চীনা সভ্যতা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও উল্লেখযোগ্য সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইতিহাসবিদদের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের কাছাকাছি সময় থেকে এই সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। হলুদ নদী (Yellow River) অঞ্চলে প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজ গড়ে ওঠার মাধ্যমে চীনা সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
৫০০০ বছরের পুরনো সভ্যতায় বিভিন্ন রাজবংশের শাসন চলেছে প্রায় ২ হাজার বছরের অধিক সময় ধরে। চীনে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে চীনা সম্রাট Qin Shi Huang এর শাসনের মাধ্যমে। তিনিই সর্বপ্রথম পুরো চীনকে একত্রিত করেন, এরপর বিভিন্ন রাজবংশের ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমে ১৯১২ সালে চীনা সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে Qing (কিং) রাজবংশের পতনের মাধ্যমে।
প্রায় ২ হাজারের বছরের বেশি স্থায়ী হওয়া সাম্রাজ্যের এই ইতিহাস বর্ণঢ্য ও চমৎকৃত ক্ষমতার পালাবদলের ঘটনার সংখ্যা অনেক। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতার এই পালাবদলে যে কেবল সব সম্রাটই রাজ বংশে জন্মেছেন বা আরাম আয়েশে বেড়ে উঠেছেন তা নয়। অনেক সম্রাটই নীচু সামাজিক স্তর থেকে কঠোর পরিশ্রম ও যোগ্যতায় সম্রাট হয়েছিলেন। এমন কিছু সম্রাটদের সম্পর্কে জানাবো, যারা সম্রাট হবার আগে ছিলেন সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান।
ঝু ইউয়ানঝাং: প্রথম মিং সম্রাট
মিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট ঝু ইউয়ানঝাং ১৩২৮ সালে চীনের হাওঝোর এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার শৈশব এতোটাই অভাব অনটনের মধ্যে ছিলো যে ক্ষুধার কষ্টের সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে তার পরিবার গাছের ছাল ও ঘাস খেয়ে দিনযাপন করতো।
ঝু ইউয়ানঝাং এর বয়স যখন মাত্র ১৬ বছর তিনি তার মা-বাবা ও ভা-বোনদের হারিয়ে এতিম হয়ে যান। আর তাই বাধ্য হয়ে নানজিংয়ের কাছাকাছি এক মঠে আশ্রয় নেন সেখানে পড়ালেখা করে বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেন। মঠে আসার পর তার মাথায় ছাদের আশ্রয় জুটলেও খাবারের জন্য তাকে ভিক্ষা করতে হতো। তবে মঠের এই জীবন বেশিদিন তার স্থায়ী হয়নি। বয়স বিশের কোঠায় পৌঁছানের আগেই তাকে মঠ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।
ঝু ইউয়ানঝাং মঠ ছাড়ার পর তিনি ১৩৫১ সালে হওয়া লাল পাগড়ি বিদ্রোহ বা Red Turban Rebellion এ যোগদান করেন। এই বিদ্রোহ ছিলো তখনকার ইউয়ান সাম্রাজ্যের দূর্বল শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ। ঝু ইউয়ানঝাং তার নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে এই বিদ্রোহের প্রধান নেতাদের কাতারে চলে আসেন।
ঝু ইউয়ানঝাং মানুষের আস্থা অর্জন করে ধীরে ধীরে চীনের অধিকাংশ অংশ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। অবশেষে প্রবল আন্দোলন ও বিদ্রোহের মাধ্যমে ১৩৬৮ সালে তিনি ইউয়ান সাম্রাজ্যের পতন ঘটান এবং নিজেকে মিং সাম্রাজ্যের সম্রাট ঘোষণা করেন।
সম্রাট হবার পর তিনি চীনের অর্থনীতি ও কৃষির পুনর্গঠন করেন। জমিদারদের জবরদখলকৃত জমি ও সম্পত্তি তিনি দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বন্টন করেন। সাম্রাজ্যের রাজস্ব আদায় পদ্ধতি আরো সহজ করেন। সেই সাথে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সৃষ্টি করেন। তার শাসনকার্য ছিলো খুবই কঠোর, সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল।
শাসক হিসেবে ঝু ইউয়ানঝাং কঠোর প্রকৃতির হলেও তিনি একজন বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। নিজে একজন দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসায় তিনি সাধারণ মানুষজনের কষ্ট বুঝতে পারতেন। তাদের দুঃখ কষ্টের সমাপ্তি ঘটাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তবে ক্ষমতায় শেষ দিকে এসে তিনি কিছুটা সন্দেহপ্রবন হয়ে উঠেন। সন্দেহের বশে তিনি রাজদরবার ও সামরিক বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তিনি মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন।
১৩৯৮ সালে ঝু ইউয়ানঝাং মৃত্যু হয়। তবে তার প্রতিষ্ঠিত মিং সাম্রাজ্য টিকে ছিলো আরো প্রায় ৩০০ বছর ধরে। দরিদ্র পরিবারে জন্মেও ক্ষমতার শীর্ষে উঠে ঝু ইউয়ানঝাং এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন যা এখনো সাধারণ মানুষের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
লিউ ব্যাং (Liu Bang): চীনের হান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা
লিউ ব্যাং খ্রিস্টপূর্ব ২৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন এক দরিদ্র কৃষক। তাদের পরিবার ও পরিবারের মানুষদের জীবন ছিল দুঃখ-দুর্দশায় ভরা, কারণ তারা চীনের Qin সাম্রাজ্যের কঠোর শাসন এবং করের নীতির শিকার ছিলেন।
যুবক বয়সে লিউ ব্যাং এর কোনো সামরিক কিংবা রাজকীয় কোনো উচ্চবর্গের সাথে সম্পর্ক ছিলো। পেশায় তিনি ছিলেন সাধারণ গ্রামের এক নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। সেসময় চীনের কিং শাসন একদমই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। Qin Dynasty এর কঠোর শাসন ও উচ্চ করের কারণে সমগ্র চীনে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল।
লিউ ব্যাং সেসময়ে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে একজন সুকৌশলী ও শক্তিশালী নেতায় পরিণত করেন। বিদ্রোহের মাধ্যমে Qin Dynasty এর পতন হলে লিউ ব্যাং খ্রিস্টপূর্ব ২০২ সালে চীনের সম্রাট হন এবং হান সাম্রাজ্যের (Han Dynasty) প্রতিষ্ঠা করেন।
সম্রাট হবার পর লিউ ব্যাং আগের Qin Dynasty এর কঠোর করের নীতির পরিবর্তন করেন। কৃষি ও অর্থনীতির সংস্কার করেন এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন। লিউ ব্যাং ছিলেন চীনের ইতিহাসের একজন প্রভাবশালী সম্রাট। তার সময়ে চীনের সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, জ্ঞানচর্চা ও অর্থনিতীতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিলো।
লিউ ব্যাং বলতেন,
“জনগণের সুখ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই একজন শাসকের প্রধান কাজ।”
লিউ ব্যাং খ্রীষ্টপূর্ব ১৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ দীর্ঘ ৪০০ বছরের অধিক সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে ছিলো। ইতিহাসের পাতায় আজো তার প্রতিষ্ঠিত এই সাম্রাজ্য অনতম গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্য হিসেবে স্বীকৃত। অথচ তার জীবন ছিলো খুবই কষ্টের ও সাদামাটা। আর সেখান থেকেই তিনি এক অভূতপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।