দেশ পরিচালনা ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণকে বিভিন্ন জিনিসের উপর সরকারকে কর প্রদান করতে হয়। কিন্তু সেই কর প্রদান করার বিষয়বস্তু যদি হয় টুপি পড়া অর্থাৎ হ্যাট ট্যাক্স বা ‘Hat Tax’? টুপি পড়লেই আপনাকে কড় দিতে হবে। আর সেই আইন ভঙ্গের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। শুনতে উদ্ভট ও অদ্ভুত মনে হলেও ১৮শ শতকের ইংল্যান্ডে টুপি পড়বার জন্য সরকারকে কর প্রদান করতে হতো।
টুপির জন্য ইংল্যান্ডে এই কর পদ্ধতি চালু ছিলো ১৭৮৪ সাল থেকে ১৮১১ সাল পর্যন্ত। অদ্ভুত এই করের আইন পাস করিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট দ্য ইয়ংগার, তিনি ছিলেন টোরি রাজনৈতিক দলের সদস্য। এই কর আরোপের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি করা। সেই সাথে ইউরোপে তখন ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন যে আগ্রাসী আক্রমণের মাধ্যমে পুরো ইউরোপ অস্থিতিশীল করে রেখেছেন, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যুদ্ধের অর্থের যোগান দেওয়া।
১৭ ও ১৮শ শতকের দিকে ইংল্যান্ডের পুরুষদের জন্য টুপি ছিলো, তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়াও টুপি সেই সময়ের সমাজের মর্যাদার প্রতীক হিসবেও মনে করা হতো। যার টুপি যতো দামী তাকে ততো বেশি ধনী মনে করা হতো, অন্যদিকে একজন গরীব মানুষের টুপি হতো খুবই সস্তা ও মলিন। ইংল্যান্ডের তখনকার নীতিনির্ধারকেরা মনে করলো দেশে দামি টুপি ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি, সেহেতু এই কর আরোপের মাধ্যমে প্রচুর রাজস্ব আয় করা যাবে।
সেসময় টুপি বিক্রেতাদের সরকার থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। বিশেষ করে লন্ডনের টুপি বিক্রেতাদের লাইসেন্স নিতে খরচ হতো ২ পাউন্ড। আর লন্ডনের বাহিরের টুপি বিক্রেতাদের খরচ পড়তো সর্বনিম্নে ৫ শিলিং। লন্ডন যেহেতু প্রধান শহর সেহেতু সেখানে লাইসেন্সের দাম ও বেশি। হিসেবের সুবিধার্থে বলে রাখা ভালো ১০০ শিলিং এ ১ পাউন্ড আর তখনকার ১ শিলিং এর বর্তমান বাজারমূল্য কম করে ৪.৫ থেকে ৫ পাউন্ড।
টুপি বিক্রেতারা তাদের দোকানে ‘Dealer in Hats by Retail’ সাইবোর্ড লাগিয়ে লাগিয়ে রাখতো। যা নির্দেশ করতো এই দোকানের সরকারি লাইসেন্স রয়েছে। টুপির দোকানগুলোর প্রতিটি টুপিতে একটি রাজস্ব স্ট্যাম্প লাগাতে হতো। যা প্রমাণ করতো, যে টুপিটি কর পরিশোধের মাধ্যমে কিনা হয়েছে। টুপির কর নির্ধারণ করা হতো টুপির দামের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ যে টুপির দাম যতো বেশি সেই টুপির করের পরিমাণও ছিলো ততো বেশি।
টুপিগুলোর করের মাত্রা ছিলো এমন,৪ শিলিংয়ের কম দামের টুপির জন্য ৪ পেনি। ৪ থেকে ৭ শিলিংয়ের মধ্যে দামের টুপির জন্য ৬ পেনি। ৭ থেকে ১২ শিলিংয়ের মধ্যে দামের টুপির জন্য ১ শিলিং। আর সবচেয়ে দামি ১২ শিলিংয়ের বেশি দামের টুপির জন্য ২ শিলিং সরকারি কর ঠিক করা হয়।
যেসকল পুরুষ টুপির কর প্রদান করতো না কিংবা কর প্রদান করতে অস্বীকার করতো, তাদেরকে সরকারিভাবে জরিমানা করা হতো। তবে জরিমানা করার ক্ষেত্রে টুপির দামের দিকে নজর রেখে জরিমানা করা হতো। কেউ কেউ আবার রাজস্ব স্টাম্প জালিয়াতি করে নিজের টুপিতে ব্যবহার কিংবা অবৈধভাবে স্টাম্প ব্যবহার করে ব্যবসা করতে চাইলে তাদেরকে বিশাল আর্থিক জরিমানা, কারাদণ্ড কিংবা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডও দেওয়া হতো।
হ্যাট ট্যাক্স বা টুপির উপর আরোপিত কর যে শুধু ইংল্যান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো তা ভাবলে একমই ভুল ভাবা হবে। ১৭ শতকের ফ্রান্সে রাজা লুই ষোড়ষের রাজত্বের সময়ে ফ্রন্সের পুরুষদের টুপির জন্য কর প্রদান করতে হতো। অবশ্য এর কারণ ছিলো জনগণের ব্যায়হুল ফ্যাশনের নিয়ন্ত্রণ। বিশেষ করে তখনকার পুরুষদের বড় টুপি পরার প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়া ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের শাসনামলেও ফ্রন্সে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফ্যাশন ট্যাক্স চালু হয়েছিলো, যার মধ্যে হ্যাট ট্যাক্স ও ছিলো। নেপোলিয়ন এই করের মাধ্যমে শুধু সরকারের রাজস্বই বৃদ্ধি করতো না, এর মাধ্যমে তিনি ফ্রান্সের উচ্চশ্রেণির মানুষদেরকেও নিয়ন্ত্রণ করতেন।
টুপির উপর আরোপকৃত এই করের কারনে ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ টুপি ছিলো তখন তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রধান জিনিসের মধ্যে অন্যতম। টুপির জন্য আরোপিত এই অতিরিক্ত কর সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কষ্টকর হয়ে উঠে। বিশেষ করে গরীব মানুষদের জন্য, তাদের বেশিরভাগেরই মাথার পরিধান করার জন্য একাধিক টুপি ছিলো না।
অবশেষে ১৮১১ সালে ইংল্যান্ডে হ্যাট ট্যাক্স বাতিল হয়। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ করতে ইংল্যান্ডের সরকার তখন প্রায় সবকিছুর উপরেই আলাদা আলাদা কর জারি করেছিলেন। ইংল্যান্ডের মানুষদের তখন বাড়ির জানালা থেকে শুরু করে গায়ে মাখার পারফিউমের জন্য ও কর প্রদান করতে হতো। জানালার কর প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়ির জানালার সংখ্যার উপর কর নির্ধারণ করা হতো। বাড়িতে জানালার সংখ্যা যতো বেশি হবে, করের পরিমাণ ও ততো বেশি। এই সব ধরনের করই তখন সাধারণ মানুষদের জীবনে অসহনীয় হয়ে উঠেছিলো।