্যাসের নায়কের মতোই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ফলতারের ইংরেজ রিফিউজিদের।
এই কাজ করতে গিয়ে পেট্রোসের জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল বৈকি, কিন্তু তার প্রতিদান তিনি পাননি, না বেঁচে থাকতে তিনি ইংরেজদের থেকে সম্মান ও অর্থ পেয়েছিল না মরে যাওয়ার পর ইংরেজদের ইতিহাসের পাতায় কৃতজ্ঞতা। পেট্রোসের এই অসামান্য উপকার শোধবার নয়, কিন্তু ইংরেজরা তা চেষ্টা ও করে দেখেন নি।
ক্লাইড ও ওয়াটসন কলকাতা এসে কলকাতা আবার পুনরুদ্ধার করলেন, কিন্তু পেট্রাসের ছুটি হলো না। ক্লাইভ তাকে রেখে দিলেন অন্তরঙ্গ মৃত্যু হিসেবে। পেট্রাসের মাধ্যমে ক্লাইভের গোপনে মিরজাফরের সঙ্গে শলা পরামর্শ শুরু হল, সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতা থেকে হটানোর।
পেট্রাস হলেন ক্লাইভের গুপ্তচর। এই ষড়যন্ত্রের পরিণতি সকলের জানা। তারপর যখন ইংরেজদের দরকার হল মিরজাফরকে সরাবার, পেট্রাস তখনও বন্ধু। অবশেষে মিরকাশেমকে ঘায়েল করার ব্যাপারেও নিযুক্ত হলেন পেট্রাস। তা ও সম্পন্ন হল। সমাধা হল বঙ্গে ‘ বিপ্লব ‘।
ব্যস , এখানে এসেই শেষ হয়ে গেল পেট্রাসের খাতির। এবার শুরু হল পেট্রাসকে নিয়ে দরবার। দু’চারজন ছাড়া সকলেই একবাক্যে রায় দিয়ে বসলেন — লোকটি কখনও ইংরেজের মিত্র নয় , আসলে নবাবের গুপ্তচর। ওকে ফাঁসি দেওয়া হোক, কয়েদ করা হোক, তাড়িয়ে দেওয়া হোক , ইত্যাদি ইত্যাদি।
অতি দুঃখে পেট্রাস চিঠি লিখলেন কোম্পানির ইংলন্ডস্থ কর্তৃপক্ষের কাছে। দীর্ঘ চিঠি। কোম্পানির জন্য তিনি শুরু থেকে কী কী করেছেন, এবং এজন্য কত বিপদের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে তা বিস্তারিত লিখে তিনি।
উপসংহারে লিখলেনঃ-
যদিও আপনাদের চরমতম বিপর্যয়ের মুহূর্তে আমি নিজের জীবন বিপন্ন করে এমনভাবে দেশদেশান্তরে ছুটে বেড়িয়েছি, এবং যদিও বলতে গেলে বর্তমানের এই সুখকর পরিণতির জন্য আমিই প্রধানত দায়ী, তবুও আমার এমনই কপাল যে আপনারা একবার উল্লেখও করলেন না এই হতভাগার কথা!
এ চিঠির উত্তর আজও মেলেনি। এবং এ চিঠিখানাও নেই কোনও ইংরেজের ইতিহাসে। এটি সেই আরমানি গবেষকই বহু কষ্টে আবিষ্কার করেছিলেন!
তথ্যসূত্রঃ কলকাতা,শ্রীপান্থ
অনেক কিছু জানলাম। লেখককে ধন্যবাদ