সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর পর যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে তিনি আর কেউ নন, জার্মান ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা।
১৯৯০ এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে গড়ে প্রতি ১০ দিনে একটি করে বই প্রকাশিত হয়েছে, কাফকার সম্পর্কে। এখন পর্যন্ত নোবেল পাওয়া ৩৪ জন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাদের মধ্যে কাফকার লেখার প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একবার তার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেনঃ-
আমি যখন কলেজে ভর্তি হই, সাহিত্যের সাধারণ পড়াশোনা আমার ভালোরকমই ছিল, আমাদের বন্ধুদের চেয়ে গড়পরতা অনেক বেশি। বোগোতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হতে থাকে, যারা আমাকে সমকালীন লেখকদের সঙ্গে পরিচিত করানো শুরু করে। এক রাতে এক বন্ধু আমাকে ফ্রানৎস কাফকার ছোটগল্পের একটি বই ধার দেয়। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে যাই, আর সে রাতেই কাফকার ‘রূপান্তর’ গল্পটি পড়া শুরু করি। প্রথম লাইনটা পড়ামাত্র আমার প্রায় বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী যে অবাক হই আমি।
প্রথম লাইনটা ছিলঃ- ‘এক ভোরে গ্রেগর সামসা অসুখী সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় প্রকাণ্ড এক পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে …।’ আমি লাইনটা নিজেকে নিজে পড়ে শোনাতে লাগলাম, ভাবলাম , এভাবে যে কেউ লিখতে পারে তা-ই তো আমার জানা ছিল না; যদি জানতাম, তাহলে আমি নিশ্চয় আরো কত আগেই লেখালেখি শুরু করতাম। তারপরই, আর দেরি না করেই, আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করলাম।
এরপরই… আমার সাহিত্যে পদচারণার শুরু।
ফ্রানৎস কাফকার শৈশব
ফ্রানৎস কাফকার জন্ম ১৮৮৩ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে, তখনকার অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের চেকোস্লোভোকিয়ার ’প্রাগ’ শহরে। প্রাগ ছিলো তখনকার বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী।
কাফকার পরিবার ছিলো মধ্যবিত্ত এবং আশকেনাজি নামক এক সম্প্রদায়ের ইহুদি। ফ্রানৎস কাফকার বাবা বাবা হারমান কাফকা ( ১৮৫২ – ১৯৩১ ) শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন, এরপর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি কিছুদিন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান এর কাজ করেন। এই কাজও তিনি বেশিদিন করলেন না সব ছেড়ে দিয়ে তিনি স্যুভেনির , ফ্যান্সি জিনিসপত্র আর কাপড়চোপড়ের দোকান চালু করেন প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে। সেই দোকানের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১৫ জন, অর্থাৎ যথেষ্ট বড় দোকানই ছিলো। তার ব্যবসার নিজস্ব লোগো ও ছিলো। ব্যবসার লোগো ছিল দাঁড়কাক (চেক ভাষায় Kavka)
কাফকার মা ছিলেন ইয়ুলি কাফকা (১৮৫৬-১৯৩৪), তিনি ছিলেন এক ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠিত রিটেল ব্যবসায়ীর মেয়ে; শিক্ষা-দিক্ষায় তিনি তার স্বামীর উপরে ছিলেন। ফ্রানৎস কাফকার বাবা-মা বাসায় কথা বলতেন ইদ্দিশ (হিব্রু বর্ণমালায় লেখা আকেনাজি ইহুদি মূল থেকে তৈরি হওয়া, গোঁড়া ইহুদিদের ব্যবহৃত হিব্রু ও সেমেটিক সংমিশ্রণের এক জার্মান ভাষার রূপ) ঘেঁষা এক জার্মান ভাষায়। কিন্তু ‘ শিক্ষিত জার্মান ’ ভাষা তখন যেহেতু ছিল সমাজে ও চাকরিতে উপরে ওঠার জন্য জরুরি , তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষিত জার্মান ভাষা’ শিখতেই অনুপ্রাণিত করতেন।
