You are currently viewing মেটামরফোসিস: যে গল্পে ফ্রানৎস কাফকা পুঁজিবাদী সমাজের নিষ্ঠুরতা ফুটিয়ে তুলেছেন

মেটামরফোসিস: যে গল্পে ফ্রানৎস কাফকা পুঁজিবাদী সমাজের নিষ্ঠুরতা ফুটিয়ে তুলেছেন

ফ্রানৎস কাফকা জার্মান সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী লেখকদের মধ্যে একজন। ১৯৯০ এর দশক থেকে তার সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০ দিনে ১ টি করে বই প্রকাশিত হয়েছে। কাফকার জীবন ছিলো খুবই ছোট, মাত্র ৩৯ বছর বেঁচেছিলেন। সাহিত্যকর্মের সংখ্যাও খুব দীর্ঘ নয়। হাতেগোনা কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে যে বইটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সেটির নাম ‘মেটামরফোসিস’ যার বাংলা অর্থ রূপান্তর।

ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস সম্পর্কে দক্ষিণ আমেরিকার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন:

আমি যখন কলেজে ভর্তি হই, সাহিত্যের সাধারণ পড়াশোনা আমার ভালোরকমই ছিল, আমাদের বন্ধুদের চেয়ে গড়পরতা অনেক বেশি। বোগোতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হতে থাকে, যারা আমাকে সমকালীন লেখকদের সঙ্গে পরিচিত করানো শুরু করে। এক রাতে এক বন্ধু আমাকে ফ্রানৎস কাফকার ছোটগল্পের একটি বই ধার দেয়। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে যাই, আর সে রাতেই কাফকার ‘রূপান্তর’ গল্পটি পড়া শুরু করি। প্রথম লাইনটা পড়ামাত্র আমার প্রায় বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী যে অবাক হই আমি।

প্রথম লাইনটা ছিলঃ- ‘এক ভোরে গ্রেগর সামসা অসুখী সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় প্রকাণ্ড এক পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে …।’

আমি লাইনটা নিজেকে নিজে পড়ে শোনাতে লাগলাম, ভাবলাম , এভাবে যে কেউ লিখতে পারে তা-ই তো আমার জানা ছিল না; যদি জানতাম, তাহলে আমি নিশ্চয় আরো কত আগেই লেখালেখি শুরু করতাম। তারপরই, আর দেরি না করেই, আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করলাম।এরপরই… আমার সাহিত্যে পদচারণার শুরু।

ফ্রানৎস কাফকা যখন এই গল্পটি রচনা করেছিলেন তখন তার বয়স ৩২/৩৩ বছর। সে সময়ে তিনি একটি বীমার কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। সঙ্গে ছিলো বাবার ব্যাবসার জন্য চাঁপিয়ে দেওয়া ঋণের বোঝা। বাবার সাথে খারাপ সম্পর্ক ও অত্যাধিক মানসিক চাপের ধকল সবকিছুই যেনো তিনি মেটামরফোসিস গল্পে নিজেরই আরেকটি সত্তার সৃষ্টি করেছেন।

সংক্ষেপে ফ্রানৎস কাফকার গল্প মেটামরফোসিস

গল্পের শুরু হয় এভাবে যে, গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা নামক এক যুবক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান তার দেহ মানুষের আকৃতি থেকে পরিবর্তিত হয়ে একটা বিশাল বড় মাকড় বা পতঙ্গে আকৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে অর্থাৎ মেটামরফোজড হয়ে গেছে।

এমন একটা পরিস্থিতিতে যে কেউ চিন্তা করবে আমি হঠাৎ কি করে মানুষ থেকে পতঙ্গে রূপান্তরিত হলাম। কিন্তু এখানেই ফ্রানৎস কাফকা চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন গ্রেগর সামসা সেসব নিয়ে কোনো চিন্তাই করছে না। তার একমাত্র চিন্তা ছিলো কিভাবে এখন সে অফিসে যাবে? অফিসে যেতে দেরি হলে অফিসের বস তাকে বকাঝকা করবে কিংবা চাকরি থেকে বাদ ও দিয়ে দিতে পারে। পুঁজিবাদী সমাজ যে কতোটা ভয়ংকর হতে পারে কাফকা এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন।

পতঙ্গে রূপান্তরের পর গ্রেগর সামসার জীবনে রাজ্যের বিড়ম্বনা শুরু হয়। সে যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতো সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কেরানি তার খোঁজ নিতে তার বাড়ি আসেন। কিন্তু তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না। কারণ সে তো তখন আর মানুষ নেই। আর একটি পতঙ্গের পক্ষে তো সেলসম্যানের কাজ করা সম্ভব না। কিন্তু এমন ট্রাজেডিময় পরিবর্তনের পরও গ্রেগর সামসা আশাবাদী ছিলেন তিনি স্বাভাবিক হয়ে আবারো কাজে ফিরতে পারবেন। কিন্তু সে আর কখনোই পতঙ্গের জীবন থেকে বের হতে পারেন নি।

