গৌড়ে সেনরাজাদের রাজত্বের অবসান ঘটেছে বহুকাল হলো কিন্তু তাদের আমল থেকে প্রসারিত কাব্যচর্চা এখনো স্বগর্বে টিকে আছে। ফুলেশ্বরী নদীর তীরবর্তি ছায়াঢাকা, পাখিডাকা ছোট্ট সবুজ গ্রাম পাতুয়াইর। এই শান্ত পরিবেশে দ্বিজবংশী দাশের এই টোল। দ্বিজবংশী নিজেও বিখ্যাত কবি। তার সৃষ্ট মনসামঙ্গল কাব্যের চরণগুলো পথে প্রান্তরের মানুষের মুখে মুখে গান হয়ে ফোটে। তার কন্যা চন্দ্রাবতী। দ্বিজবংশী তার অন্যান্য সন্তানদের থেকে চন্দ্রাবতীকে অধিক স্নেহ করেন। এর অন্যতম চন্দ্রাবতীর কাব্যপ্রেম, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। চন্দ্রাবতীর যা প্রতিভা আছে তাতে তার পিতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দ্বিজবংশীর প্রিয় আর একজন প্রিয় ছাত্র আছে।সেও সমপ্রতিভার অধিকারী, নাম তার জয়নন্দ চক্রবর্তী।
পাতুইয়ার পাশ্ববর্তী গ্রাম সুন্ধায় বাড়ি জয়নন্দের। ছোটবেলায় মা-বাবা গত হয়েছে তাই মাতুলালয়েই সে বেড়ে উঠেছে।
দ্বিজবংশীর শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিলো , তিনি চন্দ্রাবতীকে বললেন, “ মা , যা তো পূজার জন্য ফুল নিয়ে আয়। ” , চন্দ্রাবতী ছুটল টোলের পাশেই পুকুরধারে ফুল পাড়তে। জয়নন্দের অভ্যাস ছিলো সকাল সকাল টোলে আসা। চন্দ্রাবতী নিবিষ্ট মনে ফুল তুলছে আর গান গাইছে।
জয়নন্দ এমন সুমিষ্ট কণ্ঠের গান শুনে , আর ভাবে কে গায়! পুকুর পাড়ে চোখ পড়তে পায় একটি সুন্দরী বালিকা একমনে ফুল তুলছে।
কাব্যরসিক জয়নন্দ গেয়ে উঠে
“চারইকুনা পুষ্করিণীর পাড়ে চম্পা নাগেশ্বর,
ডাল ভাইঙা পুষ্প তোল কে তুমি নাগর?”
চমক ভেঙে চন্দ্রাবতীও গেয়ে উঠে,
“দ্বিজবংশীর কইন্যা আমি, চন্দ্রাবতী নাম,
দেব সেবায় পুষ্প তুলি, নিবা নাকি দাম?”
চন্দ্রাবতীর টিটকারিতে দুজনেই হেসে উঠে একসাথে। জয়নন্দ ফুল তুলতে সাহায্য করে চন্দ্রাবতীতে। ভাব হয় দুটি বালক-বালিকার। এমনি করে দিন যায় দু’জনার। বাল্যকালের খেলার সঙ্গী জয়নন্দ ও চন্দ্রবতীর কাব্যচর্চা চলে একসাথে। সেই যে পুষ্পবনে শিবপূজার ফুল তোলার সময় পরিচয় ও সখ্যতা ঘটে তা আরো গভীর হয়। দু’জনে মুখে মুখে কত পদ রচনা করে!
