এলিজাবেথ ব্যাথরি তার সমসাময়িক সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের মধ্যে একজন বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। তবুও, তার চরিত্র এবং আচরণ কম আকর্ষণীয় ছিল।
একজন ধনী এবং সুশিক্ষিত হাঙ্গেরিয়ান কাউন্টেস (আগেকার দিনে বিশেষ করে ইউরোপের রাজারা তাদের ধনী প্রজা/ জমিদার কে কাউন্টস উপাধি দিতেন) হয়ে উঠেন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সিরিয়াল কিলারদের একজন। এলিজাবেথ ব্যাথোরি আনুমানিক ৬০০ এর বেশি কুমারি নারীকে হত্যা করেছিলেন। সেসব কুমারী মেয়েদের রক্ত দিয়ে তিনি রক্ত স্নান করতেন। এলিজাবেথ বাথোরির ধারণা ছিলো কুমারী মেয়ের রক্ত দিয়ে স্নান করলে তার শরীরের রূপ চিরদিনের জন্য তরুণ নারীদের মতো থাকবে।
প্রাথমিক জীবন
১৫৬০ সালের ৭ আগস্ট হাঙ্গেরির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের নির্বাটোরের একটি সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এলিজাবেথ ব্যাথরি। তার বাবা জর্জ এবং মা আনা ব্যাথরি তখন ট্রান্সিলভেনিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন।
এলিজাবেথ ব্যাথরির প্রাথমিক জীবন বেশিরভাগই অজানা, যদিও ইতিহাসবিদরা কিছু জিনিস উন্মোচন করেছেন। এলিজাবেথ ব্যাথরি তার মায়ের পরিবারের মাধ্যমে প্রোটেস্টেন্ট খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। হাঙ্গেরিয় অভিজাত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এই দীক্ষা একপ্রকার রীতি বা সংস্কার ছিলো।
এলিজাবেথ ব্যাথোরির বাবা জর্জ মৃগী রোগী ছিলেন। এলিজাবেথ ব্যাথরিও সেই রোগটি জিন উত্তরাধিকারসূত্রে বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। এজন্য ছোটবেলায় তার বেশ কয়েকবার গুরুতর খিঁচুনি হয়েছিল।
এছাড়াও তিনি ছিলেন প্রচন্ড রকমের রাগী ও বদমেজাজি।
ছোটবেলা থেকেই এলিজাবেথ ব্যাথরি ভয়ানক সব অত্যাচারের দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত ছিল। সেইসব ভয়ানক ঘটনার একটি ঘটনা এমন ছিল যেখানে এলিজাবেথ দেখে একটি জীবন্ত ঘোড়ার পেট কেটে তাতে একজন অপরাধীকে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় এবং তারপর আবার পেট টা সেলাই করে দেয়া হয়। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘোড়া আর অপরাধী দুইজন ই মারা যায় ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। মনে করা হয় এইরকম ভয়ানক দৃশ্য তার ভিতরের হিংস্রতা কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে একটি জারজ সন্তানের জন্ম দেয় এলিজাবেথ ব্যাথরি। ১৫৭৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে কাউন্টেস এলিজাবেথ ব্যাথরি কে ‘ফেরেঙ্ক নাডাসডি’ নামে একজন সেনাবাহিনীর কমান্ডারের সাথে বিয়ে দেয়া হয়। এই নাডাসডিও প্রচন্ড রকমের হিংস্র ছিলেন বলে গুজব আছে। তিনি নাকি যুদ্ধে বন্দী সাধারণ মানুষের উপর নৃশংস নির্যাতন চালাতেন। যাই হোক সে ব্যাপারে না আগাই।
এই নবদম্পতি ‘ক্যাসেল কাচটিসে’ বসবাস করতে শুরু করেন। ১৫৮৫ সালে তারা ঐ স্থান ত্যাগ করে ততোদিনে এলিজাবেথ ব্যাথরি ৪ বার সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
এরপর থেকে যাওয়ার পরেই এলিজাবেথ ব্যাথরির নিষ্ঠুর অপকর্মের শুরু হয়। বেশ কয়েক বছর হত্যাকান্ড চলার পর বাথোরির নিষ্ঠুরতার ব্যাপারে গুজব শুরু হয়। একসময় তা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। লোকজন এলিজাবেথ ব্যাথরি কে ‘রক্ত পিপাসু ’ নামে আখ্যা দেয়।
কিভাবে তিনি রক্তাক্ত পিপাসু হয়ে উঠলেন?
