নার্সিসিস্ট শব্দটি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। যারা নিজেদের অধিক ভালোবাসেন বা আত্মপ্রেমিক তাদের নার্সিসিস্ট বলে। সকল নামের পেছনে যেমন কোন উৎস বা ঘটনা থাকে ঠিক তেমনি এই নামের পেছনেও রয়েছে তেমনই একটি ঘটনা।
নার্সিসিস্ট শব্দটি এসেছে গ্রিক মিথলজির উল্লেখযোগ্য চরিত্র নার্সিসাস থেকে। এই নার্সিসাস নিজের শারীরিক রূপ ও সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে তার এই অধিক পরিমাণ আত্মপ্রেম নিজের অন্তিম সমাপ্তি ডেকে এনেছিল।
নার্সিসাসের জন্ম হয়েছিল গ্রীক মিথলজির নদীর দেবতা সেফিসাসের ঘরে। নার্সিসাস এতটাই সুন্দর ছিল যে তার মায়ের মনে হল যে তার এই পুত্র সন্তান তার অন্য সন্তানদের চেয়ে অধিক সুন্দর। কোন মানুষের মধ্যে তিনি এর আগে এত সৌন্দর্য দেখেননি। আর তাই নিজের শিশুসন্তান নার্সিসাসের ভবিষ্যৎ জানতে অন্ধ ভবিষ্যৎ বক্তা টাইরেসিয়াসের শরণাপন্ন হলেন।
নার্সিসাসের মা টাইরেসিয়াস এর কাছে জানতে চাইলে, কি আছে আমার এই সন্তানের ভাগ্যে?
কতদিন সে বাঁচবে?
অন্ধ টাইরেসিয়ায় প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “যতদিন সে নিজেকে চিনতে না পারবে।”
নার্সিসাসের মা অন্ধ টাইরেসিয়াসের উত্তর ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।
টাইরেসিয়াস প্রতিত্তোরে বললেন, “সময় হলে ঠিক বুঝতে পারবে।”
নার্সিসাস এতোটাই সুন্দর ছিলো যে কোনো মানবের মধ্যে এতোটা সৌন্দর্য্য দেখা যায় না। মেয়েরা তার দিকে একবার তাকালেই তার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যায়। আর ছেলেরা তার এতো সৌন্দর্য্য দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতো।
চারপাশে নিজের সৌন্দর্যের এতো প্রশংসা শুনতে শুনতে প্রচন্ড অহংকারী হয়ে উঠলেন নারসিসাস। তার মধ্যে এতোটাই অহংকার জন্ম নিলো, যে কোনো নারীকেই নিজের জন্য তার যথেষ্ট সুন্দর মনে হতো না। নিজের সমপর্যায়ে কাউকে ভাবতে পারতেন না।
তার এই অতিরিক্ত আত্মঅহংকারের জন্য নার্সিসাসের কোনো সঙ্গী ছিলো না। যেহেতু নার্সিসাস একজন অসাধারণ শিকারি ছিলেন, তাই তিনি কোনো সঙ্গী ছাড়াই শিকারে যেতেন।
তেমনই একদিন নার্সিসাস একা একা শিকার করতে বনে গিয়েছিলেন। সেই বনে ছিলো ‘বনপরী’ বনপরীর নাম ‘একো’ যার অর্থ ‘প্রতিধ্বনি’।
একো নিজ থেকে কোনো কথা বলতে পারতো না। শুধু কেউ জিজ্ঞেস করলে সেই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দিতে পারতো। একে এর আগে প্রচুর কথাবলতো। তার এই অধিক বাচালতায় দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে অভিশাপ দিলেন, যে একো আর নিজ থেকে কথা বলতে পারবে না। যদি কেউ তার সাথে কথা বলতে আসে তাহলে সে কেবল তাদের প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেবে।
নার্সিসাস যখন বমের মধ্যে একা একা হাঁটছিলেন, একে নার্সিসাস কে তখন ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকে। একো নাী্সিসাসের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে থাকলো। যেহেতু সে নিজ থেকে কিছু বলতে পারছিলো না, তাই একে চাচ্ছিলো নার্সিসাস তাকে দেখে কিছু বলুক।
নার্সিসাস শিকারের খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটি ঝর্ণা দেখতে পেয়ে ঝর্ণার পানি পান করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক এমন সময় নার্সিসাস শুকনো মাতার মতো খস খস শব্দ শুনতে পেলেন।
শব্দ শুনতে পেয়ে শিকারি নার্সিসাস সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখানে?
একো নার্সিসাসের প্রতিধ্বনি পাঠালো, কে ওখানে?
নার্সিসাস আবার প্রশ্ন করলেন, তুমি কিসের ভয় পাচ্ছো?