এমন কি চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজবংশীর অনেক রচনায় এই দুজনার রচিত ছোটো ছোটো অনেক পদ স্থান পেতে থাকে। দেখতে দেখতে বালিকা চন্দ্রাবতী ষোড়শী হয়। সেই সঙ্গে তার রূপ ও গুণের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কত জায়গা থেকে, কত বড়ো পরিবার থেকে আসতে শুরু করে বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু মন যে বাঁধা বাল্যকালের সঙ্গী জয়নন্দের কাছে। জয়নন্দও বাঁধা পড়ে চন্দ্রাবতীর মনে।
একদিন নির্জনে জয়নন্দ গেয়ে উঠে,
“ফুল তুলো ফুল তুলো কন্যা, তুমি ফুলের রাণী, ঐ না ফুলের সঙ্গে বান্ধা আমার পরাণী।”
চন্দ্রাবতী লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে যায় অন্দরে। জয়নন্দ খুশি মনে চন্দ্রাবতীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় গুরুর কাছে। দ্বিজবংশী নিজেও পছন্দ করতেন জয়নন্দকে। খুশি মনে রাজি হলেন তিনি। বিবাহের দিনও স্থির হলো।
জয়নন্দ খুশি মনে চলেছে নদীর ঘাটে স্নান করতে। কিন্তু থমকে দাঁড়ায় ঘাটে অপরূপা এক তরুণী দেখে। স্থানীয় মুসলমান কাজীর মেয়ে আসমানী ঘাটে এসেছিল সখিদের নিয়ে। অসামান্য রূপে মুগ্ধ হলেন ব্রাহ্মণপুত্র জয়নন্দের। স্নান করা আর হলো না জয়নন্দের। ছুটলেন বাড়ির পানে। যতবার চোখ বন্ধ করে, ভেসে উঠে হাস্যরত আসমানীর বদন। কাব্যচর্চা , চন্দ্রাবতী কিছুই আর ভালো লাগে না জয়নন্দের।
না পেরে এবার জয়নন্দ আসমানীকে প্রেমপত্র দিলে লাগলেন। কিন্তু এর ফলাফল হলো মারাত্মক। জয়নন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর প্রেমের কথা জেনেও আসমানী তার পিতাকে বললো সে জয়নন্দকে বিবাহ করতে চায়। কন্যা অন্তপ্রাণ কাজী তৎক্ষনাৎ জয়নন্দকে বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করলেন। জয়নন্দ হলো জয়নুল। এরপর কাজী মহা ধুমধামে আসমানীর সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। জয়নুল ও আসমানীর বিয়ের দিনটিই হবার কথা ছিলো ‘জয়নন্দ ও চন্দ্রাবতীর’ বিয়ের দিন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা চন্দ্রাবতী বধূ হয়ে অপেক্ষায় ছিলো প্রিয় সখার।
দ্বিজবংশী ভগ্ন হৃদয়ে জয়নন্দের ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র বিয়ের সংবাদ আনলেন।
“ঘটনার আকস্মিতায় হতভম্ব চন্দ্রাবতী,
না কাঁদে, না হাসে চন্দ্ৰা নাহি কহে বাণী।
আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী।
মনেতে ঢাকিয়া রাখে মনের আগুনে।
জানিতে না দেয় কন্যা জ্বলি মরে মনে।”
এরপর শুরু হলো চন্দ্রাবতীর বিরহ – বিধুর জীবন। কন্যার এই হাল দেখে বিচলিত হয় দ্বিজবংশী। তিনি আবার কন্যার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে যান। কিন্তু চন্দ্ৰবতী পিতার কাছে আর্জি করলেন আজীবন চিরকুমারী থাকার। তিনি দ্বিজবংশীর কাছে অনুরোধ করলেন , একটি শিব মন্দির বানিয়ে দেওয়ার। যেখানে তিনি শিবের সাধনায় আত্মনিবেদন করবেন। পিতা তার জন্য ফুলেশ্বরী নদীর তীরে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করিয়ে দিলেন।
শুরু হলো চন্দ্রাবতীর নতুন জীবন। তিনি একমনে, শিবের আরাধনা করেন সেই সাথে চলে কাব্যচর্চা। একে একে জন্ম নিলো দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারাম, মলুয়া পদ্মপুরাণ প্রভৃতি কাব্যগীতি।
ইতোমধ্যে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর জয়গন্ত বুঝতে পারে, আসমানীর প্রতি তার টানটা ছিল মোহ মাত্র। মন থেকে সে চন্দ্রাবতীকেই প্রকৃত ভালোবাসেন। হায় হায় করে ওঠে জয়নন্দ। চন্দ্রাবতীকে দেখার জন্য আনচান করে মন। অনুতপ্ত জয়নন্দ স্থির করে চন্দ্রাবতীর সাথে দেখা করে তার মনের কথা জানাবেন। একদিন মনের সব বাঁধা ফেলে ছুটে যান চন্দ্রাবতীর মন্দির প্রাঙ্গনে। কিন্তু হায় , বন্ধ কপাট!
