স্যার আইজ্যাক নিউটন একজন প্রখ্যাত ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক এবং আলকেমিস্ট। অনেকের মতে, নিউটন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী। নিউটন ১৬৬৫ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল, এই দুইবছর ইংল্যান্ডে মহামারী প্লেগের আক্রমণের কারণে জনসাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নিজের ঘরে আইসোলোশনে ছিলেন।
প্লেগ অর্থাৎ বুবোনিক প্লেগ ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ রোগ গুলোর একটি, যা ‘ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস’ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট যা মূলত বুবোনিক সংক্রমণের কারণ হয়, তাই এই নাম।
এই বুবোনিক প্লেগ ১৩৪৭ সাল থেকে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত ‘ব্ল্যাক ডেথ মহামারী’ এবং ৫৪১ সাল থেকে ৫৪৯ সালে ‘প্লেগ অফ জাস্টিনিয়ানের’ মতো বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারী সৃষ্টি করেছিল।
নিউটনের সময়ে (১৬৬৫-১৬৬৬) সালে ইংল্যান্ডে প্লেগ রোগ আঘাত হানার পর, ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ লোক নিজেদের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ রাখতো। আর যদি কোনো বাড়িতে কোনো ব্যাক্তি প্লেগ রোগের সংক্রমণের শিকার হতো তাদের বাড়ির দরজায় লাল রঙের ক্রস এঁকে দেওয়া হতো।
দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই মহামারীতে নিউটন তার মহামূল্যবান সময়ের অপচয় করেন নি। এই সময়টায় তিনি সবসময় বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলেন। সেই সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ থিওরি ও সৃষ্টি করেছিলেন। এসবের সাথে তিনি একটি ভিন্ন ধরনের গবেষণা ও করেছিলেন। তিনি জানার চেষ্টা করছিল অতীতের পন্ডিত ব্যক্তিরা বুবোনিক প্লেগ সম্পর্কে কি তথ্য দিয়ে গেছেন!
নিউটনের গবেষণা
গভেষণার জন্য নিউটন প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রের পাশাপাশি, তিনি ‘জান ব্যাপ্টিস্ট ভ্যান হেলমন্টের’ (১৫৮০-১৬৪৪) লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠেন। জান ব্যাপ্টিস্ট ভ্যান হেলমন্ট ১৬০৫ সালের বুবোনিক প্লেগের কারণে সৃষ্ট মহামারীর মধ্যে জীবনযাপন করেছিলেন। সেই সময়ের মহামারীর অবস্থা নিয়ে তিনি নিজের ডায়েরিতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে রেকর্ড করেছিলেন, যেটিকে পরবর্তীতে বইয়ে রূপ দিয়ে নাম দেওয়া হয় ‘De Peste’ নামে। মহামারীর অবস্থা ছাড়াও তিনি যে মহামারী নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ছিলেন। সেসবয় নিয়ে লেখা ছিল।
এই বইটি নিউটনের মধ্যে বুবোনিক প্লেগের কারণ, কিভাবে ব্যাকটেরিয়া এক জীব থেকে অন্য জীবে সঞ্চারিত হয়, সেইসাথে সম্ভাব্য নিরাময় যা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে সেগুলি সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা তৈরি করেছিলেন।
ভ্যান হেলমন্টের বইতে, তিনি প্লেগ রোগের উপসর্গগুলির একটি তালিকাও খুঁজে পেয়েছেন যা দেখায় যে প্লেগ কখন একটি নতুন পর্যায়ে বিকশিত হয় (পরিবর্তন) এবং এটিতে সংক্রামিত হওয়া থেকে এড়ানোর উপায়গুলি ও উল্লেখ ছিলো।
নিউটন ১৬০৫ সালের আগেও ঘটে যাওয়া বুবোনিক প্লেগ মহামারী থেকে আরো কিছু মেডিকেল রেকর্ড এর তথ্য সম্পর্কে গবেষণা করেন। তিনি বুঝার চেষ্টা করছিলেন সেসময়ের সাধারণ মানুষজন এই রোগের প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল এবং তা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
এই তথ্যের উপর বিশ্লেষণ করে নিউটন ১৬৬৫ -১৬৬৬ সালের মহামারী সম্পর্কে একটি নোট তৈরি করেছিলেন। সম্প্রতি পাওয়া নতুন, অপ্রকাশিত নোটগুলিতে রেকর্ড করা হয়েছে — নোটগুলো আইজ্যাক নিউটন নিজেই লিখেছেন — তবে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কখনই তার অনুসন্ধানগুলিকে গ্রহণ করেনি।
প্লেগের বিরুদ্ধে নিউটনের নিরাময় ঔষধ
নিউটন তার বিচ্ছিন্নতার সময় যে সমস্ত গবেষণা করেছিলেন তার উপর ভিত্তি করে, তিনি একটি নিরাময়ের একটি খুব উদ্ভট উপায় বের করেছিলেন। (বলে রাখা ভালো ভালো আপনি যেনো এই কখনো এই পদ্ধতির চেষ্টা না চালান। এতে আপনার পেট কিছুটা অসুস্থ হয়ে উঠতে পারে।)
এই নিরাময় ঔষধ তৈরি করার জন্য প্রথমে একটি জীবন্ত ব্যাঙকে উল্টো করে চিমনির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হতো, যতক্ষণ না ব্যাঙটি বমি করে। ব্যাঙটির বমি একটি পাত্রে সংরক্ষণ করা হতো। ব্যাঙটির বমি নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর তা হুলদ মোমের সাথে মিশ্রিত করা হয় এবং ব্যাঙটিকে একটি পাতলা পাউডারে পিষে দেওয়া হয় যা বমি থেকে তৈরি “লজেঞ্জ” এর সাথে মিশ্রিত হবে। এই সিরাম শরীরের প্রভাবিত প্লেগ এলাকায় প্রয়োগ করা হবে। আর অল্প সময়ের মধ্যে, বুবোনিক প্লেগ ফোঁড়ার উপর লাগিয়ে দিলে প্লেগ হওয়া অঞ্চল থেকে প্লেগ রোগের বিষ বেরিয়ে আসবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে।
নিউটনের আবিষ্কৃত এই পথ্য সেসৃয় সত্যিই কাজ করেছিলো কিনা তার সঠিক কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে ১৬/১৭ শতকে এই ধরনের নিরাময় পদ্ধতি সাধারণ বিষয় ছিলো। যেহেতু এই রোগের কোনে নিরাময় তখন আবিষ্কার হয়নি তখন এই পদ্ধতি কমবেশি সবাই ব্যবহার করতো।
এখন আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত হলেও বহু মানুষের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে কুসংস্কার রয়ে গেছে। এই করোণা মহামারীতেই দেখা গেছে, মানুষজন তাবিজ, পানি পড়া থেকে শুরু করে ধনেপাতা ও ব্যবহার করেছেন।
অনেক ইতিহাসবিদগণই নিউটনের এমন অদ্ভুত নিরাময় পদ্ধতির ব্যাপারে সমালোচনা করেন। অবশ্য সমালোচনা করতেই পারেন নিউটনের চিকিৎসা বিদ্যায় পাণ্ডিত্য কখনোই দেখা যায় নি। নিউটনের এই গভেষণা নিয়ে গুজব রয়েছে যে এই গবেষণার সময় নিউটনের একটি ছোট কুকুর আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।