You are currently viewing জেন আয়ার: আত্মবিশ্বাস ও সংগ্রামের গল্প

জেন আয়ার: আত্মবিশ্বাস ও সংগ্রামের গল্প

জেন আয়ার উপন্যাসটি ভিক্টোরিয়ান যুগের সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। যা শুধু ভিক্টোরিয়ান যুগের সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করে নি, সেই সাথে আধুনিক সাহিত্যের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। যেখানে জেন আয়ার চরিত্র তুলে ধরেছে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য, নারীর প্রতি সমাজের বৈষম্য ও কট্টরপন্থী গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের ভন্ডামি ও সমাজের বাস্তব চিত্র। 

লেখিকা শার্লট ব্রন্টির কালজয়ী উপন্যাস ‘জেন আয়ার’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ সালে। প্রকাশের সময় উপন্যাসের নাম ছিলো Jane Eyre: An Autobiography, বইটি প্রকাশের সময় শার্লট ব্রন্টি ‘কারর বেল’ ছদ্মনামে প্রকাশ করেছিলেন। উপন্যাস চরিত্র ও প্লট হিসেবে তিনি তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে গল্প সাজিয়েছেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের এই উপন্যাসটিতে তিনি তুলে ধরেছেন নারীর ব্যক্তিসচেতনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ভালোবাসা, নৈতিকতা ও সামাজিক প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে স্রোতের বিপরীতে চলা এক নারীর জীবনকে।

শার্লট ব্রন্টি Image Source : Stock Montage/Getty Images

জেন আয়ার উপন্যাসটির গল্প শুরু হয় যখন জেন আয়ার নামের একটি ১০ বছরের অনাথ মেয়েকে নিয়ে। জেনের বাবা-মা দুজনেই সে ছোট থাকতে টাইফাসে মারা যায়। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তার মামা মি. রিড তাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু মামার মৃত্যুর পর তার মামী মিসেস রিড তার সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ, সেই সাথে তাকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন। জেন আয়ারের কাজিনরাও তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করতো। জেনকে আঘাত করে, কষ্ট দিয়ে তারা মজা পেতো। পুরো বাড়িতে শুধুমাত্র কাজের লোক বিসি তার প্রতি কিছুটা সদয় ছিলো।

জেনকে বাড়ি থেকে দূরে সারাতে তার মামি মিসেস রিড তাকে ৫০ মাইল দূরে লোউড ইনস্টিটিউশন (Lowood Institution) নামে অনাথ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এই স্কুলে এতিম মেয়েদের কঠোর পরিবেশে রেখে শিক্ষাদান করা হতো। লোউড নামটিই সেই অবস্থা ও পরিবেশের অর্থ বহন করে। 

লোউডে আসার পর জেন আয়ার শারীরিক ও মানসিকভাবে কষ্ট ও নিপীড়নের শিকার হতে থাকে। তবে এখানেই তিনি তার জীবনের একমাত্র বন্ধুর স্বাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, তিনি হেলেন বার্নাস। হেলেন বার্নাস জেনে আয়ারের মতোই এক অনাথ মেয়ে সে জেন আয়ারেরই সমবয়সী। টাইফাসে অসুস্থ হয়ে হেলেনের মৃত্যু হলে; তা পরবর্তীতে জেন আয়ারের পরবর্তী জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেন আয়ার শিক্ষার্থী থেকে লোউডের শিক্ষিকার পদ লাভ করেন। দুই বছর সেখানে শিক্ষকতা করার পর জেন আয়ার লোউড ছাড়েন। এর পেছনে অন্যতম কারন ছিলো তার প্রিয় শিক্ষিকা মিস টেম্পেলের বিবাহ করে লোউড ত্যাগ করা। লোউড ছেড়ে স্বাধীনচেতা জেন আয়ার জীবনে নতুন অ্যাাডভেঞ্চারের জন্য গৃহশিক্ষিকা হিসবে কাজ করতে পাড়ি জমান থার্নফিল্ডে।

থর্নফিল্ডে জেন আয়ারের নতুন জীবনের শুরু হয়। থর্নফিল্ডে জেন আয়ার অ্যাডেল নামের এক ফরাসি মেয়ের শিক্ষিকা হিসেবে নিজের পেশা শুরু করেন। অ্যাডেলমেয়েটি ছিলো একজন ফরাসি নৃত্যশিল্পরীর মেয়ে, যিনি জেন আয়ারের নতুন কর্মস্থলের মালিক এডওয়ার্ড রচেস্টারের পূর্বে প্রণয়িনী ছিলেন। রচেস্টার কিছুটা রহস্যময় ও বিদ্রোহী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে এই রচেস্টারের সাথে জেন আয়ার এক রহস্যময় জটিল ও গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এছাড়াও সেই বাড়ির দয়ালু গৃহকর্ত্রী মিসেস অ্যালিস ফেয়ারফ্যাক্সের সাথেও জেন আয়ারের সখ্যতা হয়।

