ফোর্বস এর তথ্যমতে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি জেফ বেজোস (১৩৫.৭ বিলিয়ন) এই লিস্টে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ইলন মাস্ক বিলিয়নিয়ারের তালিকায় আছেন ইল মস্ক, বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট।
কিন্তু তাদের এই বিশাল সম্পত্তি ও পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তিটির সম্পত্তির তুলনায় নস্যি।
মুসার সম্পদের যে শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে আসলে তিনি যে কতটা সম্পদশালী এবং ক্ষমতাশালী ছিলেন তা ধারণা করাও কঠিন।
~ রুডলফ বুচ ওয়ার, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
২০১২ সালে একটি মার্কিন ওয়েবসাইট, সেলিব্রিটি নেট ওর্থ তাঁর মোট সম্পদের মূল্য ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে একটি ধারণা দেয়। তবে অর্থনীতির ইতিহাসবিদরা একমত যে সংখ্যা দিয়ে তাঁর সম্পদের কোন সঠিক ধারণা দেয়া একরকম অসম্ভব।
স্বর্ণের রাজা মুসা
মানসা মুসার জন্ম ১২৮০ সালে মালির শাসক পরিবারে। মানসা মুসা মালির ১০ম শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসেন ১৩১২ সালে। এর আগে সিংহাসনে ছিলেন মুসার ভাই আবু-বকর।
চতুর্দশ শতকের সিরীয় ইতিহাসবিদ শিহাব আল-উমারির বর্ণনা অনুযায়ী, আটলান্টিক মহাসাগর এবং তার ওপারে কী আছে তা নিয়ে মারাত্মক কৌতুহলী ছিলেন আবু-বকর। বলা হয় ২ হাজার জাহাজ এবং হাজার-হাজার পুরুষ, নারী এবং দাস-দাসী নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি জমান তিনি, এবং এরপর আর কখনো ফিরে আসেননি।
প্রয়াত মার্কিন ইতিহাসবিদ আইভান ভ্যান সারটিমার মতো আরো অনেকেই আবার মনে করেন আবু-বকর শেষপর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছুতে পেরেছিলেন। যদিও এর কোন প্রমাণ নেই। যাইহোক, উত্তরাধিকার সূত্রে ভাইয়ের ফেলে যাওয়া রাজত্বের শাসনভার নেন মানসা মুসা।
তার শাসনামলে মালি রাজত্বের আকার বাড়তে থাকে। তিনি তার রাজত্বে আরো ২৪ টি শহর যুক্ত করেন, যার একটি ছিল টিম্বাকটু।
তার রাজত্ব বিস্তৃত ছিল ২,০০০ মাইলজুড়ে, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে বর্তমান নিজার, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া, মালি, বুর্কিনা ফাসো, গাম্বিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি এবং আইভোরি কোস্টের বড় অংশ ছিল তার রাজত্বে।
মুসার সম্পত্তির উৎস
এই বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে তাঁর আয়ত্ত্বে আসে মূল্যবান খনিজ সম্পদ- বিশেষ করে স্বর্ণ এবং লবণ।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের হিসেবে মানসা মুসার শাসনামলে তৎকালীন বিশ্বে যে পরিমাণ স্বর্ণের মজুত ছিল তার অর্ধেকই ছিল মালিতে।
আর তার সবটারই মালিক ছিলেন মানসা মুসা।
সে সময় পশ্চিম আফ্রিকা ছিল স্বর্ণ এবং লবণে সমৃদ্ধশালী জনপদ। এই স্বর্ণ এবং লবণের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার অধীনস্ত সুবিশাল সাম্রাজ্য থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে মুসা তার সাম্রাজ্যকে অত্যন্ত সম্পদশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম আফ্রিকা থেকে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার মধ্যবর্তী সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক পথ তার অধীনে থাকায় আরব এবং ইউরোপীয় বণিকদের নিকট থেকে আদায় করা রাজস্ব থেকেও তার সাম্রাজ্য প্রচুর আয় করে। একই সময় ইউরোপ যখন গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর প্লেগ সহ বিভিন্ন মহামারীর সাথে লড়াই করে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করছিল, তখন মুসার অধীনে সমগ্র পশ্চিম আফ্রিকা দিনে দিনে সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছিল।
