মধ্যযুগে পুরো ইউরোপ জুড়ে ‘ডাইনি’দের পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। যে সব নারীদের ডাইনি অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, তারা আসলে ছিল ইউরোপের প্রাচীন মাটি থেকে উঠে আসা প্যাগানসংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
প্যাগানদের ধর্মীয় রীতিনীতি এবং উপসনাপদ্ধতি খ্রিস্টধর্মের চেয়ে পৃথক ছিল। এ কারণেই প্যাগান ডাইনিদের খ্রিস্টধর্ম বিরোধী বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ইউরোপ জুড়ে লক্ষাধিক নারীকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।
এইসব ডাইনিরা নাকি আকাশে উড়তে পারে, পশুতে রূপান্তরিত হতে পারে, পিশাচের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করে। এসব মনগড়া অভিযোগে সমৃদ্ধ এক লোকজ সংস্কৃতির বিনাশ সম্ভবপর হয়েছিল।
প্যাগানরা উর্বর শক্তির প্রতীক। আমরা সাধারণত Pagan বলতে কেবলই মূর্তিপূজক বুঝি। যা পুরোপুরি সঠিক নয়!
আসলে Pagan শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ paganus থেকে; যার অর্থ গ্রাম্য।
আনুমানিক ৩০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে ‘প্যাগান কেল্টরা’ বাস করত। এই প্যাগান কেল্টদের পুরোহিতদের বলা হতো ড্রুইড।
তারা সূর্যের উপাসক ছিল। এছাড়াও বনদেবীর পূজা করত। ৪৩ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ইংল্যান্ড আক্রমন করে। সেসময় রোমানদের চোখে কেল্টরা ছিল প্যাগানুস (মানে গ্রাম্য)। রোমানরা তখন প্যাগান সংস্কৃতি কে ধ্বংস করতে উদ্যত হলেও প্যাগান দেবদেবীর আরাধনা অব্যাহত থাকে।
৪০৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে রোমান সৈন্যরা ইংল্যান্ড ত্যাগ করে। এর কারণ ছিল রোমান সাম্রাজ্য তখন বিশাল ছিল, সেই সম্রাজ্য চালাতে হিমশিম খেতে হতো। আর তার সঙ্গে শুরু হয় রোমান রাজ পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্র।
রোমানরা ইংল্যান্ড ত্যাগ করার পর স্যাক্সনরা ইংল্যান্ড জয় করে। স্যাক্সনরাও প্যাগান ছিল। শুরুতে এরা খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধিতা অবশ্য করেছিল তবে, তা বেশিদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এরা সবাই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়।
খ্রিস্টান যাজকরা তখন ইংল্যান্ডে পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে। এরপর তারা পদক্ষেপ নেয় প্যাগানসংস্কৃতি নির্মূলের জন্য, যা খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধী!
প্যাগানসংস্কৃতির মূল বৈশিস্ট্য ছিল বহুঈশ্বরবাদ, নারীপ্রাধান্য ও প্রকৃতিলগ্নতা।
এখন আসছি ডাইনি বিষয়ে। এতক্ষণ যা বলেছি তার সঙ্গে ডাইনি শিকার ব্যাপারটা পুরোটাই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
ইংরেজি witch শব্দটি বাংলায় আমরা যাকে বলি ডাঈনি তা এসেছে wicca শব্দ থেকে। এটি অনেক পুরনো একটি ইংরেজি শব্দ। এই উইকা শব্দের প্রকৃত অর্থ ‘যে জ্ঞানী ’ অথবা ‘যে নিগূঢ় জ্ঞান অর্জন করেছে’।