জেন আয়ার রচেস্টারের প্রেমে পড়েন; কিন্তু তিনি তা রচেস্টারকে প্রকাশ করেন না। রচেস্টারের সাথে ব্লাঞ্চ ইনগ্রাম নামের এক সম্ভ্রান্ত ধনী ও সুন্দরী নারীর বিয়ে কথা ভাবা হচ্ছিল। রচেস্টার সেই বিয়ের সম্ভাবনা ভেঙে দেন। তিনি জেন আয়ারকে নিজের অনুভূতির কথা জানান। জেন কে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিয়ের দিন জেন আয়ার জানতে পারেন রচেস্টার একজন বিবাহিত পুরুষ। তাই আইগত কারনে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারবেন না৷ রচেস্টারের বিবাহিত স্ত্রী বার্থা ম্যাসন এখনও জীবিত। তিনি রচেস্টারের বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন। বার্থা ছিলো পাগল ও উম্মাদ এক নারী। জেন আয়ার এতোদিন রাতের বেলা মাঝেমধ্যে উপর থেকে যেসব অদ্ভুত আওয়াজ শুনতেন সবই ছিলো রচেস্টারের স্ত্রী বার্থার আওয়াজ।

রচেস্টার জেন আয়ারকে বলেন যে বার্থার সাথে তাকে প্রতারণা করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তাই জেন আয়ারের সাথে নিজের বিয়ে সম্পন্ন করতে রচেস্টার জেনকে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে, যেখানে তারা আইনসিদ্ধ না হলেও স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতে পারে। কিন্তু নীতিগত কারণে জেন রচেস্টারের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং থর্নফিল্ড ছেড়ে চলে যায়।

থর্নফিল্ড ছেড়ে চলে আসার পর জেন আয়ারের জীবনের নতুন আরেক অধ্যায়ের শুরু হয়। নতুন এই পথ চলায় জেন এমন এক পরিবারে আশ্রয় পায়, যারা তার চাচাতো ভাইবোন বলে সে পরবর্তীতে জানতে পারে। জেনকে পাদ্রি সেন্ট জন বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সম্পর্কে তিনি জেনের চাচাতো ভাই। সে জেনকে বলে তারা দুজনে একসাথে ভারতে যাবেন; সেখানে খ্রীস্ট ধর্মের প্রচার করার কথা বলেন। কিন্তু জেন সেই প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। নিজের জীবন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত জেন সৃষ্টি কর্তার কাজে সাহায্য পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। তখন তিনি রচেস্টারে কন্ঠস্বর শুনতে পান।

রচেস্টারের সাথে পুনরায় মিলিত হতে, জেন থর্নফিল্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে গিয়ে দেখতে পান রচেস্টারে স্ত্রী বার্থা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে ফেলেছে। সেই সাথে নিজেও আগুনে ঝাপিয়ে পুড়ে মরেছে। আগুনে রচেস্টারের শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গিয়েছে এবং সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আগুনে পুড়ে রচেস্টার তার জৌলুশ ও ধনসম্পদ পুরোটাই হারিয়েছেন। এখন সে সহায়সম্বলহীন এক মানুষ।  যিনি বন জঙ্গলে ঘেড়া একটি ছোট বাড়িতে বাস করেন। জেন রচেস্টারের সাথে মিলিত হয়। সে রচেস্টারকে বিবাহ করে তাদের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। বিবাহের পর রচেস্টার তার কিছুটা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। 

জেন আয়ার উপন্যাসে শার্লট ব্রন্টি নিজেকেই জেন আয়ার রূপে উপস্থাপন করেছেন। চার্লট ব্রন্টে নিজেও এতিম হয়ে নিজের এক আন্টির কাছে বড় হয়েছিলেন। পড়াশোনা করেছেন ‘কওয়ান ব্রিজ স্কুলে’ যেখানে ছিলো অমানবিক ও স্বাস্থহীন এক পরিবেশ। আর সেই পরিবশটাই তিনি লোউডে তুলে ধরেছেন। পেশা হিসবে নিজেও ছিলেন একজন শিক্ষিকা ও গভর্নেস। এই উপন্যাসটি প্রকাশ হবার পর অনেকেই এটিকে ক্যাথলিক বিরোধী বলে অভিযোগ করেছিলেন। তবে সেসকল অভিযোগ এই উপন্যাস পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হবার কেনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি।

জেন আয়ার উপন্যাসের গথিক শিল্পের উপাদান বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। উপন্যাসের বিভিন্ন সময়ই ভয়ের দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে। ছোটবেলায় জেনের ভূত দেখা, থর্নফিল্ডের বাড়িতে অদ্ভুত সব আওয়াজ, বার্থার আক্রমণ ও শেষে আগুনে পুড়ে বার্থার মৃত্যু সবকিছুই গথিক বৈশিষ্ট্যের অংশ।

Leave a Reply