১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনার দুই শেতাঙ্গ কিশোরী বেটি জুন ও মেরি এমা কে খুনের দায়ে মাত্র ১৪ বছর বয়সী জর্জ স্টিনি জুনিয়র কে ইলেক্ট্রনিক চেয়ারে বসিয়ে ২৪০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ শক দিয়ে হত্যা করা হয়। আদৌও ছেলেটি কোনো অপরাধ করেনি, তার অপরাধ ছিল সে কৃষ্ণাঙ্গ।১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া এই মৃত্যুদন্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সকল ঘটনাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
জর্জ স্টিনি জুনিয়র ১৯২৯ সালের ২১ অক্টোবর সাউথ ক্যারোলিনার পাইনউডে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেন। তারা বাবা সাউথ ক্যারোলিনের অ্যালকুলুর একটি মিলে চাকরি পান। চাকরি সূত্রে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পুরো পরিবার অ্যালকলু তে চলে আসেন। জর্জে পরিবারে তার বাবা মা ছাড়া ছিলো আরো দুই ভাই বোন। বোন ক্যাথরিন রবিনসন (১০ বছর) আর ভাই চার্লস স্টিনি (১২ বছর)। জর্জ তার পরিবারের বড় সন্তান ছিলেন।
হত্যাকান্ডের প্লট
জর্জ স্টিনি জুনিয়রের সেই সনয়টায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবাদ ছিল চরম পর্যায়ে। এতোটাই ঘৃণা ছিলো যে শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা চার্চও তৈরি করা হয়েছিল। যদিও খ্রিস্টান ধর্ম সেসব সমর্থন করে না। তবুও ঘৃণা সেসবের সৃষ্টি করেছিল।
তেমনি জর্জের সেই এলাকা মানে অ্যালকলু তে সাদা আর কালোদের জন্য আলাদা চার্চ ছিল। কালোরা প্রার্থনা করার জন্য যেতেন ক্ল্যারেনডন ব্যাপিস্ট চার্চে আর সাদারা যেতেন গ্রিন হিল চার্চে।
একদিন সকালে দেখা গেলো গ্রিন হিল চার্চ থেকে ৪/৫ মিনিট দূরের এক ভুট্টা ক্ষেতে দুই কিশোরীর মৃতদেহ পরে আছে। তাদের একজন বেটি জুন বিনিকার (বয়স ১১ বছর) আরেকজনের নাম মেরি এমা টেমস (৭ বছর)।
শেতাঙ্গ আর কৃষ্ণদের চার্চ দুটো প্রায় কাছাকাছি ছিল। আর হত্যাকান্ডটি কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চের একদম কাছেই। সেসময় সাদারা সকল অপরাধের জন্য কালোদের দায়ী করতো। এটা একপ্রকার স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠেছিল, সকল সমস্যা আর অপরাধ কালোদের সৃষ্টি। স্বাভাবিক ভাবেই সেই হত্যাকান্ডের দায় পড়লো কালোদের উপর।
মেয়ে দুটি লাশ পাওয়া আগের দিন বিকেল থেকে খবর চড়াও হয়েছিল যে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেদিন মেয়ে দুটোকে কেউ দেখেনি একমাত্র জর্জ স্টিনি ছাড়া। সেদিন সকালে বিনিকা ও মেরি নামের ঐ দুই কিশোরীর সাথে দেখা হয় জর্জ ও তার বোনের। জর্জ ও তার বোন সেদিন সকালে কোনো এক কাজে বের হয়েছিল। ৪ কিশোর কিশোরীর কথাবার্তা হয় সেখানে। বিনিকা ও মেরি তাদের জানায় তারা ভুট্টা ক্ষেতে যাচ্ছে। তাদের যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন জর্জ বলে তারা ভুট্টাক্ষেতে গেছে। আর সেখানেই ২ কিশোরীর লাশ আবিষ্কার হয়।
পুলিশ জর্জ কে গ্রেফতার করতে আসে। ছোট্ট জর্জ তখনো জানে না তার অপরাধ কি? তার সহজ সরল কথাগুলোই তার জীবনপর জন্য কাল হয়ে দাড়িয়ে উঠে।
গ্রেফতারের পর জর্জ কে তার পরিবার থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। মৃত্যুদন্ডের আগে দীর্ঘ ৮০ দিন সে একটি রুমে বন্দী ছিল। এই দীর্ঘ দিনে তাকে মাত্র ১ বার তার পরিবারের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়েছে। তাকে সেখানে ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না, না দেয়া হতো ঠিকমতো পানি। এমনকি বাথরুমের ব্যবস্থা ও ছিল না। সেই রুমেই থাকে বাথরুমের কাজ সারতে হতো।
পুলিশ জর্জ কে গ্রেফতার করার পর বুঝায় পুলিশ যা যা তাকে বলবে তা যদি সে স্বীকার করে তাহলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। সহজ সরল বোকা জর্জ পুলিশের সেসব কথা বিশ্বাস করে তাদের দেয়া জবানবন্দি স্বীকার করে নেয়।
পুলিশ তাদের স্বীকারোক্তি তে জানায় জর্জ স্টিনি জুনিয়র স্বীকার করেছে সে সেই কিশোরীকে হত্যা করেছে। জজ বিনিকা ও মেরিকে ধর্ষণ করতে চাইছিল তারা সম্মতি না দেয়ায় তাদের দুজনকে কাছেই চার্চের পাশে থাকে রেললাইনের পাটাতন দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে তাদের লাশ ভুট্টাক্ষেতে রেখে দেয়।
মামলার রায়
মামলার শুনানির দিন মাত্র ৩ ঘন্টায় পুরো রায় দিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ ঘন্টারও কম সময়ে উভয়পক্ষের কথা শোনা হয় এবং এর পর মাত্র ১০ মিনিটে এক হাজার শ্বেতাঙ্গ জুরি তাদের মতামত দেয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি সেই ১ হাজার জুরির মধ্যে ১ জন কৃষ্ণাঙ্গ জুরিও ছিলেন না!