কাফকারা ছিলেন মোট ছয় ভাই বোন , তাদের মধ্যে ফ্রানৎস কাফকা সবার বড়। ফ্রানৎসের বয়স ৬ হওয়ার আগেই তার অন্য দুই ভাই গেয়র্গ ও হেইনরিখ একদম শিশু বয়সেই মারা যায়। এরপর জন্ম নেন ফ্রানৎসের তিন বোন : গ্যাব্রিয়েল ( ১৮৮৯-১৯৪১ ) ; ভ্যালেরি ( ১৮৯০-১৯৪২ ) ; ওটলি (১৮৯২-১৯৪৩)। এই ওটলা ছিলেন কাফকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ।
৩ বোনের মৃত্যুর সাল দেখে হয়তো অনুমান করতেই পারছেন, তারা ফ্যাসিস্ট হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হলোকাস্টের শিকার।
কাফকার পরিবার শুরুর দিকে থাকতেন একটা ছোট, ঠাসাঠাসি অ্যাপার্টমেন্টে। তাদের বাসায় এক কাজের মেয়ে থাকত, এজন্য হয়তো কাফকার গল্প ও উপন্যাসে কাজের মেয়ের কথা ঘুরেফিরে আসে।
কাফকার ঘর প্রায়ই থাকত অনেক ঠান্ডা, প্রাগ শগর তখনো বিদ্যুৎ এর ছোঁয়া পায় নি, সুতরাং হিটিং সিস্টেম এর কথাই আসে না। ঘর গরম করার জন্য সেই মধ্যযুগীয় কয়লা চিমনিরই ব্যবহার করতে হতো। ১৯১৩ সালের দিকে কাফকারা একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট এ উঠেন। ততোদিনে কাফকার ২ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। অবশ্য এর মাঝে কাফকাদের বহুবার বাসা বদল হয়েছে।
কাফকার বাবা-মা দুজনেই দোকানের কাজ নিয়ে প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকতেন। কাফকার মা তার দিনের ১০-১২ ঘন্টাই কাটাতেন দোকানের কাজ করে। কাফকার সময় কাটতো তার বোন ও কাজের ঝিয়েদের সঙ্গে। কাফকা ও তার ৩ বোন সকলেই কাজের লোকের হাতে মানুষ হয়েছে। বাবা মায়ের সঙ্গ তাদের ভাই বোন কেউই খুব একটা পায় নি।
ফ্রানৎস কাফকার পড়াশোনা
কাফকা ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত প্রাগের তখনকার মাসনা স্ট্রিটের ‘ জার্মান বয়েস এলিমেন্টারি স্কুলে’ পড়াশোনা করেন। কাফকার বয়স যখন ১৩ হয় হয় কাফকার বাবা কাফকার বাবা ‘বার মিজভাহ্’ এর মাধ্যমে কাফকার ধর্মীয় পড়াশোনা শেষ করান (ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের এই শিক্ষা গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক)।
কাফকা সিনাগগে যেতে পছন্দ করতেন না। সিনাগগ হচ্ছে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। বছরে চার বার কাফকা কে তার বাবার সাথে সিনাগগে যেতে হতো, সবগুলোই ছিলো ধর্মীয় উৎসব। সিনাগগে যেতে না চাইলেও তার বাবার ভয়ে তাকে যেতে হতো। কাফকার বাবা ছিলেন প্রচন্ড রকমের রাগী ও বদমেজাজি মানুষ।
১৮৯৩ সালে কাফকা এলিমে এলিমেন্টারি স্কুল ছেড়ে কাফকা প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের ওপর অবস্থিত কিল্কি প্যালেসে (এটারই নিচতলায় ছিল তাঁর বাবার দোকান) কড়া শাসনের ও ক্ল্যাসিক্যাল শিক্ষাদান রীতিতে চালানো জার্মান মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন।
এই স্কুলের পড়াশোনার মাধ্যম ছিলো জার্মান। কিন্তু কাফকা কেবল তখন চেক ভাষা লিখতে ও পড়তে পারতেন। তার চেক ভাষার দক্ষতার জন্য তিনি সকলের কাছে প্রশংসিত হতেন। কিন্তু কাফকা নিজেকে চেক ভাষায় সাবলীল মনে করতেন না।
