“পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুবক।”
প্রাক সক্রেটিস দার্শনিকদের মধ্যে হেরাক্লিতোস অন্যতম। তার দর্শন সাধারণ দ্বন্দ্ব, পরিবর্তন ও ঐক্য এই বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
দার্শনিক হেরাক্লিতোসের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যেসকল তথ্য তার সম্পর্কে পাওয়া যায় তার সবটাই কিংবদন্তি কিংবা ইতিহাসবিদদের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে।
গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিতোস আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৫ সালে ইফসাস শহরে জন্মগ্রহণ করেন (বর্তমান তুরস্ক)। তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা ছিলো সে সময়ের খুবই সম্ভ্রান্ত একটি পরিবার। তার পরিবার সেসময় ইফফাত শহরের ধর্মীয় ও সামাজিক কাজকর্মের তদারকি করতো। ধারণা করা হয় যে, পারিবারিক সূত্রে হেরাক্লিতোস ইফসাস শহরের মন্দিরের কিছু ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেছেন।
হেরাক্লিতোস ছিলেন খুবই জ্ঞানপিপাসু একজন দার্শনিক। তিনি সর্বদা মানুষের জীবনের গভীর সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতেন। হেরাক্লিতোসের মতে, পৃথিবীর প্রকৃতি হচ্ছে পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হবে, সেই সাথে মানুষের উচিৎ নিজের পরিবর্তন করা। তবে হেরাক্লিতোসের দর্শনের মূল বিষয় ছিলো ‘লোগোস বা ধারণা’। তিনি বিশ্বাস করতেন লোগোস বা ধারণা অদৃশ্য এক শক্তি আর মধ্যেই আছে বিশ্বের সকল বিশৃঙ্খলার সমাধান। হেরাক্লিতোস এর এই দর্শন পরবর্তীকালে স্টোয়িক দার্শনিকরা ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
প্রাচীণ গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল এমনকি আধুনিক যুগের হেগেল ও নিৎসের মতো দার্শনিকরা হেরাক্লিতোসের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
হেরাক্লিতোস গ্রীসের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। হেরাক্লিতোস এর মতে, “ভিড় বা জনতাকিছুই বোঝে না।” তিনি মনে করতেন সমাজের শাসনকর্তার জনপ্রিয় হবার প্রয়োজন নেই। সমাজের প্রয়োজন একজন জ্ঞানী ও ন্যায়পরাশন শাসক।
হেরাক্লিতোস ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন সৎ, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। তিনি সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করতেন। তার দর্শনেই তা প্রকাশ পায়। তবে তিনি তার দার্শনিক ভাবনা ধাঁধার আকারে প্রকাশ করতেন। যা সমসাময়িক জ্ঞানী মানুষদের কাছেই জটিল ও রহস্যময় মনে হতো। বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল তো হেরাক্লিতোস সম্পর্কে মন্তব্যই করেছেন অন্ধকার দার্শনিক বলে।
হেরাক্লিতোসের দর্শনের একটি উদাহরণ দেখুন, হেরাক্লিতোস বলেছেন ‘আগুনের মাধ্যমে সবকিছুর শুরু এবং শেষ।’ স্বাভাবিকভাবে এই বক্তব্যর অর্থ জটিল ও কঠিন। এই কথা দ্বারা তিনি বুঝাতে চেছেন আগুন পরিবর্তন এবং রূপান্তরের প্রতীক। যেমন কাঠ যখন পুড়ে যায়, তা আগুনে রূপান্তরিত হয়। তেমনি ভাবে তিনি পৃথিবীর সকল পরিবর্তন কে আগুনের মতো রূপান্তরের তুলনা করেছেন।
হেরাক্লিতোসের জীবন ছিলো একাকী ও বিষন্নতার। তার এই একাকিত্বের পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয় তিনি সাধারণ মানুষ ও তাদের জীবনপদ্ধতির উপর বিরক্ত ছিলেন। নিজ শহর ইফসোসের মানুষদের তিনি বোকা বলে সমালোচনা করতেন।
মানুষের উপর তিনি বিরক্ত হয়ে শেষমেশ হেরাক্লিতোস একেবারে নির্জন স্থানে চলে যান এবং নিজের দর্শন চর্চায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। বেশ কিছু কিংবদন্তি মতে, হেরাক্লিতোস তার নিজ শহর ইফেসাস ছেড়ে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে তিনি তার আহার হিসবে গ্রহণ করতেন গাছের পাতা ও বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ।
হেরাক্লিতোসের মৃত্যু নিয়েও রয়েছে রহস্য। ধারণা করা হয় হেরাক্লিতোস তার জীবনের শেষদিকে এসে ড্রপসি (শরীরে পানি জমার রোগ) রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নিজের এই রোগের চিকিৎসা করতে হেরাক্লিতোস নিজের শরীরকে গোবর ও কাঁদা দিয়ে ঢেকে রাখতেন। হেরাক্লিতোস বিশ্বাস করতেন এই গোবর ও কাঁদা তার শরীরের পানি শোষণ করে তাকে সুস্থ করে তুলবে। শেষমেশ খ্রীস্টপূর্ব ৪৭৫ সালে তার এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমেই তার মৃত্যু ঘটে।
হেরাক্লিতোসের জীবন যদিও ছিলো নিঃসঙ্গ ও বিষন্ন। তিনি তার জীবনে জনপ্রিয়তা ও পান নি। কিন্তু তার চিন্তাভাবনা পরবর্তী সময়ের দার্শনিকদের জন্য নতুন পথ দেখায়। নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন যুক্তি ও তর্ক ও জ্ঞান দিয়ে সত্য উদঘাটন করে সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পেছনে। আর তার এই মহৎ ভাবনাই তাকে প্রাচীন গ্রীসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিকে পরিণত করেছে।