সাহিত্য জগতের সবচেয়ে জটিল যে রহস্য গুলো রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম রহস্যময় নাম ‘হোমার’।
কে এই হোমার? কোথায় তার জন্ম? কেউ জানেন না! হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। হোমার কে নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। কেউই যেন হোমার রহস্যের উদঘাটন করতে পারলো না। মাঝখানে কেবল সেই রহস্য আরো বেশি জলঘোলা হয়ে হয়ে জটিল হয়ে উঠেছে।
হোমারের পরিচয়
হোমার কে আমরা চিনি তার মহাকাব্যের জন্য। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৪ টি কাব্য মহাকাব্য (ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ন, মহাভারত) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তার মধ্যে প্রথম দুটোর স্রষ্টাই স্বয়ং গ্রীক মহাকবি হোমার।
এই গ্রীক মহাকবির জন্ম, জন্মস্থান ও মৃত্যু নিয়ে গবেষকদের প্রশ্নের শেষ নেই। তার জন্ম, মৃত্যু, জন্মস্থান, তিনি দেখতে কীরকম ছিলেন ইত্যাদি সম্পর্কিত নানা তথ্য নিয়ে ইতিহাসবিদগণের নিকট তেমন কোনো সুস্পষ্ট দলিল ও নেই।
‘হোমার’ নামটি একটি গ্রীক শব্দ। যার দুটো অর্থ হতে পারে- অন্ধ ও জিম্মি। এ থেকে ধারণা করা হয় হোমার একজন গ্রীক ক্রীতদাস ছিলেন, যিনি আবার অন্ধও ছিলেন। হোমার অন্ধত্ব নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্য একটি হচ্ছে কোনো এক শাস্তিস্বরূপ নাকি হোমারের চোখ উপ্রে ফেলা হয়েছিলো। তবে হোমার ঠিক কীভাবে অন্ধ হয়েছেন, তা নিয়ে তেমন কিছু বলতে পারেনি ইতিহাসবিদরা।
বাস্তব জীবনে অন্ধ হয়ে থাকলেও আত্মিকভাবে অন্ধ ছিলেন না। অন্তর দিয়ে চারপাশ অনুভব করতেন। অন্ধ জগতেই তিনি ট্রয়ের ময়দানে দেবতা আর মানুষদের লড়াই দেখতে পেয়েছেন। তার দুই মহাকাব্যে তা দৃঢ়ভাবে ফুটেও উঠেছে।
হোমারের পরিচয় নিয়ে ইতিহাসবিদ ৪র্থ শতাব্দীতে দ্য লাইফ অফ হোমার শিরোনামে একটি গবেষণাধর্মী পুস্তক রচনা করেন। তিনি সেখানে একটি নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন। তার মতে, হোমারের আসল নাম ‘মেলেসিয়েনে’। তার পিতার নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয় আরগস শহরের ক্রেথেইস নামক এক ব্যক্তির নাম। আবার অনেকের মতে, হোমার নিতান্ত নিঃসঙ্গ একজন কবি, যিনি পথে পথে নিজের মহাকাব্য শুনিয়ে বেড়াতেন।
হোমারের জন্মসাল এবং জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক
সভ্যতার ইতিহাসে সাল, মাস গণনা পদ্ধতি বেশ প্রাচীন হলেও, হোমারের সময় এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই ঠিক কবে হোমার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা নিয়ে দ্বিধায় বিভক্ত সাহিত্য সমাজ।
তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব অনুযায়ী, হোমারের জন্মসাল ৭৫০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১২০০ খ্রিস্টপূর্বের মাঝামাঝি সময়ে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হোমার ট্রয় যুদ্ধের কয়েক বছর ব্যবধানে জন্মেছিলেন। তাই তার কাব্যে ট্রয়ের উপাখ্যান বেশ দৃঢ়ভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
জন্মসালের পর জন্মস্থান নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭টি শহরের নাম উঠে এসেছে এই তালিকায়। তবে তথ্য প্রমাণ এবং যুক্তির উপর নির্ভর করে দুটি অঞ্চলকে হোমারের সম্ভাব্য জন্মস্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। এগুলো হলো– গ্রিস এবং এশিয়া মাইনর অঞ্চল (সেটি বতমানে তুরষ্কের অংশ)। ইলিয়াডে ব্যবহৃত ভাষার ধরন এশিয়াটিক গ্রিক। সে অনুযায়ী, হোমারের জন্মস্থান আয়োনিয়া অথবা চিওস দ্বীপ। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে চিওস দ্বীপের এক পরিবার নিজেদেরকে হোমারের বংশোদ্ভূত হিসেবে দাবী করেছে। তারা নিজেদের হোমারয়েড হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছিল।
হোমারের সাহিত্যকর্ম
হোমারকে সাহিত্যজগতে সম্রাটে আসনে বসিয়েছে তার দুই অমর কীর্তি ইলিয়াড এবং ওডিসি। তবে এই দুই মহাকাব্যের বাইরেও হোমারের আরো অসাধারণ সব রচনা রয়েছে। ইলিয়াড ও ওডিসির বাহিরে হোমারের আরো ২৩ টি কাব্য রয়েছে।
তার সেই কাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হচ্ছে, The Battle of the Frogs and Mice, Cypria, The Little Iliad, The Phocais, The Thebais, The Capture of Oichalia প্রভৃতি।
কিন্তু এই সকল কবিতাসমূহ ইলিয়াড এবং ওডিসি’র মাহাত্ম্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে বলে মনে করেন বিখ্যাত সাহিত্য বিশারদগণ।
ইলিয়াড
ট্রয় যুদ্ধের ঘটনাকে পুঁজি করে প্রায় ১৫ হাজার ৬৯৩টি ষড়মাত্রিক পঙক্তির সমন্বয়ে রচিত সুবৃহৎ মহাকাব্য ইলিয়াড। গ্রীক দেবী থেতিসের পুত্র আকিলিসের ক্রোধ, প্যারিস কর্তৃক হেলেন অপহরণ এবং ট্রয় যুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ইলিয়াডের ঘটনাবলী।