কাফকা ১৯০১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে প্রাগ শহরের কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি প্রথমে পড়াশোনা শুরু করেন রসায়ন বিষয়ে, কিন্তু মাত্র ২ সপ্তাহ যেতেই কাফকা বিষয় পরিবর্তন করে আইনের ছাত্র বনে যায়। কাফকা হয়তো বুঝেছিলেন ওসব রস- কসের প্যাচ হয়তো তার মাথায় ঢুকবে না। আইন শাস্ত্র যে কাফকা পছন্দ করতেন তাও নয়। তবে আইনে ভর্তি হওয়ার কাফকার বাবা খুচি হয়েছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আইনে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়া সহজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতি হওয়ার সাথে সাথেই কাফকার বেশ কজন বন্ধু জুটে যায় তার মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক ফেলিক্স ভেল, লেখক অস্কার বাউম, ফ্রানৎস ভেরফেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরের পড়া শেষ হতেই কাফকার সঙ্গে পরিচয় হয় ম্যাক্স ব্রডের, যে ছিলেন কাফকার সবচেয়ে কাছের, এবং বতমানে কাফকার জগৎবিখ্যাত হওয়ার পেছনে পুরো ক্রেডিট ব্রডেরই।
এই ম্যাক্স ব্রড ও ছিলেন আইনের ছাত্র। ম্যাক্স ব্রডই প্রথম খেয়াল করেন খুব কম কথা বলা, লাজুক ধরনের এই ছেলেটির মেধা ও প্রজ্ঞা অত্যন্ত গভীর ও অগাধ। কাফকা ফিওদর দস্তয়য়েভস্কি ফ্লবেয়ার , ফ্রানৎস গ্রিলপারসার ও হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট এদের লেখা খুব পছন্দ করতেন। ব্রডের ভাস্য অনুসারে তাদেরকে কাফকে নিজের ভাই ও গোত্রীয় ভাবতেন। এছাড়াও কাফকা চেক সাহিত্য খুব ভালোবাসতেন কাফকা আর জার্মান ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক গ্যেয়টেকে খুব পছন্দ করতেন।
ফ্রানৎস কাফকা ১৯০৬ সালের ১৮ জুলাই আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি পান এবং এর পরে এক বছর আদালতে বাধ্যতামূলক বেতনহীন ক্লার্কের চাকরি করতে শুরু করেন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে কাফকার কখনোই আইন পছন্দের বিষয় ছিলো না। কাফকার প্রিয় বিষয় ছিলো দর্শন ও ধর্ম। তবে কাফকার কোনো ধর্মের প্রতিই খুব একটা টান অনুভব করতেন না।
ফ্রানৎস কাফকার কর্মজীবন
কাফকা তার কর্মজীবনে শুধুমাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন এবং মাঝখানে বড় ধরনের কোনো ব্যবসা করার ও উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন।
কাফকার প্রথম চাকরিটি ছিলো ইতালিয়ান একটি বিমা কোম্পানিতে। কোম্পানির নাম ছিল Assicurazioni Generali, এই কোম্পানিতে তিনি ১৯০৭ সাল থেকে ১৯০৮ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন, সবমিলিয়ে ৬-৭ মাসের বেশি হবে না।
এই ইতালিয়ান কোম্পানিতে কাজ করার সময় কাফকা তার জীবনের অসুখী সময়গুলো কাটান। সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত তাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো। দীর্ঘ পরিশ্রমে তার মন-মানসিকতা থাকতো সবসময় বিষন্ন তার উপর বেতন ছিলো অতি সামান্য। এই চাকরি করতে গিয়ে কাফকা লেখা লেখি করার সামান্য সময়টুকু ও পেতেন না। কাফকা তার রূপান্তর উপন্যাসের গ্রেগর সামসা চরিত্রটি কাফকার এই সময়কার পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করেই লিখেছিলেন হয়তো। ১৯০৮ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে কাফকা নিজের চাকরির ইস্তফা দেন।
