১৫ শতকের ইংল্যান্ডে ইয়র্ক ও ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ান নামে দুই রাজপরিবার ছিলো। দুই পরিবারই ক্ষমতার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চালিয়েছে। দীর্ঘ সেই যুদ্ধে ধারণা করা হয় প্রায় ১ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। পরবর্তী কালে ইতিহাসবিদরা দুই রাজপরিবারের এই যুদ্ধকে ‘ওয়ার অব দ্য রোজেজ’ নামে নামকরণ করেন।
ইয়র্ক ও ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ানদের মধ্যে ১৪৫৫-১৪৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে দুই পক্ষই তাদের পতাকায় গোলাপের চিহ্ন বহন করেছিল। ইয়র্কিস্টদের পতাকায় ছিল সাদা গোলাপ আর ল্যাঙ্কাস্ট্রিয়ানদের পতাকায় ছিল লাল গোলাপের ছবি। যুদ্ধ শেষ হয় দুই পক্ষের মধ্যে এক বিবাহ সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে। নতুন রাজবংশ হিসাবে টিউডররা আত্মপ্রকাশ করে। তখন রাজকীয় প্রতীকে গোলাপই থাকে কিন্তু লাল গোলাপের অন্তঃস্থলে সাদা অংশ রাখা হয়।
দীর্ঘ ৩২ বছরের এই যুদ্ধে দুই পরিবারের মধ্যে ঘটেছে অনেক ঘটনা। আজ তেমনই ৫ টি তথ্য জানাবো ওয়ার অব দ্য রোজেজ অর্থাৎ গোলাপের যুদ্ধ সম্পর্কে।
রাজা ষষ্ঠ হেনরি ওয়ার অব দ্য রোজেজ এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী ছিলেন
এই যুদ্ধের জন্য রাজা ষষ্ঠ হেনরিকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী ভাবা হলে ভুল হবে, তবে এই যুদ্ধে যে অন্য যে কারো থেকে তার দায় সবচেয়ে বেশি তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
রাজা হেনরি ছিলেন শান্তিপ্রিয়, সেই সঙ্গে একজন ধর্মভীরু রাজা। তিনি তার স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত ও তার ছেলেদের প্রতি সদয় ছিলেন। তবে শাসক হিসেবে তিনি ভালো ছিলেন না। তার কূটনীতিক ভুলের কারনে ইংলিশরা ফরাসিদের সাথে নতুন করে সংঘাতের সাথে জড়ায়। আর সেই সংঘাতে হেরে গিয়ে ইংলিশ চ্যানেলেরা একটা বিশাল অংশ ইংরেজরা ফরাসিদের কাছে হারায়।
সেসময় বহু লোক লোক রাজা হেনরির নির্বাচিত মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো তারা দূর্নীতি ও পক্ষপাতে সম্পৃক্ত। আর এর ফলে ১৪৫০ সালে জ্যাক ক্যাডের বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। সেসময় বিদ্রোহীরা রাজা হেনরিকে তার দূর্নীতিগ্রস্থ মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের তাদের পদ থেকে অপসারণ করার আহ্বান জানায়।
ইয়র্ক রাজবংশের রিচার্ডও রাজার প্রতি হতাশ ছিলেন। তৃতীয় এডওয়ার্ডের বংশধর হিসেবে রিচার্ডের সিংহাসনে আহরণ করার প্রধান দাবিদার ছিলেন। যদিও ১৩৯৯ সালে হেনরি চতুর্থ সিংহাসন দখল করার পর থেকে ল্যানকাস্ট্রিয়ান রাজবংশ ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু রিচার্ড এটি পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করেছিলেন, যদি এর পরিণতির ফল গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তবুও!
এই যুদ্ধ নিরবচ্ছিন্ন ৩২ বছর ধরে চলে নি!
ইতিহাসবিদদের মতে, গোলাপের যুদ্ধ ১৪৫৫ সালে সেন্ট অ্যালবানসের যুদ্ধের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এবং ১৪৮৭ সালে স্টোক ফিল্ডের যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই দীর্ঘ ৩২ বছরের মধ্যে কোনো বছরে ছোটখাটো সংঘাত হয়েছে, আবার কোনো বছরে দু’পক্ষের মাঝে কোনো সংঘাতই হয়নি। কিন্তু ইতিহাসের বইগুলো পড়লে মনে হয়; বুঝি দুই পরিবারের মধ্যে দীর্ঘ ৩২ বছর বিরতিহীন যুদ্ধ হয়েছে।
এই যুদ্ধে শহর বা গ্রাম কোনো কিছুই যুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। যুদ্ধের জন্য নাগরিকদের নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়নি। তবে এটা সত্যি যে শহরের অনেক নাগরিকই অস্ত্র-শস্ত্র বা তীরন্দাজ হিসাবে যুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং সেখানে প্রচুর অ্যাল্ডারম্যানও ছিল যারা তারা যে পক্ষই জয়ী হতে চায় তাকে অর্থ ধার দিয়েছিল।
তবে যতো যাই হোক নাগরিকরা কষ্ট ছাড়া ছিলো না এটাও অস্বীকার করা যাবে না। ১৪৬৪,৭১,৭৯ ও ১৪৮৫ এই বছরগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে একবারও সংঘর্ষ হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। এই বছরগুলোতে ইংল্যান্ডে প্লেগ মহামারি কয়েক ধাপে ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়াও সে সময় ‘sweating sickness’ অর্থাৎ ঘামের রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগ এতোটাই ভয়ংকর ছিলো যে কেউ এর দ্বারা আক্রান্ত হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মারা যেতো।
