রাজা অষ্টম হেনরি ইংল্যান্ডের ইতিহাসের একজন বিখ্যাত এবং একই সাথে কুখ্যাত হিসেবে আলোচিত ও সমালোচিত একজন ব্যক্তি। ১৫০৯ সাল থেকে ১৫৪৭ সাল পর্যন্ত তার শাসনামলে ইংল্যান্ডের ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে বিশাল পরিবর্তন আসে। একই সাথে হেনরির জটিল চরিত্র, প্রেম ও সংস্কার ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
অষ্টম হেনরির জন্ম হয় ১৪৯১ সালের ২৮ জুন। তার বাবা ছিলেন রাজা সপ্তম হেনরি। আর মা এলিজাবেথ অব।ইয়র্ক। ছোটবেলা থেকেই হেনরি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ধর্ম, সংগীত ও যুক্তিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেই সাথে তিনি ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি, ল্যাটিন ও স্পেনিশ ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন।
হেনরি ছিলেন তার বাবার তৃতীয় সন্তান। সে হিসেবে হেনরির ইংল্যান্ডের রাজা হবার সম্ভাবনাই ছিলো না। তার বড় ভাই আর্থার ছিলেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। আর্থারের হঠাৎ মৃত্যু হলে হেনরির রাজা হবার পথ সহজ হয়ে যায়। আর্থারের স্ত্রী ছিলেন ক্যাথারিন অফ আর্গন। তিনি ছিলেন স্পেনের রাজা রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও রানী ইসাবেলের কণ্যা। বিয়ের সময় আর্থারের বিয়ে উপলক্ষে রাজা সপ্তম হেনরি প্রচুর উপঢৌকন গ্রহণ করেছিলেন। এখন তার মৃত পুত্রের স্ত্রীকে ফেরত দিতে গেলে সেই বিশাল পরিমাণ অর্থ ও সম্পত্তির উপঢৌকনগুলোও ফেরৎ দিতে হবে। যা এখন ফেরত দেওয়া অর্থ সংকটে থাকা সপ্তম হেনরির পক্ষে অসম্ভব। আর তাই তিনি তার ছেলে অষ্টম হেনরির সাথে আর্থারের স্ত্রী ক্যাথারিন অফ আর্গনের বিবাহ দিয়ে দেন।
২১ এপ্রিল, ১৫০৯ সালে রাজা সপ্তম হেনরির মৃত্যু হলে মাত্র ১৭ বছর বয়সে অষ্টম হেনরির ইংল্যান্ডের রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহন করেন। হেনরি তার শাসনের শুরু দিকে ছিলেন বেশ উদার ও প্রজাপ্রেমী একজন রাজা। শুরুর দিকেই তিনি ইংল্যান্ডের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দেন। হেনরির প্রথম দিককার শাসন জনসাধারণের কাছে বেশ প্রশংসিত ছিলো।
রাজা অষ্টম হেনরি যে বিষয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি সমালোচিত তার মধ্যে অন্যতম হলো তার ৬ টি বিয়ের ঘটনা। নিজের ভাইয়ের স্ত্রী ক্যাথারিন অফ আর্গন কে বিয়ে করার পর ১৫১৬ সালে হেনরি এক কণ্যা সন্তানের বাবা হন, তার নাম রাখা হয় মেরি। ইতিহাসের পাতায় যিনি ব্লাডি মেরি নামে স্বীকৃত। রাজ সিংহাসনে নিজের উত্তরসূরী হিসবে ছেলে সন্তানকে রাখতে না পারায় হেনরি বেশ চিন্তিত ছিলেন। কারণ ক্যাথরিন যেকজন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন সবাই জন্মের সময় বা জন্মের কিছুকাল পর অসুস্থ হয়ে অকালে মারা যেতো। সে সময়ে হেনরির সাথে প্রেম হয়ে যায় ক্যাথরিনেরই সখী অ্যান বোলিনের সাথে। প্রণয়ের এক পর্যায়ে অ্যান বোলিন গর্ভবতী হয়ে যান।