ইতালিয়ান কোম্পানির চাকরি থেকে পদত্যাগ করার ঠিক ২ সপ্তাহ পর কাফকা সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান Workers ‘ Accident Insurane Institute for the Kingdom of Bohemia তে যোগ দেন। এই অফিসে কাফকার দায়িত্ব ছিলো মিল – কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে , সেসব দুর্ঘটনার তদন্ত করা ও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করা। তখনকার দিনে মেশিনে কাটা পড়ে হাতের আঙুল হারানো কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের ক্ষতি হওয়া ছিল বেশ নৈমিত্তিক ঘটনা।
তবে কাফকার বাবা ছেলের এই চাকরি মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি তার ছেলের এই চাকরিকে Brotberuf বা ‘ রুটির চাকরি ‘ বলে খোঁটা দিতেন। কাফকা তার কাজের বেলায় ছিলেন সবসময় খুঁতখুঁতে, সৃজনশীল ও যত্নশীল, আর তাই খুব দ্রুত তার পদন্নোতি হয়। ১৯১৫ সালের দিকে কাফকার বেতন ছিলো প্রায় ৬ হাজার ক্রাউন এখন অর্থের মূল্য অনুযায়ী ৭-৮ লক্ষ টাকা। ৭-৮ লক্ষ টাকার বেতন কে কোনোভাবেই ছোট চাকরি বলা যায় না। যেখানে কাফকার অন্য সহকর্মীরা মাসে মাত্র ৯০০-১০০০ ক্রাউন বেতন পেতেন।
১৯১৮ সালের শুরুর দিকে কাফকার বাবা ৫ লক্ষ ক্রাউন দিয়ে একটি নতুন অ্যাপাটমেন্ট ক্রয় করেন। যার মূল্য আজকের দিনের ১০ মিলিয়ন ডলারে কাছাকাছি। চাকরিতে পদোন্নতি হওয়ার পর কাফকার কাজ ছিলো বিমা কোম্পানির ক্ষতিপূরণ দাবির যথার্থতা নির্ণয় করা, রিপোর্ট লেখা, ব্যবসায়ীদের আবেদন নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন ( Annual Report ) তৈরি করার মতো বড় কাজটিও কাফকা করেছেন অনেক বছর। কাফকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির ও সম্পাদনার কাজে তার দক্ষতার বিশেষ প্রশংসা করতেন।
কাফকার চাকরি দুপুর দুটোর মধ্যেই শেষ হয়ে যেতো। এজন্য সাহিত্য চর্চা করার জন্য কাফকা যথেষ্ট পরিমান সময় পেতেন। সাহিত্য চচার সময় কাফকা কিছু উদ্ভট পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। এরমধ্যে একটি হলো লেখালেখির সময় প্রকৃতির ডাক দিলে লেখায় বেঘাত ঘটতে পারে, আর তাই তিনি রুমের দরজা বনে করে পুরোপুরি নগ্ন হয়ে লিখতে বসতেন, যেনো লেখালেখির সময় বাহিরে না যেতে পারেন।
কাফকা যখন চাকরি করেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। তখন প্রাগের সকল যুবকদের বাধ্যতামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হতো। তবে কাফকা কে বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। তখন অফিসের ঊর্ধ্বতনেরা কাফকাকে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যাক্তি’ বলে ঘোষণা করেন।
শুধু যুদ্ধই নয়, কাফকা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকতেন তার জন্য তার অফিস তাকে দীর্ঘ দিনের ছুটিও দিতো। শেষে কাফকা যখন শারিরীক অসুস্থতার জন্য আর চাকরি করতে পারছিলেন না তখন বিমা কোম্পানি তাকে পূর্ণ পেনশন দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়, অথচ কাফকা সেই কোম্পানিতে চাকরি করেছিলেন মোটে মাত্র কয়েক বছর।
কাফকা তার ২ টি চাকরি ছাড়া একবার ব্যবসা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সেটিও ১৯১১ সাল তার বোন এলির স্বামী সাথে। তারা প্রাগে একটি মিল কারখানা খোলা মনস্থির করেন, এই ব্যবসার পূঁজি ছিলো কাফকার বোনকে বিয়ে করার যৌতুকের টাকা।
কাফকা পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পাল্টান এই ভেবে যে ব্যবসা করলে তার সাহিত্য চর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে।
অফিস তাকে যুদ্ধ করার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেও। কাফকা যুদ্ধের স্বাদ কেমন তা চেখে দেখগে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখান, কিন্তু তত দিনে যক্ষ্মার কারণে ডাক্তারি দৃষ্টিকোণ থেকেই সেনাবাহিনী তাকে নিতে অপারগতা জানিয়ে বসে।