আর্ল অব ওয়ারউইক ছিলেন গোলাপ যুদ্ধের প্রধান ব্যক্তি
রিচার্ড নেভিল একটি শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সালিসবারির রাজ্যের উত্তরাধিকারী হওয়ার পাশাপাশি, তিনি ১৪৩৬ সালে অ্যান বিউচ্যাম্পকে বিয়ে করার পর ওয়ারউইক রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন এবং এরপর থেকে তিনি আর্ল অফ ওয়ারউইক নামে পরিচিতি পান।
গোলাপের যুদ্ধের সময়, ওয়ারউইক ইয়ার্কিস্টদের সাথে যোগ দেওয়ার আগে ল্যানকাস্ট্রিয়ানদের পক্ষে ছিলেন। ইয়র্কের রিচার্ড ওয়ারউইককে ক্যালাইসের ক্যাপ্টেন বানিয়েছিলেন, তার ক্ষমতা আরও বাড়িয়েছিলেন। ১৪৬২ সাল নাগাদ, তিনি দেশের অন্যতম ধনী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। আর এজন্যই ওয়ার অব দ্য রোজেজ নামে যেসব গল্প বা উপন্যাস তৈরি হয়েছে তাতে ওয়ারউইক কে ‘কিংমেকার’ নামে পরিচয় দেওয়া হয়। ১৪৬১ সালে টাউটনের যুদ্ধে তার অংশগ্রহণের পর, এডওয়ার্ড চতুর্থ (ইংল্যান্ডের নতুন রাজা) ওয়ারউইককে ইংল্যান্ডের উচ্চ অ্যাডমিরাল বানিয়ে পুরস্কৃত করেন।
যাই হেক গোলাপের যুদ্ধে ওয়ারউইক এর শেষটা মোটেও ভালো হয়নি। ল্যানকাস্ট্রিয়ান পক্ষের কাছে তার আনুগত্য পরিবর্তন করে ইয়র্কদের পক্ষে যোগ দেওয়া আর্ল অব ওয়ারউইক ১৪৭১ সালে বার্নেটের যুদ্ধের রণক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন।
গোলাপের যুদ্ধের সময় দুই রাজকুমার নিখোঁজ হয়েছিলেন
১৪৮৩ সালে রাজা চতুর্থ এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর, তার ১২ বছর বয়সী ছেলে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হন। কিন্তু রাজ্যাভিষেকের আগে, ছেলেটি তার ছোট ভাই সহ – গ্লুসেস্টারের ডিউক রিচার্ড দ্বারা বন্দী হয়েছিল।
রিচার্ড, ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হতে আগ্রহী ছিলো, আর তাই তিনি তার ভাগ্নেদের অবৈধ ঘোষণা করেন। আর এই ঘোষণাই তাকে ইংরেজ সিংহাসনের সঠিক উত্তরাধিকারী করে তোলে। টাওয়ার অফ লন্ডনে তালাবদ্ধ হওয়ার পরে, যুবরাজদের আর কখনও দেখা যায়নি এবং তাদের চাচা ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় রিচার্ড ও হয়েছিলেন।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন যে রিচার্ড তার ভাগ্নেদের হত্যা করেছিলেন, বা – অন্ততপক্ষে – তিনি তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যাইহোক, কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছেন যে হেনরি স্ট্যাফোর্ড বা হেনরি টিউডর ও এই অপরাধের পিছনে ছিলেন, কারণ তাদের উভয়েরই সিংহাসনের দাবি ছিল।
এই যুদ্ধ কে সবসময় গোলাপের যুদ্ধ নামে ডাকা হতো না
শুরতেই বলেছি, গেলাপের যুদ্ধ হাউস ইয়র্কের সাদা গোলাপ এবং হাউস ল্যাঙ্কাস্টারের লাল গোলাপের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছিল। যাইহোক, যদিও গোলাপের যুদ্ধের সময় ইয়র্কবাদীরা তাদের পতাকায় সাদা গোলাপ যুক্ত করে চিহ্নিত করেছিলেন। ইতিহাসবিদরা লাল গোলাপের ল্যানকাস্ট্রিয়ান ব্যবহার সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। শুধুমাত্র হেনরি সপ্তম এর রাজত্বকালে লাল গোলাপটি হাউস ল্যাঙ্কাস্টারের একটি সাধারণ প্রতীক হয়ে উঠেছিল, কারণ এটি টিউডর গোলাপে দুটি রাজবংশের মিলনকে প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যবহৃত হয়েছিল, যাতে লাল এবং সাদা উভয়ই ছিল।
ইতিহাসবিদরা ‘দ্য ওয়ার্স অফ দ্য রোজেস’ নাম কিভাবে এসেছে তার খোঁজতে গিয়ে দেখেছেন ডেভিড হিউম এর ‘দ্য হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড’ বইতে এই শব্দের ব্যবহার রয়েছে; যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৫০ এর দশকে। কিছু কিছু ইতিহাসবিদ যুক্তি দেন যে ওয়াল্টার স্কটই প্রথম ব্যক্তি যিনি তার ঊনবিংশ শতাব্দীর উপন্যাস ‘অ্যান অফ গেইয়ারস্টেইনে’ এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
এই যুদ্ধের নাম হাউজ অব দ্য রোজেস যেভাবেই আসুক না কেনো। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সে সময় যারা এই যুদ্ধের অংশ ছিলেন, তাদের কাছে এই নাম অপরিচিতই ছিলো।
Reference
Great Tales from English History (2005) by Robert Lacey
The Wars of the Roses: A Concise History (1986) by Charles Ross
A Brief History of the Wars of the Roses (2007) by Desmond Seward