ইলিয়াডের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে- অ্যাকিলিস, ট্রোজান বীর হেক্টর, হেক্টরের ভাই প্যারিস, ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম, গ্রিক রাজা আগামেমনন, দেবরাজ জিউস, রূপসী হেলেন, পাত্রক্লুস এবং এনিয়া। ট্রয় যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ এবং দেবতাদের রূপকথাময় জগতের সংমিশ্রণে এক অপরূপ কাব্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর এই ইলিয়াড। ইলিয়াডকে পশ্চিমা সাহিত্যের জগতে অন্যতম সেরা মহাকাব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওডিসি
ইলিয়াডের ঘটনার পর থেকে শুরু হওয়া মহাকাব্য ওডিসি প্রায় ১২ হাজার ১০৯টি ষড়মাত্রিক পঙক্তির সমন্বয়ে রচিত। ট্রয় যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গ্রিক বীর ওডেসিয়াসের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মুখ্য হয়ে উঠেছে এখানে। পথিমধ্যে দেবতা পোসাইডনের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে নানা প্রতিকূলতার মাঝে শুরু হয় এ যাত্রা। এছাড়া ওডেসিয়াসের বিরুদ্ধে সাইরেন, সাইক্লপ পলিথেমাস সহ আরো অনেকের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্বও কাব্যের মাঝে ফুটে উঠেছে। পঙক্তি বিন্যাস এবং বিভিন্ন উপমার ব্যবহারের মাধ্যমে যেন এক নতুন হোমারকে আবিষ্কার করা হয় এই কাব্যে। সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে ইলিয়াডে যে হোমারের যাত্রা শুরু হয়, তা ওডিসির ছন্দে পূর্ণতা লাভ করে।
তবে ওডিসির মাঝে বিভিন্ন দ্বন্দ্বযুদ্ধে ওডেসিয়াসের বীরত্ব ফুটে উঠেছে। ভয়ংকর দানব পলিথেমাসের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ওডেসিয়াস দক্ষতার সাথে তাকে কুপোকাত করে। যুদ্ধ শেষে ওডেসিয়াসের হাতে অন্ধ হয়ে যায় সেই দানব। ওডিসির মাঝে ব্যবহৃত ভাষাশৈলী বর্তমান যুগের সাহিত্যিকদের জন্য আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত হয়। হোমার নাটকীয়ভাবে কাহিনীর মধ্যবর্তী অবস্থা থেকে তার কবিতা শুরু করতেন। তারপর ধীরে ধীরে পূর্ব কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হতেন।
হোমার প্রকৃতপক্ষে কয়জন?
হোমারের কাব্য রচনার ধরন পর্যালোচনার মাধ্যমে অনেক সাহিত্যিক দাবী করেছেন, হয়তো হোমার কোনো নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি নন। হোমারের নামের অন্তরালে লুকিয়ে আছেন একদল কবি। এ সন্দেহ থেকে জন্ম নেয় নতুন আরেকটি প্রশ্ন, হোমার আসলে কয়জন? মজার ব্যাপার হলো, সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিখ্যাত প্রশ্নের একটি বিশেষ নামও আছে। তা হলো, হোমারিয় প্রশ্ন বা ‘Homeric Question।
১৭৯৫ সালে সর্বপ্রথম এ প্রশ্নের জন্ম দেন জার্মান সাহিত্য সমালোচক অগাস্ট উলফ। ইলিয়াড এবং ওডিসির বর্ণনায় বিভিন্ন অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলে ধরেন এই সমালোচক। তিনি ধারণা করেন, ইলিয়াড এবং ওডিসি বেশ কয়েকজন কবির দ্বারা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি ইলিয়াডের মাঝে ঘোড়ার গতির প্রশংসা করে হোমার বেশ কয়েকটি পঙক্তি রচনা করেছেন। কিন্তু ওডিসির মাঝে এ ধরনের কোনো পঙক্তির উল্লেখ নেই। এমনকি প্রাণীর সবরকম বর্ণনা থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। হয়তো দুজন আলাদা কবি ওডিসি এবং ইলিয়াড রচনা করেছেন।
এ প্রশ্নের কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কিছু হোমারে বিশ্বাসী সাহিত্যিকদের মতে, ইলিয়াড রচনাকালে হোমার যুবক ছিলেন। কিন্তু ওডিসি রচনাকালে তিনি কাব্য বিন্যাসে যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাই দুটি মহাকাব্যে দুই ধরনের বর্ণনা বিদ্যমান। কিন্তু দিনশেষে এই সকল প্রশ্নের সকল উত্তর শেষে একটা কিন্তু থেকেই যায়!
হোমারের মৃত্যু
হোমারের জন্মসালের পর মৃত্যুসাল নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে, তিনি ৭০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু গবেষকগণ সুনির্দিষ্টভাবে তার মৃত্যুসাল বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে হোমারের মৃত্যুকে ঘিরে একটি মজার গল্প প্রচলিত আছে। ৫ম শতাব্দীর দার্শনিক হেরাক্লিটাসের বর্ণনানুযায়ী, একবার একদল বালক হোমারের নিকট হাজির হলো। তারা হোমারকে উকুন সম্পর্কিত একটি জটিল ধাঁধার উত্তর জিজ্ঞাসা করেন। হোমার সারাদিন ভেবেও তার উত্তর বের করতে পারেননি। এ ধাঁধার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে হোমার মৃত্যুবরণ করেন। তবে এ ঘটনার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।