ফানৎস কাফকার বাবা ‘হারমান কাফকা’
কাফকার বাবা হারমান কাফকা সবসময় ছিলেন নিষ্ঠুর, অনুভূতিশূন্য এক পিতা। তিনি সারাজীবন কাফকা কে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছিলেন। কাফকার রূপান্তর উপন্যাসের পোকার মতোই তিনি তাকে কোনো সম্মান বা ভালোবাসা কোনেটাই দেননি। সবসময় ছেলেকে তিনি হুমকি ধমকি দিতেন। তুমি অপদার্থ তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে। এসব কথা শুনে কাফকা বড় হয়েছেন একজন আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ হিসেবে।
১৯১৯ সালের নভেম্বরে কাফকা তার বাবার উদ্দেশ্যে ১০০ পাতার একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। এই চিঠিটি বতমানে কাফকা প্রধান আত্মজীবনী মূলক রচনা। এই চিঠি লিখেছিলেন বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের দফারফা করতে। কিন্তু কাফকার মা ও বেন তাকে সেই চিঠি পাঠাতে নিষেধ করায় আর পাঠান নি।
এই চিঠিতে কাফকা লিখেছেন তার রাগী বদমেজাজি বাবার রূপ, তিনি কিভাবে তাকে তাড়া করতেন, কিভাবে তাকে হুমকি ধমকি দিয়ে বলতেন, ‘আমি তোমাকে মাছের মতো করে টুকরো টুকরো করবো’।
একবার রাতে কাফকা কান্না করায় তার বাবা তাকে বিছানা থেকে তুলে বাড়ির পেছনের বারান্দায় সরা রাত দার করিয়ে রেখেছিলেন। বাহিরে ছিলো তখন কনকনে ঠান্ডা। সেদিন কাফকার মনে হয়েছিল বাবার কাছে তিনি অতি তুচ্ছ জিনিস।
কাফকার সাথেই যে তিনি শুধু খারাপ ব্যবহার করতেন তা নয়। কাফকার বাবা তার দোকানের কর্মচারীদের সাঘেও জুলুম করেন। এজন্য কয়েকজন নিজেদের চাকরির ইস্তফা ও দিয়েছিল।
বাবা কে কাফকা মনে করতে দৈত্য। তার পাশে নিজেকে দাড় করালে নিজেকে মনে হতো কোনো জীবন্ত কঙ্কাল। বাবাকে অনুকরণ করতে ব্যর্থ হয়ে কাফকা তাঁর অক্ষমতার জন্য নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করলেন; তার নিজের সারাংশ “তোমার জন্য , বাবা , আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি , বিনিময়ে পেয়েছি এক সীমাহীন অপরাধবোধ।”
ফ্রানৎস কাফকা তার জীবনের শেষ দিকে যখন কপর্দকশূন্য মেয়ে ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইলেন, তখন তার বাবা ক্ষেপে গেলেন। কাফকার ভাষায়, তার বাবা তাকে বললেন: ‘মেয়েটা খুব সম্ভব তার ব্লাউজ একটুখানি উঠিয়েছে, প্রাগের ইহুদি মেয়েগুলো যেভাবে ওঠায় আর কি, আর তুমি? তুমি মজে গেলে, ঠিক করলে ঐ মুহূর্তেই তাকে বিয়ে করবে। তোমাকে আমি একবারেই বুঝি না। তুমি বড় হয়েছ, শহরে থাকছ, কিন্তু তোমার চলার পথে দেখা হওয়া প্রথম মেয়েটাকে বিয়ে করা ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারছ না।
অন্য কোনো ‘রাস্তা’ কি তোমার নেই? এইসব জায়গায় যেতে যদি তোমার ভয় লাগে , আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যাবো। অর্থাৎ তার বাবা তাকে পতিতালয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। অথচ কাফকা এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা জায়গা ভাবতেন।
কাফকা কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবেন এই ব্যাপারে তার বাবা তাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কিন্তু কাফকার কাছে এই স্বাধীনতা ছিলো অর্থহীন। যে অপরাধবোধ ও হীনমন্যতা তার বাবা তার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তাতে তিনি পড়াশোনা করে আনন্দ পেতেন না।
