You are currently viewing লেপা রেডিক : নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সাহসী কিশোরীর বিদ্রোহ

লেপা রেডিক : নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সাহসী কিশোরীর বিদ্রোহ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরো ইউরোপ তখন ফ্যাসবিবাদী হিটলারের নাৎসি বাহিনীর তান্ডবে বিধ্বস্ত। সেই তান্ডবের আঘাত লেপা রেডিকের দেশ তৎকালীন যুগোস্লাভিয়াতেও পড়েছিল। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে হিটলারের নাৎসি বাহিনী যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ করে সেখানে নিজেদের পাপেট সরকার প্রতিষ্ঠা করে। কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী লেপা রেডিক নাৎসি সমর্থিত এই শাসনব্যবস্থা মেনে নিতে পারেন নি। 

লেপা রেডিক তখন মাত্র ১৫ বছরের এক কিশোরী। তিনি নিজ দেশজে রক্ষা করার জন্য যোগ দেন যুগোস্লাভিয়ার পার্টিজান বাহিনীতে। ছোট্ট কিশোরী লেপা হয়তো তখনো ভাবেন নি তার জীবনের শেষ পরিণতি হবে ফাঁসির ধড়িতে ঝুলে মৃত্যু। আর মৃত্যুর পর তিনি হয়ে উঠবেন জাতীয় বীর ও নারীদের সাহসের প্রতীক।

ফাঁসি গলায় দাঁড়িয়ে আছেন অকুতোভয় কিশোরী লেপা রেডিক Image Source: Flickr

লেপা রেডিক ১৯২৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার বসনিয়া অঞ্চলের গ্রাডিসকা জেলার গাসনিকা গ্রামের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শিক্ষা অতো বেশি ছিলো না। তবে পরিবারের সবাই ছিলেন প্রচন্ড সাহসী। 

লেপা রেডিক তার প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর বসনিয়ার প্রোগ্রেসিভ গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। এখানেই লেপার রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। লেপা কমিউনিস্ট আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। লেপার কমিউনিস্ট আদর্শে প্রভাবিত হবার পেছনে তার চাচার ভ্লাদেতা রেডিকের প্রভাব রয়েছে। ভ্লাদেতা রেডিক নিজেও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। লেপা তার চাচার মাধ্যমে বেশি প্রভাবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়।

হিটলারের আক্রমণের পর ১৯৪১ সালে সেখানে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। সেই পুতুল সরকারের দায়িত্বে ছিলো উস্তাশা (Ustaše) নামক একটি ক্রোয়েশিয়ান ফ্যাসিবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই দলটি ফ্যাসিবাদ হিটলারের মতোই একনায়কতান্ত্রিক ও জাতিগত শুদ্ধিকরণ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলো। এই দলের উৎত্থানের ফলে লেপার পরিবারের মতো হাজারো পরিবার যারা কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাস করতো তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তাদের শাসনামলে যুগোস্লাভিয়ায় তারা প্রায় এক লক্ষ ইহুদি, রোমান, সার্ব ও কমিউনিস্টপন্থিদের হত্যা করেছিলো। 

১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে লেপার পরিবারের উপরেও উস্তাশা (Ustaše) গোষ্ঠীর অত্যাচার নেমে আসে। তাদের পুরো পরিবারকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। একই বছরের বড়দিনের আগেরদিন অলৌকিকভাবে লেপার পরিবার পার্টিজান দলের সহযোগিতায় কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর লেপা তার বাবা ও দুই চাচার সাথে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেয়।

