রাজা ও সম্রাটদের কথা ভাবলেই আমাদের মাথায় আসে তাদের হাতে থাকা বিশাল ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের কথা। তবে রাজা বা সম্রাট হয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকে থাকার সহজ ব্যাপার নয়! রাজার পেছনে তার সিংহাসন দখলের জন্য সর্বদা চলতে থাকে কুৎসিত সব ষড়যন্ত্র।
রাজা বা সম্রাট হলেই যে জীবন সুখ আর আরাম- আয়েশে কেটে যাবে এমন ধারণা একদমই ভুল। এই লেখায় তেমনই কিছু রাজা ও সম্রাটদের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিব; যাদের জীবন ছিল অতি ভয়াবহ। ভাগ্য নামক অভিশাপ থেকে তারা বাঁচতে পারেননি।
সম্রাট ভিটেলিয়াস
ভিটেলিয়াস ছিলেন প্রাচীন রোমের সম্রাট। ৬৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র ৮ মাস তিনি রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। প্রাচীণ রোমের বিভিন্ন নথিপত্র পড়ে জানা যায় সম্রাট হিসেবে তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠুর ও বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ। সেই সাথে তিনি ছিলেন খুবই পেটুক এবং জিয়া খেলতে ভালোবাসতেন।
ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৩ মাসের মাথায় (জুলাই মাসে) রোমান সাম্রাজ্যের জুডিয়ার গভর্নর টাইটাস ফ্ল্যাভিয়াস ভেসপাসিয়ান তার সেনাবাহিনী নিয়ে রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে ফলে বেদরিয়াকামের যুদ্ধ সংগঠিত হয়।
ভিটেলিয়াস সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সিংহাসন ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। আর তাই ভেসপাসিয়ানাসের সেনাবাহিনী সম্রাটকে বন্দী করেন। এরপর রেমান সম্রাটের হাত বেঁধে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে ও অর্ধনগ্ন করে রাজধানীর সবচেয়ে জনবহুল চত্বরে ঘোরাতে থাকেন।
লোকজন তাদের সম্রাটের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে উপহাস ও গালিগালাজ করতে থাকে এবং তার দিকে উদ্দেশ্য করে গোবর ছুঁড়তে থাকে। এরপর বিভিন্ন পন্থায় তার উপর নির্যাতন করার পর সম্রাটকে টাইবার নদীর পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
ভিটেলিয়াস কে হত্যা করার পর ভেসপাসিয়ানস নতুন সম্রাট হিসবে রোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। সম্রাট হওয়ার পর ভেসপাসিয়ানস দীর্ঘ ১০ বছর রাজত্ব করেছিলেন।
ছত্রপতি শিবাজি
ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ১৬৮১ থেকে ১৬৮৯ সাল পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। তার শাসনমলের প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন। কিন্তু শেষমেষ তিনি সঙ্গমেশ্বর শহরে মুঘল সৈন্যদের হাতে বন্দী হন।
মুঘল সৈন্যরা শিবাজিকে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে নিয়ে যায়। সৈন্যরা শিবাজিকে সম্রাটের সামনে নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে বোকাদের মতো পোশাক পরতে বাধ্য করেছিল এবং একটি উটের সাথে বেঁধে রেখেছিল।
সম্রাট আওরঙ্গজেব শিবাজির প্রাণ বাঁচানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি শিবাজি তার অধীনে থাকা সকল দূর্গ ও তার লুকনো সব ধনসম্পত্তি হস্তান্তর করেন তবে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। এই প্রস্তাবের বিপরীতে শিবাজি আওরঙ্গজেবের মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেব কে উপহাস করেছিলেন।
এর পর সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শিবাজিকে কয়েক সপ্তাহ কঠোর নির্যাতন করা হয়। শিবাজীর চোখ অন্ধ করে ফেলা হয়, জিহ্বা কেটে ফেলা হয়। আরো বেশ কিছু শরীরের অঙ্গ কেটে কুকুরদের খেতে দেওয়া হয়। সবশেষে শিবাজিকে ভীমা নদীর পাশে তার শিরশ্ছেদ করে মৃত্যু দেওয়া হয়।