কাফকার আত্মবিশ্বাস ছিলো একদম তলানীতে প্রতিবার পরীক্ষার আগে ভাবতেন তিনি পাস করতে পারবেন না। তবুও তিনি পাস করে গেছেন কখনো ফেল করেন নি।
বাবার মানসিক চাপ থেকে নিস্তার পেতেই কাফকা সাহিত্যে ডুব দিয়েছিলেন। তবে সবজায়গায় ঘুরেফিরে তার বাবা চলে আসতো। কর্তৃত্বপরায়ণ বাবার মূর্তি কাফকার অন্যতম বিখ্যাত দুটো গল্পের মধ্যে দেখা যায় একটি রায় আরেকটি হলো রূপান্তর।
প্রথম গল্পে দেখা যায় ছেলে বিয়ে করে স্বাধীন হতে চাইলে তার বুড়ো বাবা তাকে তার বিয়ের পাত্রী নিয়ে ওভাবেই খোঁটা দেন, যেভাবে হারমান তার ছেলেকে দিয়েছিলেন, যখন কাফকা ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইছিল। সেই গল্পে পরে এই বাবা ছেলেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
দ্বিতীয় গল্পটিতে ছেলে পোকা হয়ে গেলে বাবাই একসময় তার গায়ে একটা আপেল ছুড়ে মেরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
ফ্রানৎস কাফকার মা ‘ইয়ুলি কাফকা’
কাফকার বাবার তুলনায় তার মা খুব শান্ত ও লাজুক এক মহিলা ছিলেন। কাফকার মা কে দেখা যায় তার স্বামীর সহকারী হিসেবে। তিনি তার সন্তানদের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ তবুও বাবার অত্যাচাটের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি ব্যর্থ।
কাফকার চিঠি দেখে বুঝা যায় তার মায়ের ভূমিকা ছিলো একজন অসহায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। অসহায় কারণ তিনি পিষ্ট দুদিকেরই চাপে; একদিকে তাঁর স্বামী, অন্যদিকে তার সাহায্যের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা চার সন্তান।
কাফকা তার বাবাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ- আমরা তাকে ( মাকে ) সমানে হাতুড়ির বাড়ি মেরে যাচ্ছি, তোমার দিক থেকে তুমি, আমাদের দিক থেকে আমরা।
কাফকার দুটি গল্প – ‘ রায় ’ ও ‘ রূপান্তরেও তার মায়ের চরিত্রটি পাওয়া যায়। রায় গল্পে মা মৃত ; আর ‘ রূপান্তর ’ গল্পে তিনি তাঁর ‘ দুর্ভাগা ছেলের প্রতি মমতায় ভরা, কিন্তু ছেলের বিপদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ছাড়া তার আর কোনো ভূমিকা নেই।
এছাড়াও কাফকার ডায়েরিতে ইয়ুলি কাফকাকে দেখা যায় ছেলের অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপারগুলো নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছেন, ছেলের বিরক্তি শুধুই বাড়াচ্ছেন আর তাকে বুঝতে পুরো ব্যর্থ হচ্ছেন। কাফকা ডায়েরিতে নালিশ জানাচ্ছেন যে তাঁর মা তাঁকে সাধারণ আর দশটা যুবকের মতোই ভাবেন , তাই ‘ ঘ্যানঘ্যান ‘ করেন তাঁর ছেলে এক মতো বিয়ে- থা করে সংসারী হচ্ছে না।
কাফকার ব্যক্তিগত জীবন, প্রেম ও যৌনতা
কাফকার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের ভাষায় কাফকা জীবনভর অবিরাম মেয়েদের পেছনে ছুটেছেন, তবে আর তার মধ্যে সব সময় কাজ করত ‘বিছানায় ব্যর্থ হওয়ার ভয়। ‘
কাফকা অনেকবার পতিতা সংসর্গ করেছেন, এমনকি পর্নোগ্রাফিতেও তার আগ্রহ ছিল।
কাফকার জীবনে প্রেম এসেছে মোট ৬ বার। প্রত্যেকটি প্রেমই একেকবার একেক রূপে এসেছে। তবে কাফকা বিয়ে করাকে তিনি জীবনের মুখ্যতম ব্যাপার বলে ভাবতেন।
কাফকার প্রথম প্রেমিকার নাম ছিলো ফেলিসা ব্রাউন। ১৯১৩ সালে মাঝামাঝিতে বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় তার দেখা হয়েছিল।ফেলিসা বয়সে কাফকা চেয়ে ৪ বছরের ছেট ছিলেন। সে বুদ্ধিদীপ্ত, অল্পবিস্তর পড়ালেখা করা , অনাকর্ষণীয় চেহারার, ভালো চাকরি করা বার্লিন শহরের মেয়ে ছিল। কাফকা তাকে ভক্তি করতেন, কিন্তু তার প্রতি কামনা বাসনা বোধ করতেন না।