আবারো নার্সিসাসের প্রশ্নের প্রতিধ্বনি ফেরৎ আসলো।
নার্সিসাস বুঝলো কেউ হয়তো অদৃশ্য হয়ে তার সাথে মজা করছে। তাই বললো এখানে এসো। একো ও প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দিয়ে সাথে সাথে এক সুন্দরী কুমারী রূপ ধরে নার্সিসাসের সামনে উপস্থিত হলো।
কিন্তু নার্সিসাস তখন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে নিজেরই প্রতিমূর্তির দিকে।
একে নার্সিসাসের কাছে এগিয়ে যেতেই নার্সিসাস রূঢ় কন্ঠে একোকে বললো,
কে তুমি?
এখানে কেনো এলে?
কে আসতে বলেছে তোমায়?
একো শুধু বললো, তুমি।
নার্সিসাস বিদ্রুপের সঙ্গে একোকে বললো, নার্সিসাসের রূপ ও সৌন্দর্যের সাথে তোমার রূপের কেনো তুলনা চলে না।
নার্সিসাসের এমন রূঢ় আচরণে মর্মাহত হয়ে একো ঝোপের ধারে নিজের মুখ লুকালো। আর নীরব প্রার্থনায় রাগে, দুঃখে ফেটে পড়ে অভিশাপ দিলো, “ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা কি, তুমি তা একদিন বুঝতে পারবে, হে অহংকারী নার্সিসাস।”
একোর চলে যাওয়ার পর নার্সিসাস আবার নিজের দুচোখ ঝর্ণার সেই স্বচ্ছ জলের প্রতিবিম্বের দিকে ফেললো।
আহাঃ কতো সুন্দর মুখশ্রী! সেই প্রতিমূর্তির চারপাশে ফুটে আছে পদ্মফুল। কতো সুন্দর সেই দৃশ্য।
নার্সিসাস আরো নিচু হয়ে সেই প্রতিমূর্তিকে দেখতে লাগলো। আর মনে মনে বলতে লাগলো, তুমি কতই না সুন্দর হে যুবক!
যেন পাথরের তৈরি কোনো প্রতিমূর্তি। অথচ কতোই না জীবন্ত মনে হচ্ছে। প্রতিটি অঙ্গই যেনো প্রাণচঞ্চলতায় ভরপুর।
নার্সিসাস ঝর্ণার জলের সেই প্রতিবিম্ব কে সম্বোধন করে বললেন, কে তুমি?
কি করে এতো সুন্দর হলে?
নার্সিসাস লক্ষ করলো জলের সেই প্রতিমূর্তির মুখের ঠোঁটগুলি যেনো কেঁপে উঠলো!
এরপর নার্সিসাস সেই প্রতিমূর্তিকে আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতে এগিয়ে গেলো। কিন্তু ধরতে গিয়ে দেখলো প্রতিমূর্তি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝর্ণার জলের সেই প্রতিমূর্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আমাকে অন্যান্য ব্যর্থ প্রেমিকদের মতো করে ফিরিয়ে দিও না।”
এরপর নার্সিসাস উত্তেজিত হয়ে বেশ কয়েকবার সেই প্রতিমূর্তিকে ছুঁতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। তখন ঝোঁপের আড়াল থেকে একোর প্রতিধ্বনি এলো ‘ব্যর্থ’!
নার্সিসাস বারংবার বারংবার সেই প্রতিমূর্তিকে ধরাী চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন।
নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা সবকিছু ভুলে গেলো নার্সিসাস। সেই প্রতিমূর্তির প্রেমে এতোটাই সে মাতাল হয়ে উঠলো যে এই জায়গাটা সে একবারও ছেড়ে উঠলো না।
অবশেষে একদিন নার্সিসাস তার ছায়ার সেই প্রতিমূর্তিকে লক্ষ করে হুমরি খেয়ে ঝর্ণার জলের পদ্মফুলের মাঝে ঝাঁপ দিলো। এরপর আর উঠতে পারলো না!
এমনিভাবেই বনভূমির এই নির্জন ঝর্ণার জলে ডুবে নার্সিসাসের নীরব মৃত্যু হলো। কেউ তার মৃত্যু দেখলো না। তার করুন মৃত্যুতে কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ও ফেললো না।
শুধু বনপরী একোর হাহাকার শোনা গেলো বনের আকাশ-বাতাস জুড়ে।
একের অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। যা চেয়েছিলো ঠিল তাই ঘটলো। কিন্তু খুশি হতে পারলো না একো। এ যেনো তার প্রেমের বিরহ আরো বাড়িয়ে দিলো।
অহংকারী নার্সিসাস জীবনে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারলো না। দর্পনে নিজের মুখশ্রী দেখতে পায়নি বলে ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে নিজেরই প্রতিবিম্ব দেখে নিজের অজান্তে নিজেকে ভালোবেসে ফেলেছিল নার্সিসাস। আর সেই ভালোবাসার জন্যই আত্মঘাতী হতে হলো।