অ্যান বোলিনের গর্ভজাত সন্তান হয়তো ছেলে সন্তান হয়ে জন্ম নিতে পারে। আর তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক স্বীকৃতি, কারণ রাজতন্ত্রের আইনে কোনো অবৈধ সন্তান সিংহাসনে আরোহন করার অধিকার রাখে না। হেনরির এই দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ক্যাথলিক ধর্মের কঠিন আইন। কারণ ক্যাথলিক ধর্মমতে কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর অনুমতি ব্যাতিত দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবেন না। ইংল্যান্ডের আর্চ-বিশপরা হেনরির দ্বিতীয় বিবাহ ও অনাগত সন্তানকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে।
সেই সময় পুরো ইউরোপ জুড়ে জার্মান ধর্মযাজক মার্টিন লুথারের প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি ক্যাথলিক ধর্মগুরু ও তাদের দূর্নীতি সম্পর্কে জনসাধারণ কে জানাতে শুরু করলে খ্রিস্টান ধর্মের নতুন এই সংস্করণের উদ্ভব ঘটে। রাজা হেনরি নিজেও ছিলেন একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। তিনি তার দ্বিতীয় বিবাহের বৈধতার জন্য প্রোটেস্টেন্ট মতবাদ গ্রহণ করেন। এরপর হেনরি ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর্চ-বিশপকে চার্চ থেকে বের করে দেন এবং নিজেই চার্চ অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে ইংল্যান্ডে প্রোটেস্টেন্ট মতবাদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। বর্তমানে ইংল্যান্ড একটি প্রোটেস্টেন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ শুধুমাত্র অষ্টম হেনরির এই পদক্ষেপের কারণে।
নতুন চার্চ প্রতিষ্ঠার পর হেনরি নিজের পছন্দের আর্চ-বিশপদেরকে নিয়োগ দেন। তাদের কাছে তিনি তার দ্বিতীয় বিবাহের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন,
বাইবেলে কেনানের আইন অনুসারে, কোনো ভাই তার নিজের ভাইয়ের স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবে না। অর্থাৎ হেনরির বর্তমান স্ত্রী ক্যাথরিন ও সন্তান অবৈধ। হেনরির দ্বিতীয় বিবাহ করতে কোনো ধর্মীয় বাঁধা নেই। এর মাধ্যমে ক্যাথারিন অফ আর্গনের সাথে হেনরির ২৪ বছরের জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিন কে ত্যাগ করার পর ১৫৩৩ সালে হেনরি অ্যান বোলিনকে বিবাহ করেন। সেই বছরই তাদের কণ্যা সন্তান এলিজাবেথের জন্ম হয়। আর সেই কন্যা সন্তানটিই ইংল্যান্ডের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ রাণী প্রথম এলিজাবেথ। কিন্তু বেশিদিন না যেতেই হেনরি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মৃত্যুদন্ড দেয়। তার বিরুদ্ধে হেনরির সাথে ধোঁকা ও পরোকিয়ার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে বলা হয় অ্যান ৫ জন পুরুষের সাথে সম্পর্কে জরিয়েছেন। ১৯ মে, ১৫৩৬ সালে অ্যানকে শিরশ্ছেদ করবার মাধ্যমে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন অ্যানকে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে হেনরির পুত্র সন্তান লাভ করতে না পারার হতাশা ও এতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
অ্যান বোলিনের মৃত্যুর পর, একই বছরে ১৫৩৬ সালে হেনরি তৃতীয় বিাবহ করেন জেন সেমুরকে। এই বিবাহের মাধ্যমে হেনরি তার প্রথম পুত্রসন্তান এডওয়ার্ড ষষ্ঠের জন্ম হয়। কিন্তু বিয়ের ১ বছরের মাথায় ১৫৩৭ সাথে প্রসববেদনায় তার মৃত্যু ঘটে। তার এই স্ত্রীর মৃত্যুতে হেনরি কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে পুত্র সন্তান লাভের পরেও হেনরির বিয়ে করবার ইচ্ছে চলে যায় নি।