মামলার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নেওয়া হয় মাত্র তিনজনকে, যিনি মেয়ে দুটির লাশ পেয়েছিলেন এবং দুই জন চিকিৎসক, যারা লাশ দুটির ময়নাতদন্তে কাজ করেছেন।
মাত্র ১০ মিনিটে জুরিরা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় জজ স্টিনি জুনিয়র হত্য করেছেন এবং তাকে ইলেক্ট্রনিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় আদালত। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ায় জর্জের পরিবার কে আপিলের সুযোগ ও দেয়া হয়নি!
১৯৪৪ সালের ১৬ জুন
জর্জকে ধরে ধীরে ধীরে চেয়ারে বসানো হলো। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখা তার শেষ সম্বল বাইবেলটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৪ বছর বয়সী জর্জের জন্য চেয়ারটি বেশ বড়ই ছিল। তাই বৈদ্যুতিক চেয়ারের উপর একটি মোটা টেলিফোন বই দিয়ে তার ওপর তাকে বসানো হলো। সেই সাথে চেয়ারের হাতল এবং পায়ার সাথে যথাক্রমে তার হাত এবং পা বেঁধে দেওয়া হলো।
বেল্ট দিয়ে মুখ বেঁধে দেওয়ার পর তার চেহারাও ঢেকে দেওয়া হলো, যাতে কেউ তার কান্না দেখতে না পারে। কিন্তু বড়দের মুখোশ কিশোর জর্জের মুখ ধরে রাখতে পারছিল না। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য মাথার সাথে সংযোগ দেওয়া হলো বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের। এর কিছুক্ষণ পরই সংকেত পাওয়ার সাথে সাথে জর্জ স্টিনি জুনিয়রের শরীর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হবে ২,৪০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ।
মৃত্যুর ৭০ বছর পর অপরাধের বোঝা হতে মুক্তি মিললো জর্জ স্টিনি জুনিয়রের
প্রকৃতি সবসময় সত্যি প্রকাশ করবে,প্রকৃতি কখনো সত্য গোপন রাখে না জর্জের বেলাতেও তাই ঘটেছে। ২০০৪ সালে ঐ এলাকার এক ইতিহাসবিদ জর্জ ফ্রেরারসন এই ঘটনা নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেন। তার বেশ কয়েকটি বিষয়ে খটকা লাগে। জর্জে পরিবারের সদস্যদের অনুমতি নিয়ে তিনি আবার কেসটি রিউপেন করেন। মামলার ৩ জন প্রত্যক্ষদর্শীই ততোদিনে মারা গিয়েছেন। তাদের জবানবন্দী বিবেচনা করে জানা যায়, তারা কেউই স্টিনির সরাসরি সম্পৃক্ততার ব্যাপারে অবগত নন।
তার ওপর পুলিশের কথামতো একটি রেললাইনের লোহার পাত তুলে তা দিয়ে কাউকে আঘাত করার মতো শক্তি একজন ১৪ বছরের কিশোরের থাকার কথা না। সেই সাথে একজন ১১ বছর বয়সী এবং একজন ৭ বছর বয়সী বালিকাকে কোলে নিয়ে একা দেড় মাইল রাস্তা পার হওয়া, একজন ১৪ বছর বয়সীর কাছে এক কথা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার!
সকল ঘটনা বিচার বিবেচনা করে ২০১৪ সালে আদালত রায় দেয় জর্জ স্টিনি জুনিয়র নির্দোষ, হত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই। শুধুমাত্র কালো হওয়ায় আমেরিকার আইন জর্জ কে হত্যা করেছে। জর্জের আত্মা কি সেই আইনকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে? আর যারা সেই আইনের সমর্থন দিয়েছে তাদের?
জর্জের মৃত্যুর পর তার পরিবারের অবস্থা কি হয়েছিল?
জর্জের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার পর তার পরিবার কে সবসময় আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। তাদেরকে সকলেই দুই তরুণীর হত্যার জন্য দায়ী করেছে। এজন্য জর্জে মা বাবা উভয়কে কিছুদিন পরপর কাজের জায়গা পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
জর্জের বোনের ভাষ্যমতে,
আমার মা দিনরাত শুধু কাঁদতেন এবং প্রার্থনা করতেন। আমরা সকলেই চাইছিলাম আসল সত্য বেরিয়ে আসুক। কিন্তু আপনার কাছে অর্থ না থাকলে আর পরিস্থিতি আপনার বিপরীতে থাকলে আপনার আর কিছুই করার থাকবে না। সেসময় টাই এমন ছিল, আপনি সাদা হলে আপনার কেনো পাপ বা অপরাধ নেই। কালো হলেই সব পাপ আপনার।
জর্জে বোন আরো বলেন যে দুটি মেয়ে যেদিন হত্যা হয়েছিল সেদিন সারাদিন জর্জ বাড়িতে ছিলো, তাই তার দ্বারা কোনোভাবেই হত্য করা সম্ভব নয়। আর বিচারক কারমেন মুলেন জর্জ অপরাধ করেছেন কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য বিচার শুরু করেননি, তিনি শুধু অপরাধের জন্য কোনে কালোকে শাস্তি দেয়ার জন্য বিচারের আসনে বসেছিলেন।