ফেলিস যখন কাফকার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলেন কাফকা ভয় পেয়ে যান। তিনি আবার সাহিত্যে মননিবেশ করেন এবং বাবার দোকানের দেখাশোনায় সময় দেয়া শুরু করেন।
ফেলিস কাফকার খামখেয়ালি ও অবিশ্বস্ততার ওপর খুব বিরক্ত ছিলেন। তবুও ১৯১৪ সালের ১২ জুলাই তাদের বাগদান অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ফেলিস তা ভেঙে দেয়। এরপর আবার তাদের যোগাযোগ শুরু হয় নতুন করে সম্পর্ক হয় আবার বাগদানের অনুষ্ঠান হয় ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে, সেটিও ভেস্তে যায়। এবার ভেঙে যাওয়ার কারণ ছিলো কাফকা গোপনে ফেলিসের বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সাথে সম্পর্কে জড়িৈ পড়েন। গ্রেটে অবশ্য ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিলো। কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রড দাবি করেন যে গ্রেটের গভে কাফকার একটি পুত্র সন্তান হয় তা কাফকা জানতেন না। কাফকা গভেষকরা অবশ্য তা অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন গ্রেটের সাথে কাফকার অতটা গভীর সম্পর্ক কখনোই হয়নি।
১৯২০ সালে অসুস্থ অবস্থায় থাকতেই কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক, সুন্দরী মিলেনা জেসেস্কার।
মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলার সময়েই কাফকা প্রাগের এক গরিব অশিক্ষিত হোটেল পরিচারিকা ইউলি ওরিৎসেকের প্রেমে পড়েন। ১৯১৯ সালের এক ছুটিতে তাদের পরিচয় হয়। ইউলির সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় নি।
তাদের দুজনের মধ্যে বিয়ের জন্য বাগদান ও হয়, দুজনে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন এবং বিয়ের তারিখও ঠিক করেন। ইউলির সামাজিক অবস্থান ও জায়োনিস্ট আন্দোলনের ( ইহুদিদের স্বাধীন আবাসভূমি ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ) প্রতি সমর্থনের কারণে কাফকার বাবা খেপে যান। এ ঘটনা থেকেই জন্ম হয় কাফকার বিখ্যাত বাবাকে লেখা ১০০ পৃষ্ঠার চিঠির।
একসময় ইউলিকে ছেড়ে মিলেনার দিকেই কাফকা বেশি ঝুঁকে পড়েন এবং ইউলির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেন। কাফকার শেষ প্রেমিকার নাম ডোরা ডিয়ামান্ট। ১৯২৩ সালের আগস্টে মৃত্যুর মাস দশেক আগে ডোরার সঙ্গে কাফকার পরিচয় হয় এক অবকাশযাপন কেন্দ্রে। ডোরার বয়স তখন ২৫ , কাফকার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট।
মনে করা হয় ডোরা কাফকাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু উপহার দেন। ১৯২৪ সালে কাফকার মৃত্যুর সময় ডোরা তার পাশে ছিলেন। কাফকার লেখার কোনো কোনো অংশ এমন ধারণারও জন্ম দিয়েছে যে তিনি সম্ভবত সমকামী ছিলেন।
কাফকার ছোট্ট জীবনের সমাপ্তি
ফানৎস কাফকার ১৯১৭ সালের আগস্টে স্বরযন্ত্রের ক্ষয়রোগ ( যক্ষ্মা ) ধরা পড়ে। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে তিনি স্প্যানিশ ফ্লুতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেবার প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। স্প্যানিশ ফ্লুতে সেবার ২.৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল জার্মানতে। টানা কয়েক সপ্তাহ তার জ্বরের মধ্যে কেটেছিল, কখনো কখনো ১০৬ ডিগ্রি জ্বর থাকতো। এই সময়টার বেশিরভাগ সময়ই কাফকা অজ্ঞান থাকতেন।