১৫৪০ সালে হেনরি অ্যান অব ক্লিভস কে বিয়ে করেন। কিন্তু এই বিয়ে ছিলো একদমই ক্ষণস্থায়ী। হেনরি তার চতুর্থ স্ত্রীকে অপরিপক্ক ও আকর্ষণীয় নারী নয় বলে মনে করতেন। তার এই বিয়ে স্থায়ী হয়েছিলো কয়েক মাস মাত্র। ক্লিভসের সাথে বিচ্ছেদের পরের দিনই হেনরি তার পঞ্চম বিবাহ করেন ক্যাথরিন হাওয়ার্ডকে। এই বিয়ের সময় হেনরির বয়স ছিলো ৫০ বছর অন্যদিকে ক্যাথরিন হাওয়ার্ডের মাত্র ১৬ থেকে ১৭ বছর। বয়স ও শারিরীক সমস্যার কারনে তাদের এই বিয়েও সুখের ছিলো না৷ হেনরির এই স্ত্রীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিলো। তার সম্পর্কে করা অভিযোগে বলা হয়, বিবাহের পূর্বে সে ফ্রান্সিস ডেরেহ্যাম নামক একজন প্রাক্তন পরিচারকের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো। আরেকটি অভিযোগ ছিলো হেনরির সথে বিয়ের পর সে হেনরির রাজদরবারের সদস্য থমাস কালপেপারের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করা হয় ১৫৪২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী শিরশ্ছেদ করে মৃত্যু কার্যকর করা হয়।
হেনরির ষষ্ঠ ও সর্বশেষ স্ত্রী ছিলেন ক্যাথরিন পার। ১৫৪৩ সালে তিনি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। হেনরি তার এই বিবাহের মাধ্যমে জীবনে শান্তি ফিরে পান। ইতিহাসবিদদের মতেও তাদের এই বিয়ে প্রেমময় ছিলো এবং হেনরির জীবনে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিলো। এতোগুলো বিয়ে করবার পরেও হেনরি মাত্র ৩ সন্তানের পিতা হতে পেরেছে তারা হলেন মেরি, এলিজাবেথ ও এডওয়ার্ড।
রাজা অষ্টম হেনরি তার শাসনের প্রথম দিকে শাসক হিসেবে ভালো হলেও। ধীরে ধীরে তিনি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়ে উঠেন। তিনি তার প্রথম স্ত্রী ক্যাথারিন অফ আর্গনের মৃত্যুর পর খুশিতে উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। নিজের একাধিক স্ত্রীকে পরকীয়ার অভিয়োগে হত্যা করেছেন। ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হেনরি তার নিকট আত্মীয় ও উপদেষ্টাদেরকেও মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন। এছাড়াও সেসময়কার বিখ্যাত লেখক টমাস মুর হেনরির রাজকোষের অতিরিক্ত অর্থ ব্যায়ের সমালোচনা করলে তাকেও তিনি মৃত্যুদন্ড দেন।
হেনরির এমন নিষ্ঠুরতার পেছনে মনে করা হয় হেনরির স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাকে। তরুণ বয়সে হেনরি ছিলেন শক্তিশালী ও চমৎকার শারিরীক গঠনের অধিকারী। তিনি টেনিস, খেলা,ঘোড়ার রেস ও শিকারে বেশ পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু ১৫৩৬ সালে এক ঘোড়া দূর্ঘটনায় আহত হয়ে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তিনি তার পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন, ফলে পরবর্তীতে তার চলাফেরা করা কষ্টকর হয়ে পরে। মনে করা হয় দূর্ঘটনায় তার পাওয়া যন্ত্রণা তার বাকি জীবন বয়ে চলতে হয়েছে। এই কষ্টই হয়তো তাকে নিষ্ঠুর হতে প্রভাবিত করেছে।
দূর্ঘটনার পর হেনরির শরীর স্থুল হতে শুরু করে। জীবনের শেষদিকে তার শরীরের ওজন ভয়ানক বেড়ে গিয়েছিলো। তার কোমড়ের মাপ ৫৪ ইঞ্চিতে পৌঁছায় আর ওজন ছিলো প্রায় ৩০০ পাউন্ড। অতিরিক্ত স্হুলতার কারনে তিনি ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো বিভিন্ন রকম শারিরীক জটিলতায় ভুগছিলেন। ১৫৪৭ সালে রাজা অষ্টম হেনরির মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যু ঘটে।