এই উইকা শব্দটির অন্য অর্থটি হচ্ছে; প্রাচীন প্যাগান ধর্মের উপাসক নারী ও পুরুষ । এরা ঈশ্বরের পুরুষালি, মেয়েলি ও পার্থিক রূপের আরাধনা করত।
এই ধারণাটি ছিল খ্রিস্টধর্মের মূল ধারণার বিরোধী।
উইকান ধর্মে কিন্তু স্বর্গ ও নরকের ধারণা ও রয়েছে- মানে এরা পরকালেও বিশ্বাসী ছিল। তবে উইকো ধর্মটি পুরোহিততান্ত্রিক এবং কর্তৃত্ববাদী নয় বলে তা খ্রিস্টীয় ধর্মের হত্তাকত্তাদের মধ্যে একধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিল।
উইকান ধর্মের এক বিশেষ দিক হচ্ছে witchcraft (যা ছিল নারীদের কৃত্য মানে নিত্যকর্ম)। আর খ্রিস্টীয় জগতে witchcraft শব্দের অর্থ করা হয় ডাকিনীবিদ্যা।
অবশ্য উইকা পরিভাষায় ভাষায় witchcraft এর অর্থ হল: ‘জ্ঞানীদের শিল্প-কৌশল’। প্যাগান ধর্মের অর্ন্তভূক্ত উইকান ধর্মটি অনেক পুরনো। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে খ্রিস্টধর্মের আগমনের পূর্বে উইকানদের (এদেরই পরবর্তীকালে ‘উইচ’ বলা হয়) সম্মান ছিল। উইকানরা বিশ্বাস করত গুহ্যজ্ঞান বংশ পরম্পরায় সঞ্চালিত হয়। যেমন ট্যালিপ্যাথি। এও এক ধরণের ম্যাজিক। উইকান নারীরা ছিল মানবতাবাদী। তারা তন্ত্রমন্ত্রের দ্বারা মানুষের রোগ বালাই সারিয়ে তুলত। এই তন্ত্রমন্ত্রই ছিল খ্রিস্টানদের কাছে কুসংস্কার।
পরবর্তীকালে ইউরোপের মানুষ উইকান নারীদের ভয় পেতে লাগল। এর মূল কারণ ছিল উইকানরা এমন সব বিষয় জানত যা সাধারণ লোকে জানত না।
উদাহরণস্বরূপঃ- উইকান নারীরা জন্মের সময় সম্মোহনবিদ্যা প্রয়োগ করে গর্ভবতী নারীর যন্ত্রণা কমাত। অথচ আজও হিপনোসিস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এখন যুগ পালটে গেছে। আজ কেউ হিপনোসিস জানলে লোকে তাকে ভয় করে না।
আসলে উইকান ধর্মের মূল জ্ঞান প্রকৃতি পর্যবেক্ষণলব্দ জ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভেষজ ঔষধি, টেলিপ্যাথি, ফেইথহিলিং, প্রি-কগনিশন, ক্লাইরভয়ান্স, অ্যাস্ট্রাল-ট্রাভেলিং এবং ক্রিস্টাল বল এসব উইকান ধর্মের অর্ন্তগত। এসবই আবার খ্রিস্টবিরোধী।
খ্রিস্টান চার্চ গুলো ভাবল উইকানরা আসলে এসব গুপ্তবিদ্যা রপ্ত করেছে শয়তানের কাছ থেকে। এমন কী তখন ভেষজ লতাপাতা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা গির্জার যাজকদের কাছে ছিল অগ্রহনযোগ্য (তাদের ধারণা এসব উইকানদের কাজ)।
খ্রিস্টানরা কেবল প্রার্থনায় বিশ্বাস করত। যে কারণে উইকানদের ম্যাজিক আর প্রকৃতি উপাসনা সন্দেহের চোখে দেখা হতো। মধ্যযুগে অসুখ-বিসুখকে ভাবা হত ঈশ্বরের ক্রোধের কারণ।
আর যারা এর চিকিৎসা করত তারা ছিল চার্চের শক্র। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ উইচক্র্যাপ্ট অ্যাক্ট -এ বলা হলোঃ- চিকিৎসার জন্য যারা ‘উইচদের’ কাছে যাবে তারাও ধর্মের চোখে সমান অপরাধী।
খ্রিস্টধর্ম পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। উইকা ধর্মে নারীর প্রাধান্য খ্রিস্টীয় যাজকদের ক্রোধের উদগীরণ করেছিল …প্যাগান ধর্মটিকে নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লাগল। গির্জা পিতারা উইকান নারীকে বলল, “ওল্ড, পুয়োর অ্যান্ড ফিমেল।”
