জোসেফ স্তালিনের নাম শুনেনছেন নিশ্চয়ই? সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়ার) আলোচিত-সমালোচিত এই নেতা ১৯২২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের এই সময়ে স্তালিনের নেতৃত্বে প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদ ‘স্তালিনবাদ’ নামে পরিচিত। শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সচিব হিসাবে স্তালিনের ক্ষমতা সীমিত থাকলেও ধীরে ধীরে স্তালিন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে নেন এবং দলের নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।
সোভিয়েত এই রাজনীতিবিদ ও তার শাসনকাল নিয়ে রয়েছে নানান কৌতুক ও রসিকতা। আমরা সেসব বিষয় নিয়ে আজ কিছু বলছি না। স্তালিনের জীবনে রয়েছে নানান অদ্ভুত ও আশ্চর্য বিষয়ও, যা আপনি সচরাচর পড়বেন না। চলুন, আজ পড়ে ফেলা যাক স্তালিনের জীবনের এমনই আশ্চর্য কয়েকটি ঘটনা।
করুণ শৈশব
চাষী ও মুচির সন্তান স্তালিনের শৈশব সুখকর ছিলো না। স্তালিনের শৈশবেই তার বাবা স্তালিনের পরিবারকে ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। স্টালিনের তিন ভাই-বোন অল্প বয়সেই মারা যান। স্তালিনের জর্জিয়ান ভাষার কারণে স্কুলে শিক্ষক ও সহপাঠীদের দ্বারা বুলিয়িংয়ের শিকার হয়েছেন। বাবা তাকে ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিনের মাথায় জলবসন্তে আক্রান্ত হন স্তালিন। সেই জলবসন্তের দাগ আমৃত্যু স্তালিনের শরীরে ছিলো।
অসম্ভব ডানপিটে হলেও স্তালিন স্কুলে ভালো ছাত্রদের একজন ছিলো
১৪ বছর বয়সে, স্তালিন ছিল ক্লাসের ফার্স্ট বয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য স্কলারশিপও পেয়েছিলো। তার মানে এই নয় যে পড়াশোনা তাকে ঝামেলামুক্ত রেখেছিল। তার এক সহপাঠী স্মৃতিচারনায় লিখেছেন, ‘স্তালিন পড়াশোনায় যেমন সেরা, এবং বদমাশদেরও সেরা।
জীবনীকারদের বয়ানে জানা যায়, বন্ধুদের নিয়ে স্তালিন গড়ে তুলেছিল এক শক্তিশালী গ্যাং এবং এক পর্যায়ে একটা দোকানে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।
নিষ্ঠুর অ্যালকোহলিক বাবা
অকালে তাকে ও তার পরিবারকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা যতটা হৃদয়বিদারক মনে হতে পারে, ততটাও ছিলো না। কারণ স্তালিনের বাবা ভিসারিয়ন ছিলেন একজন অ্যালকোহলিক। মাতাল হয়ে প্রায়ই স্তালিন ও তার মাকে পেটাতেন ভিসারিয়ন।
স্তালিনের শৈশবের এক বন্ধু লিখেছেন, বাবার নিষ্ঠুর বেত্রাঘাতে নিয়মিত ক্ষতবিক্ষত হতো কিশোর স্তালিনের শরীর, যা বালক স্তালিনকেও করে তুলেছিলো বাবার মতো নির্দয় আর কঠিন।
স্তালিন বেশ ভালোমানের একজন কবি ছিলেন
অত্যন্ত পড়ুয়া ছিলেন স্তালিন। সেমিনারিতে থাকাকালীন নিয়মিত গ্যেটে, শেকসপিয়র আর ওয়াল্ট হুইটম্যান পড়তেন তিনি। স্কুলে থাকতেই কবিতা লেখার শুরু হয় তার। জর্জিয়ান ভাষায় লেখা তার ৫টি কবিতা কবি ইলিয়া চাভচাভাদজে সম্পাদিত জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা ইভেরিয়া-তে প্রকাশিত হয়।
পিতার সঙ্গে পুনরায় দেখা
১২ বছর বয়সে ঘোড়ায় টানা গাড়ির নিচে পড়ে আহত হয় স্তালিন। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, তাকে হাসপাতাল থেকে কিডন্যাপ করা হয় আর কিডন্যাপ করে তারই বাবা ভিসারিয়ন।
জীবনীকার রবার্ট সার্ভিস-এর মতে, স্তালিনের বাবা চামড়ার ফ্যাক্টরিতে স্তালিনকে কাজ করতে বাধ্য করে। যদিও কিছুদিনের মধ্যে স্তালিন ফ্যাক্টরি থেকে পালিয়ে আসেন। সার্ভিস লিখেছেন, ‘পুজিবাদের অভিজ্ঞতা স্তালিনের খুব অল্প বয়সেই হয়, যা ছিলো কঠিন, রুঢ় এবং অমানবিক।’
বেশ খর্বকায় লোক ছিলেন স্তালিন
১৯০২ সালে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ এক লোককে গ্রেফতার করে। লোকটার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে:
৫ ফিট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা। দেহ মাঝারি সাইজের। বয়স ২৩। স্পেশাল ফিচার: বাম পায়ের ২য় ও ৩য় আঙুল একটার সঙ্গে অন্যটি লাগানো। চেহারা: সাধারণ। চুল কালচে বাদামি। দাড়িগোঁফ: বাদামি। খাড়া দীর্ঘ নাক। সোজা কিন্তু সংক্ষিপ্ত কপাল। মুখমন্ডল দীর্ঘাকার এবং এখানে সেখানে জলবসন্তের দাগ।
সেমিনারি থেকে বহিষ্কার
