“শুধু দস্তুরমত একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমত এক সংঘটন। চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল”
উপন্যাসের এই প্রথম লাইটা দিয়েই তারাশঙ্কর একেবারে বাজিমাত করে ফেলেছেন। একটা সময় ছিলো যখন গরীব হতদরিদ্র কিংবা নিচু বংশের কেউ ভালো কাজ কিংবা মহৎ কর্ম করে ফেললে তাকে সম্মান বাহবা কিংবা শ্রদ্ধা করার বিপরীতে হাসিতামাশা করা হতো, অবশ্য এই অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি তা একেবারে বলা যায় না। এখনো সেরকম সুযোগ হলে তা আমরা প্রদর্শন করি।
গল্পের প্রধান চরিত্র নিতাইচরণ। ডোমবংশে জন্ম হয়েছে তার, হিন্দু সমাজে তা পতিত ও নিচু সামাজিক স্তরের। তার পূর্বপুরুষ সকলেই চুরি,ডাকাতি ও খুন পেশার সাথে সম্পৃক্ত। তিনি তার পূর্বপুরুষদের পেশা ধরে রাখেন নি কারণ তিনি যে স্বভাব কবি। পারিবারিক পেশাকে ঘৃণা করে তিরস্কার করায় তার পরিবার তাকে ছেড়ে দিয়েছে।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাসে নিতাইয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন:
‘খুনীর দৌহিত্র, ডাকাতের ভাগিনেয়, ঠ্যাঙাড়ের পৌত্র, সিঁদেল চোখের পুত্র-নিতাইয়ের চেহারায় বংশের ছাপ স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। দেহ কঠিন; পেশী দীর্ঘ সবল, রঙ কালো, রাত্রি অন্ধকারের মতো”
নিতাই যেনো তার পরিবারের দূর্ণামের মাঝে এক ব্যতিক্রমী পালক। লেখক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় নিতাইকে আরো সম্বোধন করেছেন দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ নামে।
পরিবার ছেড়ে আসার পর নিতাইচরণ তার বন্ধু রাজনের সহায়তায় কবি গানের আসরে তার কবিত্ব প্রকাশের সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে নিতাইচরণ পরিচিতি পায় কবিয়াল হিসেবে। নিতাইকে রাজনের ঠাকুরঝি প্রতিদিন দুধ দিতো। ঠাকুঝির স্বামী সংসার থাকার পর তার সাথে নিতাইয়ের ভালোবাসা ও প্রণয়ের সৃষ্টি হয়। একটা সময়ে তাদের এই সম্পর্ক জানাজানি হয়ে গেলে নিতাই দেশ ছাড়ে, আর ঠাকুরঝির সংসারে নেমে আসে দূর্দশা ও অশান্তি।
এরপর নিতাইয়ের জীবনে আরো একবার প্রেমের হাওয়া নিয়ে আসে বসন্ত। বসন্ত ঝুমুর দলের প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু বসন্ত শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। বেশিরভাগ সময়ই সে শয্যাশায়ী থাকে। নিতাই বসন্তের সেবা শুশ্রুতা করে বেশ কয়েবার শারীরিক অবস্থা ভালো করে ফিরিয়ে আনলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। বসন্ত নিতাইচরণকে ফেলে রেখে চলে যায় না ফেরার দেশ। নিতাইচরণ বসন্তের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়ে, আর তাই বসন্তের সৎকার শেষে সে তীর্থে চলে যায়। কয়েক মাস তীর্থে থেকে সে আবারো নিজের দেশে ফিরে আসে। ফিরে এসে বন্ধু রাজনের মুখে শুনতে পায়, ঠাকুরঝি অনেকদিন আগে তার বিরহে পৃথিবী ত্যাগ করেছে। এখবর শুনে নিতাইয়ের হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, সে এককালে বসন্তের জন্য রচনা করা গান গেয়ে উঠে।
‘এই খেদ আমার মনে-
ভালবেসে মিটল না সাধ কুলাল না এ জীবনে! হায় জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভূবনে?’
কবি উপন্যাসে এই কবিতাটিই উপন্যাসের মুল সুর। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিতাইচরণ জীবনে পাওয়ার চেয়ে হারিয়েছে অনেক বেশি। এক হতভাগা কবিয়ালের জীবনকে অসাধারণ ভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। কবি উপন্যাস কে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে একটি মনে করা হয়। আপনি যদি কবি উপন্যাস না পড়ে থাকেন তাহলে বলবে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্নটি পড়া বাদ দিয়ে নিজেকে করেছেন বঞ্চিত।