Photo Courtesy: soundscloud

মানুষের জীবনে কত রকম সমস্যাই তো থাকতে পারে। সে হোক শারিরীক অসুস্থতা কিংবা অন্যান্য ঝামেলা। এসব কারনে কর্মসংস্থানে ২/১ দিন অনুপস্থিত থাকা খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সামসার অফিস তা মানতে নারাজ। আর তাই সামসাকে কাজে ধরে নিয়ে আসতে অফিসের প্রধান কেরানিকে পাঠায়। প্রধান কেরানি রুমবন্দী সামসাকে তার পরিবারের সামনেই খারাপ ব্যবহার করে তার চাকরি কেড়ে নেওয়া হুমকিধামকি দেয়। পুঁজিবাদীদের দুনিয়ার রূপ এখানেই প্রকাশ পেয়ে যায়। যেখানে কোনো নীতি নৈতিকতা নেই। যারা কেবল মুনাফা খুঁজে; কর্মীরা বাঁচুক বা মরুক সে দিকে তারা চোখ মেলেও তাকাবে না।

গ্রেগর সামসা পতঙ্গে রূপান্তরিত হওয়ার পর তিনি সবকিছুতেই বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। একমাত্র তার ছোটবোন তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো, তাছাড়া আর কেউ নয়। তার বোন তার রুমে ঢুকতো তাকে খাবার দিতো। তার বোনও এটা করতে পুরোপুরি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো না। হঠাৎ পতঙ্গে রূপান্তরিত হওয়া ভাইকে তিনি ভয় পেতেন। তার পরিবার তাকে তার রুমের জানালাও খুলতে দিতো না, কেউ যদি তার এমন বিভৎস রূপ দেখে ফেলে তাহলে তাদের সমাজ দেখে বের করে দেবে।

এই গল্পে একান্নবর্তী পরিবারগুলোর একমাত্র আয় করা ব্যক্তিটি কোনোভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে কী নিদারুণ দুর্দশা ভোগ করতে হয় সেই দিকটিও কাফকা তুলে ধরেছেন। সামসার বাবার ব্যবসা ৫ বছর আগেই লাটে উঠেছিল। আর তাই সামসাকে জীবিকার তাগিদে সেলসম্যান হিসেবে কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়। একদিকে তার বাবার ঋণ শোধ করা, অপরদিকে পরিবারের ভরণপোষণ চালানো– দুটো বিরাট দায়িত্বই তার কাঁধে এসে পড়ে।

তবে কাজে মনোযোগী সামসা’র আয় দিয়ে তার পরিবার সুন্দর চলছিল। কিন্তু সমস্যা হয় তার রূপান্তরের পর। বৃদ্ধ বয়সে তার বাবার যেখানে অবসর উপভোগের কথা ছিল সেখানে তাকে ব্যাংকের বার্তাবাহকের কাজ নিতে হয়। তার বৃদ্ধ মায়ের হাঁপানির সমস্যা ছিল। তাকেও অন্তর্বাস সেলাইয়ের কাজ নিতে হয়। তার ছোটবোন গ্রেটা সামসা পরিবারের অর্থনীতির যোগান দিতে সেলসগার্লের কাজ শুরু করেন। গ্রেগরের হঠাৎ রূপান্তরে সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে নির্মম বাস্তবতার কাছে হেরে যেতে হয় তার পরিবারকে।

ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস Image Courtesy: Marquis Education

গ্রেগর সামসার স্বপ্ন ছিল তার বোনকে সে একটি নামকরা সঙ্গীত শেখার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাবে। ঋণ শোধ হয়ে গেলে তার সেলসম্যানের বিরক্তিকর চাকরি ইস্তফা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার স্বপ্ন আর পূর্ণতা পায়নি। বোনকে আর ভর্তি করানো হয়নি। ঋণ শোধ হওয়ার আগেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। পরিবারটিকে সে আর আর আগলে রাখতে পারে নি।

ফ্রানৎস কাফকার মেটামরফোসিস বা রূপান্তর শুরু মাত্র গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসার সাথে হয়েছে তা নয়। শরীরের সাথে সাথে পরিবারের মানুষজন, অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক সবকিছুরই রূপান্তর ঘটেছে এই গল্পে।

গল্পের শেষটা খুব নির্মমভাবে শেষ হয়েছে। গ্রেগর সামসা মারা যায়। তার মৃত্যুতে তার পরিবারের সদস্যরা যেন হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। গ্রেগরের জন্য আর তাদেরকে বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হবে না। সমাজ বা প্রতিবেশীর ভয়েও থাকতে হবে। বাড়িতে একটা অতো বড় মাকড় বাস করছে সেই ভয় নিয়ে আর বাস করতে হবে না।

একজন মানুষ অক্ষম হয়ে গেলে পুঁজিবাদী সমাজ কতোটা নির্ম আর নিষ্ঠুর হতে পারে তা কাফকা এই গল্পের মাধ্যমে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন পুঁজিবাদী সমাজে একজন অক্ষম মানুষের পরিণতি কতোটা ভয়াবহ। যেখানে সমাজ, পরিবার কিংবা কোম্পানি কেউ তাকে চেনে না। যতক্ষণ মুনাফা আছে ততক্ষণ তারা আছে। যখন মুনাফা আসবে না তখন কেউ আর চিনবে না।

Leave a Reply