জয়নন্দ চন্দ্রাবতীকে পত্র লিখে,
“শুন রে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হৈছে ছাই।
শিশু কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের মালা।
তোমারে দেখিতে মন হৈয়াছে উতলা।
ভালো নাহি বাসো কন্যা এ পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে।
একবার দেখিয়া তোমা ছাড়িব সংসার।
কপালে লিখেছে বিধি মরণ আমার।”
পত্র পড়ে চন্দ্রাবতীর সংকল্পিত ব্রহ্মচর্য অবিচলিত সংযম ও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। অশ্রুসিক্ত বদনে তিনি পিতার কাছে বিধান চাইলেন।
কন্যার মানসিক শিথিলতা মেটাতে দ্বিজবংশী তাকে সান্ত্বনা দিলেন,
“তুমি যা লইয়াছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর।”
কন্যার মনের অস্থিরতা কমাতে দ্বিজবংশী চন্দ্রাবতীকে রামায়ণ রচনার নির্দেশ দিলেন। জয়চন্দ্রকে পত্রদ্বারা নিষেধ করে চন্দ্রাবতী যোগাসনে বসে মনের সমস্ত অর্গল রুদ্ধ করলেন তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেল। শিব- ধ্যানে আত্মহারা হয়ে তিনি সমস্ত জাগতিক জ্ঞান লুপ্ত হলেন। শুরু করলেন পিতৃদেশে রামায়ণ রচনা।
এক সন্ধ্যায় জয়চন্দ্র ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ হয়েছিল; অপর সন্ধ্যায় সেই বিচ্ছেদ মুছে গিয়ে মিলন হবে দুজনার, এই আশায় জয়নন্দ আবার রওনা দিলো চন্দ্রাবতীর মন্দিরে। জয়নন্দ যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছলেন তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ। শিব মন্দিরের ভেতর দ্বার রুদ্ধ করে সন্ধ্যারতি ও তপজপে নিজেকে নিবদ্ধ করেছেন চন্দ্রাবতী। জয়নন্দ মন্দিরের দ্বারে এসে কয়েকবার ডাকলেন চন্দ্রাবতীকে। কিন্তু দ্বার রুদ্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় সেই শব্দ প্রবেশ করলো না চন্দ্রাবতীর কানে। ব্যর্থ প্রেমিক জয়নন্দ তখন লালবর্ণের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দ্বারে চারছত্রের একটি পদে চন্দ্রাবতী ও ধরাধামকে চিরবিদায় জানিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
“শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৌবন কালের সাথী। অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলে সম্মত।
বিদায় মাগী চন্দ্রাবতী জনমের মত।”
কিছুই বুঝতে পারলো না চন্দ্রাবতী। কিছু সময় পরে মন্দির থেকে বেরিয়ে চন্দ্রাবতী মন্দির পরিষ্কার করার জন্য কলসী কাঁখে জল আনতে পার্শ্ববর্তী ফুলেশ্বরী নদীতে গেলেন। দেখতে পেলেন হতভাগা জয়নন্দের প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেশ্বরীর জলে। ফুলেশ্বরীর জলে নিজেকে নিমগ্ন করে প্রাণত্যাগ করেছেন জয়নন্দ। এই অবস্থায় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলো না চন্দ্রাবতী। অচিরে প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করলেন চন্দ্রাবতী।
“একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাই কেহ।
জলের ওপরে ভাসে জয়চন্দ্রের দেহ।
দেখিতে সুন্দর কুমার চাঁদের সমান।
ঢেউ – এর ওপরে ভাসে পৌৰ্ণ মাসী চাঁদ। আঁখিতে পলক নাই! মুখে নাই বাণী।
পারেতে দাঁড়াইয়া দেখে উন্মুত্তা কামিনী।”
চন্দ্রাবতী ষোড়শ শতাব্দীর কবি এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি । এই বিদূষী নারী অন্যান্য কাব্য ছাড়াও পিতার আদেশে বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে , মৈয়মনসিংহ গীতিকার এক কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ চন্দ্রাবতী চরিতকথা রচনা করেন। তবে জয়নন্দের গ্রাম সুন্ধা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত পাতুয়াইর/ পাটোয়ারী গ্রাম আজও আছে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। আর আছে ফুলেশ্বরী নদীর ধারে চন্দ্রাবতীর পূজিত শিব মন্দির।
তথ্যসূত্রঃ আসাদুজ্জামান জুয়েলের বাংলা কিংবদন্তি সংকলন