সেমিনারি হলো ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। যাজক হওয়ার ইচ্ছা থেকে স্তালিন সেমিনারিতে ভর্তি হননি, মাকে খুশি করার জন্যেও না। তিনি সেমিনারিতে হয়েছিলেন কারণ অন্য কোথাও তার উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিলো না। জীবনীকারদের মতে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টাতেই মার্ক্সিজম ও এথিজমের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। স্তালিন তার ‘বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য’ সেমিনারি থেকে বহিষ্কৃত হন। অবশ্য স্তালিনের মায়ের দাবি, স্তালিন সেমিনারি ছেড়েছেন তার দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে।
স্তালিনের ব্যক্তিগত জীবন ছিলো ট্রাজেডিতে পূর্ণ
১৯০৩ সালে বিয়ে করেন ‘একাতেরিনা সভানিদজে’ নামের এক নারীকে। চার বছরের মাথায় তাকে একা ফেলে একাতেরিনা মারা যায়। স্তালিনের বন্ধুদের সাক্ষ্য অনুযায়ী, একাতেরিনার সঙ্গে স্তালিনের সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিলো না। একাতেরিনার গর্ভে জন্মানো ছেলে ইয়াকভ দঝুগাশভিলিকেও স্তালিন পছন্দ করতেন না। রবার্ট সার্ভিসের মতে, বাবার এই দুর্ব্যবহারের কারণে এক পর্যায়ে ইয়াকভ আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন।
স্তালিনের ছেলের মৃত্যু হয় স্তালিনের জ্ঞাতসারেই!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্তালিনের ছেলে ইয়াকভ রেড আর্মিতে যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জার্মানরা ইয়াকভকে গ্রেফতার হন। জার্মানরা একজন হাই-র্যাংকিং অফিসারের বিনিময়ে ইয়াকভের মুক্তির প্রস্তাব দেয়।
কোনো ঐতিহাসিকের মতে, স্তালিন বলেন, ‘একজন লেফটেন্যান্ট একজন জেনারেলের সমান নয়।’ অন্যদের দাবি, স্তালিন বলেন ‘আমার কোনো ছেলে নাই।’
সত্যি যেটাই হোক না কেন এটা নিশ্চিত যে, স্তালিন অফারটা ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং ইয়াকভকে শেষমেশ জার্মানরা হত্যা করে।
দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা
স্তালিন দ্বিতীয় বিয়ে করেন নাদেঝদা ‘নাদিয়া’ আলিইলুয়েভা স্টালিনাকে। নাদিয়া আত্মহত্যা করেন। অনেকের দাবি নাদিয়ার আত্মহত্যার কারণ মূলত স্তালিনের খারাপ ব্যবহার।
স্তালিন তার আসল নাম নয়
তার নামের শেষ অংশ আসলে স্তালিন ছিলো না। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিলো, জোসেফ বেসারিওনিস দজে জুঘাশভিলি। ১৯১২ সালের দিকে তিনি তার নামের শেষ অংশ বদলে রাখেন, স্তালিন, যার অর্থ ‘ইস্পাতমানব।’ ইন ফ্যাক্ট, তার নিজেকে দেয়া অনেকগুলো নামের একটা স্তালিন। তার বাবা-মা তাকে ডাকতো ‘সোসো’, সেটা জোসেফের জর্জিয়ান ডাকনাম। স্কুলে থাকতে নিজেকে বলতেন ‘কোবা’ নামে। ১৮৮৩ সালের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘পিতৃহন্তারক’ –এর রবিনহুড ধরনের একটা চরিত্রের নাম কোবা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্তালিন অফিশিয়ালদের বার্তা পাঠাতেন ‘দ্রুঝকভ’ নামে।
স্তালিন ছিলেন সেকালের ‘ফটোশপ’ এক্সপার্ট
স্তালিন জানতেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইমেজ নানা কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইমেজের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন স্তালিন। ফটোশপ যুগ দেখে যাননি বটে, কিন্তু ফটো ম্যানিপুলেশনের দারুণ ওস্তাদ ছিলেন স্তালিন। সোভিয়েত ন্যারেটিভের বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ছবিতেও অদল-বদল আনেন স্টালিন। একসময়ের ঘনিষ্ঠ কিন্তু পরবর্তীতে বিরাগভাজন হয়েছেন এমন অনেককে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন স্তালিন। এই লোকদের সঙ্গে স্টালিনের ছবিগুলোকে প্রায়ই বদলে ফেলেছেন স্তালিন।
জীবনের শেষ দিকে স্তালিনকে অপছন্দ করতেন লেনিন
যদিও লেনিনের কাজ ও চিন্তা দিয়ে অনেক বেশি প্রভাবিত ছিলেন স্তালিন, বৃদ্ধ লেনিন স্তালিনকে পছন্দ করতেন না। লেনিন বরং আতঙ্কিত ছিলেন বলশেভিক পার্টিতে স্টালিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও জনপ্রিয়তা নিয়ে। জীবনের শেষ কয়েক দিন আগেও লেনিন স্টালিনকে উল্লেখ করেছেন, ‘নিষ্ঠুর, প্রতারক, ধূর্ত’ হিসেবে। লেনিনের চাওয়া ছিলো, স্তালিনকে দল থেকে বের করে দেয়া হোক। লেনিনের সেই ইচ্ছা স্বাভাবিকভাবেই বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, ততদিনে স্তালিন নিজেকে বলশেভিক পার্টির সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতায় পরিণত করে ফেলেছেন।
স্তালিনের জীবনের অজানা অধ্যায়গুলো জানা হলো। ধন্যবাদ।