মুসার হজ্ব যাত্রা
মুসার এই বিশাল পরিমাণ সম্পত্তির কথা কেবল তার রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বহি বিশ্বের কাছে মুসা ছিলেন একজন অচেনা ও অজানা ব্যাক্তি। তবে মুসা আলোচনায় আসেন ১৩২৪ সালে প্রায় ৪ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হজ্ব করতে গিয়ে।
বেশ কিছু ঐতিহাসিক সূত্রমতে মুসা দূর্ঘটনাক্রমে নিজের মা কে হত্যা করে ফেলেছিলেন। তাই তিনি সবসময় অনুশোচনায় ভুগতেন। অনুশোচনা দূর করতে তিনি প্রচুর দান করতেন। একটা সময়ে তিনি মনে শান্তি আনার জন্য ওলামাদের পরামর্শে হজ্বে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত তিনি পশ্চিম আফ্রিকার প্রথম রাজা যিনি প্রথম হজ্ব করেছিলেন।
হজ্ব করার জন্য মানসা মুসা ৬০,০০০ মানুষের একটি দল নিয়ে মালি ত্যাগ করেন। তার সেই দলে ছিলেন সম্পূর্ণ মন্ত্রী পরিষদ, কর্মকর্তারা, সৈনিক, কবি, ব্যবসায়ী, উটচালক এবং ১২,০০০ দাস-দাসী। একইসাথে খাবারের জন্য ছিলো ছাগল এবং ভেড়ার এক বিশাল বহর। পুরো সফরে তার প্রতিটি ক্রীতদাস ২ কেজি সোনার বার বহন করত। এছাড়াও প্রায় ৮০টি উটের একটি কাফেলা নিয়ে ভ্রমণ করেছিল, প্রতিটি উট ১৪০ কেজি সোনার ব্যাগ বহন করে চলেছিল।
সেই বিশাল দল দেখে মনে হচ্ছিল যেনো মরুর বুক দিয়ে যেন একটি শহর চলছিল।
যে শহরের এমনকি একজন দাসের গায়েও স্বর্ণখচিত পারস্যের সিল্কের জামা। শহরের সাথে চলছিল শত-শত উটের আরেকটি বহর, যার প্রতিটির পিঠে শত-শত সের খাঁটি স্বর্ণ।
মিশরের অর্থনীতিতে ধ্বস
হজ্ব শেষে মিশরের কায়রোতে তিন মাস অবস্থানের সময় তিনি যে হারে মানুষকে স্বর্ণ দান করেছেন তাতে পরবর্তী ১০ বছর ঐ পুরো অঞ্চলে স্বর্ণের দাম তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়, অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্মার্টঅ্যাসেট ডট কমের এক হিসেবে, মানসা মুসার মক্কা যাত্রার ফলে স্বর্ণের যে অবমূল্যায়ন হয় তাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তৎকালীন সময়ে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল।
ধর্ম ও শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে মানসা মুসা
মানসা মুসা তার বেশিরভাগ অর্থ ইসলাম ধর্মের প্রচার, শিক্ষা ও নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছিলেন। তিনি পুরো মালি সাম্রাজ্য জুড়ে মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন।
তার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকল্পটি হল টিমবুকটুর মহান মসজিদ, জিঙ্গুরেবার মসজিদ। বর্তমানে মসজিদটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
তার পৃষ্ঠপোষকতায়, সাঁকোর বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্বের জ্ঞানের বৃহত্তম কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় ২৫,০০০ শিক্ষার্থী ছিল এবং প্রায় ৭,০০০০০ টিরও বেশি পান্ডুলিপি সহ একটি লাইব্রেরি ছিল। এই লাইব্রেরিটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির পর আফ্রিকার বৃহত্তম লাইব্রেরি।
দীর্ঘ ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৩৩৭ সালে সম্রাট মুসা মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরে তার ছেলে মাগান সিংহাসনে বসেন কিন্তু তিনি সাম্রাজ্য সামলাতে পারেন নি ঠিকমতো। ধীরে ধীরে শাসকের অযোগ্যতায়, গৃহযুদ্ধে এবং বহিঃশক্তির আক্রমণে তার সাম্রাজ্যের এই বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অক্ষত এবং প্রতিষ্ঠিত থাকে তার সময়ে তৈরি হওয়া মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বিবিসি