ইতিহাসের একটা বড় অংশই দখল করে আছে সহিংসতা, সংঘাত ও যুদ্ধবিগ্রহ। যুদ্ধে যে কেবল সবসময় খুনোখুনি,সহিংসতা আর রক্তপাতই ঘটেছে তা একদমই ভুল। যুদ্ধে মাঝেমধ্যেই কিছু হাস্যকর ও অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, সেসব ঘটনা যুদ্ধের সেই কঠিন সময়ে সৈনিকদের কিছুটা হলেও আনন্দ এনে দেয়। আমার পড়া যুদ্ধের বেশ কিছু হাস্যকর ঘটনা তুলে ধরবার চেষ্টা করছি এই আর্টিকেলে।
ভুলবশত মুরগির খাবার খাওয়া : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই মজার ঘটনাটি ঘটেছিলো ফ্রান্সের এক যুদ্ধের ময়দানে। ব্রিটিশ সৈন্যরা সারাদিন ক্লান্তিকর যুদ্ধের পর তারা রাতের অন্ধকারে শত্রুপক্ষের ক্যাম্প থেকে খাবার চুরি করবার পরিকল্পনা করে।
ব্রিটিশ কিছু সৈন্য রাতে লুকিয়ে শত্রু ক্যাম্প থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট নিয়ে দ্রুত নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে আসে। আনন্দের সাথেই ব্রিটিশ সৈন্যরা প্যাকেটের সেসব খাবার খেতে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ পর তারা বুঝতে পারে তারা যে খাবারটি খাচ্ছে সেটি কোনো মানুষের জন্য তৈরি খাবার নয়, এটি মুরগীদের জন্য তৈরি বিশেষ খাবার।
এই খাবার খাওয়ার পর সৈন্যাদের মাঝে অস্বস্তি তৈরি হয়। এই ঘটনা তখন তাদের সকলের মাঝে এক হাস্যরস তৈরি করে। খুব দ্রুতই এই ঘটনা পুরো ব্রিটিশ ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে, পুরো ক্যাম্পে তখন হাস্যরসের সৃষ্টি করে যা তাদের যুদ্ধের ক্লান্তি কিছুটা হলেও লাঘব করেছিলো। পরবর্তীকালে সৈন্যরা এই ঘটনার কথা স্মরণ করে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতো।
অস্ট্রিয়ার ভুল যুদ্ধ ঘোষণা (১৮৭৮)
১৮৭৮ সালের ঘটনা, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের সৈন্যরা ভুলবশত নিজেদের দেশেরই একটি শহরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসে। ১৮৭৮ সালে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য ‘বসনিয়া-হার্জেগোভিনার’ দখল নেয়। তখন এই অঞ্চল ছিল তুর্কিদের অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে, অটোমান সাম্রাজ্যের তখন শক্তি কমে এসেছে তারা এই অঞ্চল অস্ট্রিয়াকে দিয়ে দেয়। আর তাই বসনিয়া পুরোপুরি নিজের দখলে নিতে অস্ট্রিয়ার সৈন্যরা সেখানে সামরিক অভিযান চালায়।
অভিযান চালানোর সময় অস্ট্রিয়ার একটি সেনাদল ভুল মানচিত্র ও ভুল দিকনির্দেশনার কারবে নিজেদেরই সীমান্ত শহর Schwechat কে শত্রু এলাকা মনে করে আক্রমণ করে বসে। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকাকে উদ্দেশ্য করে কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
হঠাৎ এমন আক্রমণ দেখে শহরের মানুষজন প্রাণভয়ে শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সৈন্যরা বুঝতে পারে তারা ভুল করে নিজেদের দেশের মানুষের উপর আক্রমণ করেছে। এই ঘটনার পর অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এই ঘটনাটি একটি বিষয়ে আমাদের শিক্ষা দেয় যে, যে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনার সময় মানচিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অটোমানদের রোডস অবরোধের ব্যর্থতা (১৫২২)
১৫২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের সৈন্যরা গ্রিসের রোডস (Rhodes) নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ দখল করতে আক্রমণ চালায়। রোডস দ্বীপটি ক্রুসেডের সামরিক গোষ্ঠির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিলো। দ্বীপটি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক ও সামরিক দিক থেকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। অটোমান সম্রাট সুলতান সুলেমান তার সাম্রাজ্যের বিস্তার করতে এই দ্বীপ দখলের সিদ্ধান্ত নেন।
অটোমানরা বিশাল সংখ্যক সৈন্যবাহিনী ও কামানের গোলাবারুদ নিয়ে রোডস দ্বীপ আক্রমণ করে। তাদের পরিকল্পনা ছিলো শহরের প্রাচীর ভেঙে প্রবেশ করা, এক পর্যায়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় প্রাচীরের নিচে সুরঙ্গ তৈরি করে সেখানে বিষ্ফেরক স্থাপন করে বিস্ফোরণ ঘটানো। কিন্তু এই বিস্ফোরণ কোনো কাজে আসেনি। কারণ নাইটরা আগে থেকেই অটোমানদের এই পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছিলো, আর তাই তারা সুরঙ্গের চারপাশ পানি দিয়ে ভর্তি করে ফেলে। এরফলে বিস্ফোরণে বড় কোনো কিছু ঘটেনি।
এই ঘটনাকে হাস্যকর করতে নাইটরা একটি গাধার গলায় ঘন্টা বেঁধে সাজিয়ে, তা অটেমান সৈন্যদের দিকে পাঠায়। অটোমান সৈন্যরা এই ঘটনাকে অপমান হিসেবে বিষণ লজ্জা পায়।
পায়রা বিভ্রাট : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রযুক্তির তখনো অতোটা উন্নতি ঘটেনি। বেডিও, টেলিগ্রাফের মতো যন্ত্রগুলো তখনো সহজলভ্য হয়ে উঠেনি। এমন পরিস্থিতিতে সৈন্যরা দ্রুত ও নিরাপদে তথ্য আদানপ্রদান করতে পায়রা ব্যবহার করতো। নির্দিষ্ট স্থানে বার্তা প্রেরণের জন্য তারা পায়রাগুলেকে বিশেষ ট্রেনিং দিতো।
একবার একটি পায়রার মাধ্যমে মিত্রবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পাঠানো হচ্ছিলো। বার্তাটি ছিলো শত্রু পক্ষের কাছাকাছি থাকা মিত্র বাহিনীকে সতর্ক করার জন্য। কিন্তু পায়রাটি ভুল করে শত্রু পক্ষের ক্যাম্পে পৌঁছে যায়।
শত্রুরা বার্তাটি পড়বার পর তাদের কাছে এই বার্তা এতোটাই অদ্ভুত ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে যে হাসতে হাসতে তারা নিজেদের কাজই ভুলে যায়। চিঠিতে কি ছিলো তা এখনো পুরোপুরি অস্পষ্ট, তবে এই হাসাহাসি অসাবধানতার কারণে মিত্রবাহিনী আক্রমণের জন্য সুযোগ পায় এবং সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয় তাদের জন্য।