আরও বেশ কয়েকটি কারণে নারীর ওপরে গির্জার যাজকদের দারুণ ক্ষোভ ছিল। মধ্যযুগের ইউরোপের গির্জার যাজকদের কাছে সৌন্দর্য ছিল অশুভ আর সুখশান্তি হল পাপ; যৌনতা ছিল অন্যায়, জন্মদানও ছিল বিরক্তিকর। আর এ সবই নারীর অনিবার্য অনুসঙ্গ।
খ্রিস্টীয় যাজকদের নারীবিদ্বেষের আরেকটি কারণ ছিল-নারী পুরুষকে পাপের পথে নিয়ে যায় এই বদ্ধমূল ধারণা।
এছাড়া ঈভ আপেল খেয়েছিল। এবং তা ছিল স্বর্গ থেকে মানুষের পতনের কারণ। কাজেই, নারী হচ্ছে অশুভের দ্বার। আর এসবই গির্জার যাজকরা অন্ধ রকমভাবে বিশ্বাস করতো।
নারী প্রাকৃতিক ভাবেই পরিস্কার না, উইকান নারীরা তো আরও নোংরা। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ডাইনি’ বিরোধী ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মের শাস্ত্রীয় শ্লোকঃ-
A man also or woman that hath a familiar spirit, or that is a wizard, shall surely be put to death: they shall stone them with stones: their blood shall be upon them. (Leviticus 20:27)
অথচ খ্রিস্টধর্ম ইউরোপে প্রচলনের পূর্বে ভাবা হতো মানবদেহ কামময় (লাস্টফুল) নয়। যৌন সুখের প্রয়োজন আছে এবং তা মানুষের জন্ম হয়। মানুষ সুখ কামনা করে। মানুষ যন্ত্রণাদায়ক জীবনে স্বস্তির জন্য প্রকৃতিকে সৌন্দর্য খোঁজে।
চার্চের সিদ্ধান্তে অবশেষে পঞ্চদশ শতক থেকে উইকানদের ‘ডাইনি’ আখ্যায়িত করে পোড়ানো আরম্ভ হয় । উইকানদের সবাই যে নারী ছিল তা নয়। পুরুষও ছিল। তবে সংখ্যায় অল্প।
১৪৮২ থেকে ১৭৮২ পর্যন্ত গোটা ইউরোপে ১০০,০০০ এর মতো মানুষকে ডাইনি বিদ্যা চর্চার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। যাদের মাঝে ৪০-৫০ হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
নিধনযজ্ঞে গির্জার কর্তৃত্ব থাকলেও বিচার হত আদালতে। উইকান নারীদের বিচার হওয়া ছিল সহজ।
শুধু তাই নয়! নারীদের সঙ্গে সঙ্গে উইকান নারীদের বিড়ালও পুড়িয়ে মারা হত। কেননা, সেকালের খ্রিস্টীয় সমাজে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে- বিড়াল হল ডাইনিদের চর।
আর তাই বিড়ালের সংখ্যা হ্রাস পায় ইউরোপে। কাজেই ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধি ঘটে। ইঁদুর প্লেগের জীবাণু বহণ করে। প্লেগের প্রাদূর্ভাব ঘটে। আর তখন প্লেগের কারণ হিসেবে আবারো উইকানদের কেই দায়ি করা হয়।
এতো অত্যাচার নির্যাতন সত্ত্বেও প্যাগান ধর্ম ইউরোপ থেকে কখনোই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তার কারণ হল আমদানীকৃত ধর্মের চেয়ে লোকজ সংস্কৃতি অনেক বেশি শক্তিশালী। এই কারণেই আমরা কুড়ি শতকের ইউরোপে নতুন করে প্যাগান ধর্মের উত্থান দেখি।
জেরাল্ড গার্ডনার (১৮৮৪-১৯৬৪) ইংলিশ লেখক নৃতত্ত্ববিদ এবং মরমী। ইনি কুড়ি শতকে ইউরোপে উইকান সংস্কৃতির পুনুরুত্থান ঘটান। উইকানদের শাস্ত্রও লেখেন ইনি। যে শাস্ত্রের বৈশিস্ট (১) বহু ঈশ্বরবাদ;(২) প্রকৃতিলগ্নতা এবং (৩) পবিত্র নারীবাদ।
Featred Image Credit: AKG/ALBUM