১৯১৭ সালের আগস্টের পর কাফকা তার বাবা- মায়ের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন, এরপর বোন ওলার কাছে, গ্রামে , গিয়ে থাকেন আট মাস। আবার ফিরে মায়ের কাছে, এরপর প্রাগ ও আধা – স্বাস্থ্যনিবাস ধরনের নানা হোটেলের মধ্যে বারবার আসা- যাওয়া; তারপর সত্যিকারের ডাক্তারি স্বাস্থ্যনিবাস হয়ে বার্লিনে ডোরা ডিয়ামান্টের সঙ্গে কয়েক মাস।
এরপর ১৯২৪ সালের মার্চে তিনি খুব অসুস্থ অবস্থায় বার্লিন থেকে প্রাগে ফিরে আসেন। এখানে পরিবারের সবাই , বিশেষ করে তাঁর প্রিয়তম ছোট বোন ওলা, তার দেখভাল করেন । ১০ এপ্রিল কাফকাকে নেওয়া হয় ভিয়েনার কাছে কিয়েরলিংয়ে ডক্টর হফমানের স্যানাটোরিয়ামে।
এই স্যানাটোরিয়ামেই ১৯২৪ – এর ৩ জুন কাফকা মৃত্যুবরণ করেন। না খেতে পারাই ছিল তার মৃত্যুর কারণ: গলার অবস্থা ক্ষয়রোগে এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি দীর্ঘদিন কোনোকিছু গলা দিয়ে নামাতে পারেননি, আর অন্য কোনোভাবে শরীরে খাবার ঢোকানোর পদ্ধতিও তখনো আবিষ্কার হয়নি।
স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি থাকা অবস্থায় কাফকা তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে চিঠিতে লিখেছিলেন।
প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স,
এবার হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না । তাই তেমনভাবে লেখালেখিও আর করা হয়ে উঠছে না। তাই তোমার কাছে লেখা চিঠিতে আমার লেখাগুলোর ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলো হয়তো কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে। জোর করে এর নতুন সংস্করণ বের করার দরকার নেই। যদি হারিয়ে না যায় হয়তো তাতে আমার করার কিছুই থাকবে না।
আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলোর ব্যাপারে বলছি, সবগুলো পাণ্ডুলিপি আর নোটবুক তুমি পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ সেগুলো যেন পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইলো। তবে তুমি সে অনুরোধের বাইরে। চিঠি পাওয়ার সাথে সাথেই হাতের কাছে থাকা আমার লেখার সবকয়টি পাতা পুড়িয়ে দিও। এই ব্যাপারে এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ।
ইতি
ফ্রানৎস কাফকা
মৃত্যুর আগে বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে তার অপ্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে দিতে অনুরোধ করে ঐ চিঠিটি লিখেন ফ্রানৎস কাফকা। তবুও অবশ্য মৃত্যুর পর কাফকার আরো তিনটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। কারণ ? ম্যাক্স ব্রড কথা রাখেনি। ভাগ্যিস ব্রড কথা রাখেননি। শুধু তাই নয় ব্রড কাফকার পুরনো লেখা গুলো নতুন করে ছাপানোর জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে দারে দারে ঘুরে বেরিয়েছেন।
কাফকা তার ছোট জীবনের প্রায় সবটাই প্রাগে কাটিয়েছেন। ১১ জুন তাকে সমাধিস্থ করা হলো প্রাগের জেলিস্কেহো রেলস্টেশনের পাশে নতুন ইহুদি কবরস্থানে। প্রায় ১০০ লোক জড়ো হয়েছিল তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। বন্ধু ম্যাক্স ব্রড সেখানে মৃত্যুর গাথা পাঠ করেছিলেন। আর যখন শবাধারটি কবরে নামানো হচ্ছিল, ডোরা নিজেকে কবরের মধ্যে বারবার ছুড়ে ফেলতে চাইছিলেন।
বেঁচে থাকতে ফ্রানৎস কাফকা তার বাবা মায়ের কাছ থেকে মুক্তি পান নি, এমনকি মৃত্যুতেও না ; তারা আছেন তার সঙ্গে একই কবরে, একই কবরফলকের নিচে।