শিবাজির পর তার সৎ ভাই ছত্রপতি রাজারাম মারাঠা সাম্রাজ্যের রাজা হিসেবে শিবাজির স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিও তার রাজত্বের পুরোটা সময়জুড়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটিয়েছেন।
রুশ সম্রাট জার নিকোলাস দ্বিতীয়
জার দ্বিতীয় নিকোলাস ১৮৯৪ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সম্রাট ছিলেন। বলশেভিক বিপ্লবের পরে বিল্পবের সমর্থক (রেড আর্মি) ও রাজ শাসনের সমর্থকদের (হোয়াইট আর্মি) মধ্যে একটি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
এই সংঘাতের সময় রেড আর্মি জার নিকোলাস ও তার পরিবারের সকল সদস্যকে ইপেটিভ হাউস নামে পরিচিত ইয়েকাটেরিনবার্গের একটি বড় প্রাসাদে বন্দী করে। রেড আর্মি জার নিকেলাসের সকল সম্পত্তি দখল করে নেয়। তাদের সকলকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয় শুধু খাবার আর পানি ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি।
বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিন চিন্তিত ছিলেন যে হোয়াইট আর্মি যেকোনো সময় জার নিকেলাস কে উদ্ধার করে ফেলতে পারে। আর তাই তিনি তার লেকদের জার নিকোলাস ও তার পরিবারের লোকদের হত্যা করতে নির্দেশ দেন। হত্যার পূর্বে জার নিকেলাস ও তার পরিবারের সদস্যদের বাড়ির নিচের একটি ছোট্ট কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের বলা হয় যে বাহিরে যুদ্ধ হচ্ছে, তাই আপনাদের নিরাপত্তার জন্য ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ছোট্ট সেই কক্ষে প্রবেশ করার পর জার নিকোলাস, তার স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে রেড আর্মি গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও একমাত্র ছেলে সন্তানটির বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। তাদের সকলদের দেহ জঙ্গলে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুড়িয়ে ফেলার আগে তাদের সকলের চেহারে এসিড দিয়ে পুড়িয়ে বিকৃত করে ফেলা হয়েছিল।
জার নিকোলাস দ্বিতীয় ছিলেন রাশিয়ার শেষ সম্রাট। জারের মৃত্যুর পর রাশিয়া থেকে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে এবং এক নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্রাট প্রথম আন্দ্রোনিকোস
সম্রাট আন্দ্রোনিকোস ১১৮৩ সাল থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। কিশোর রাজা দ্বিতীয় অ্যালেক্সিওসকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে সকল ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। ক্ষমতায় বসেই তিনি সাম্রাজ্যের ভূমি মালিকদের ক্ষমতা সীমিত করার জন্য কঠোর সব নিয়ম চালু করেন।
নিজের অপছন্দের লোকেদের মৃত্যু দিতে থাকেন ফলে পুরো সাম্রাজ্য একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পুরো রাজ্যজুড়েই শুরু হয়েছিলো বিশৃঙ্খলার। আন্দ্রোনিকোস কে আইজ্যাক অ্যাঞ্জেলোস দ্বারা উৎখাত করা হয়েছিল, যিনি কমনেনোস পরিবারের একজন বর্ধিত সদস্য ছিলেন।
জীবন বাঁচাতে মরিয়া হয়ে কনস্টান্টিনোপল শহর থেকে পালাতে আন্দ্রোনিকোস তার স্ত্রী এবং উপপত্নীদের সাথে একটি জাহাজে উঠেছিলেন এবং কৃষ্ণ সাগর হয়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পালানোর আগেই তাকে আটক করে শহরে ফিরিয়ে আনা হয়।
এরপর আন্দ্রোনিকোস একটি ধীর ও ভয়কর মৃত্যু ভোগ কর। বেশ কয়েকদিন ধরে, শহরের জনতা আন্দ্রোনিকোসের শরীরকে টুকরো টুকরো করে বিকৃত করে। তারা তার চোখ বের করে, দাঁত তুলে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেলে।
আন্দ্রোনিকোসের শরীর দুটো বিশাল স্তম্ভের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো এবং অ্যাঞ্জেলোস বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট হয়েছিলেন।