হিটলারের নাৎসি বাহিনী তখন শুধুমাত্র শহরগুলো নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিলো। গ্রামাঞ্চল বা পাহাড়ি এলাকাগুলোতে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। এই গ্রাম ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে তখন প্রতিরোধ গড়ে উঠতে শুরু করে। সে সময়ে যুগোস্লাভিয়ার প্রধান দুটি দল ছিলো চেতনিক ও পার্টিজান। উভয় দলই দেশকে বাঁচানোর জন্য অভিন্ন লক্ষ নিয়ে কাজ করছিলো। তবে তাদের নীতিগত আদর্শ ছিলো ভিন্ন। চেতনিকদের একটি বড় অংশই ছিলো যুগোস্লাভিয়ার সেনাবাহিনীর অংশ। তাদের লক্ষ্য ছিলো যুগোস্লাভিয়ায় একটি বিশুদ্ধ সার্বিয়া জনগোষ্ঠীর দেশ প্রতিষ্ঠা। তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী কখনো কখনো নাৎসি বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে ও কাজ করতো। অপরদিকে পার্টিজানরা ছিলো চেতনিকদের থেকে অধিক সুসংগঠিত। আর সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন জোসিপ ব্রজ টিটো। যিনি পরবর্তীতে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পার্টিজানরা নাৎসিদের উপর হঠাৎ আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি নাৎসিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ও ছড়িয়ে দিতো।

বিদ্রোহে যোগ দেবার পর প্রথম দিকে লেপা ও তার বোন দারা কে সাথে নিয়ে আহত যোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। পরবর্তীতে লেপা আরো দায়িত্বশীল কাজের দায়িত্ব পান। গ্রামবাসীদের নাৎসিদের থেকে বাঁচাতে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া কিংবা নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করে গোপন তথ্য বের করা থেকে খাবার ও অস্ত্র সরবরাহ। 

লেপা অনেকবার নাৎসি বাহিনীর হাতে বন্দী অনেক সাধারণ মানুষদের মুক্ত করেছেন। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেপা নাৎসিদের হাতে বন্দী ১৫০ জন নারী ও শিশুদের একটি দলকে উদ্ধার করতে গিয়ে লড়াইয়ের এক পর্যায়ে নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান, কারন তার গোলাবারুদ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। 

গ্রেফতারের পর সাথে সাথেই তাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। আদেশ দেবার পর লেপাকে ৩ দিন বন্দী করে রেখে সেখানে অমানবিক নির্যাতন করা হয়, যাতে সে তার ও তার সঙ্গীদের কার্যক্রম সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে দেয়।

১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি লেপার ফাঁসি কার্যকর করার আগে ফাঁসির দড়ি জড়ানো অবস্থায় নাৎসি বাহিনী তাকে শেষবারের মতো ত জিজ্ঞেস করে, তার কমান্ডার ও সঙ্গী সাথীদের সম্পর্কে। তাকে বলা হয়, সঠিক উত্তর দিলে লেপাকে তারা ছেড়ে দেবে।

সেই প্রশ্নের জবাবে লেপা রেডিক বলেছিলো,

“আমি বিশ্বাসঘাতক নই। যাদের কথা জিজ্ঞেস করছো, তারা আমার হত্যার প্রতিশোধ ও আসল অপরাধীদের হত্যা করার জন্য এলে নিজেদের পরিচয় জানিয়ে যাবে।”

মৃত্যুর আগে লেপার সাহসী কর্মকাণ্ডের ঘটনাটি অনেক ক্যামেরায় ক্যামেরাবন্দী হয়েছিলো। পরবর্তীতে এই ছবি ও ঘটনা প্রকাশের পর লেপার সাহস ও বীরত্ব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আরো অনেক মেয়ে ও নারী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জোসিপ ব্রজ টিটো যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। তিনি লেপা রেডিক কে ‘পিপলস হিরো অব যুগোস্লাভিয়া’ খেতাব প্রদান করেন। এটি দেশের সর্বোচ্চ বীরত্বের স্বীকৃতি। 

লেপার মৃত্যুর পর বহু যুগ পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি সাহসী নারীদের অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। বয়স কোনো বাধা নয় একজন কিশোরী ও পারেন ভয়ানক শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করতে। লেপার বীরত্বকে স্মরণ করে বসনিয়া এবং সার্বিয়ার বিভিন্ন স্থানে তার নামে রাস্তা, বিদ্যালয় এবং স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে। লেপার জীবন কাহিনি ও যুদ্ধকালীন সাহসিকতার ঘটনা ইউরোপের বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

Leave a Reply