১৫৭৮ সালে অটোমানদের আক্রমণের সময় নাদাদি মানে এলিজাবেথ ব্যাথরির স্বামী বাড়ি থেকে অনেক দূরে দীর্ঘদিন কাটিয়েছিলেন তখন তিনি হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। এলিজাবেথ সম্ভবত এর ফলে বিরক্ত হয়েছিলেন।
১৫৮৫ সাল থেকে তিনি ও আরো ৫ জন লোক (এই ৫ জনের মধ্যে ৩ জন ছিলেন আদালতের পুরনো কর্মচারী), একজন ‘আনা দূর্বোলা’ (তিনি পরবর্তীতে এলিজাবেথ ব্যাথরির প্রেমিকা হয়ে উঠেন, মানে এলিজাবেথ ব্যাথরি সমকামী নারী ছিলেন) আর ছিলেন জ্যানোস উজভারি নামে একজন যুবক। সে এলাকার তরুণ আদালতের কর্মীদের এবং তরুণীদের নির্যাতন ও হত্যা করতো।
এলিজাবেথ ব্যাথরির মাথায় অদ্ভুদ চিন্তা ভর করে, তার প্রবল বিশ্বাস হয়ে উঠে অল্পবয়সী কুমারী মেয়েদের রক্ত দিয়ে স্নান করলে এবং রক্ত পান করলে তিনি ‘চির যৌবন’ লাভ করবেন।
প্রচলিত একটি গল্প আছে ১৫৮৫ সালের দিকে একটি অল্পবয়সী মেয়ে দাসী ভুলভাবে এলিজাবেথের চুল খুব জোর করে ব্রাশ করে, আর তাই এলিজাবেথ ব্যাথরি সেই দাসীকে খুব নিষ্ঠুরভাবে চড় মেরেছিল। ফলে ঐ দাসীর মুখ থাপ্পড়ে রক্তের মতো লাল হয়ে গিয়েছিল। এলিজাবেথ তখনই লক্ষ্য করলেন যে মেয়েটির গায়ের রং আরও বেশি তারুণ্যময় বলে মনে হচ্ছে।
যেহেতু তার বিশ্বাস ছিলই কুমারী মেয়েদের রক্ত পান ও স্নান করলে তার ‘চীর যৌবন’ লাভ হবে। সেজন্য তিনি তার বিশ্বস্ত কিছু কর্মচারীকে মেয়েটিকে কেটে তার রক্ত বের করার আদেশ দেন। এরপর সেই মেয়ের রক্তে তিনি স্নান করেন। এরপর থেকে বহুবছর চলতে থাকে তার নৃশংস কর্মকাণ্ড।
১৬০৪ সালে এলিজাবেথ ব্যাথরির স্বামী যুদ্ধে সংক্রমিত ক্ষতের কারনে মারা যায়। ফলে এলিজাবেথ তার স্বামীর সকল সম্পত্তি নিজের নামে পান।
তার স্বামীর মৃত্যুর পর, তিনি প্রথম কাজটি করেছিলেন তার বিচ্ছিন্ন শাশুড়ি উরসুলাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে। এরপরের ৫ বছর এলিজাবেথ নির্বিচারে কুমারী মেয়েদের হত্যা করতে থাকেন।
এলিজাবেথ ব্যাথরির দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ‘আনা দুরভোল্যা’ ১৬০৯ সালে মারা যায়। দীর্ঘদিন গরীব ঘরের মেয়েদের হত্যা করার পর এলিজাবেথ ব্যাথরি এবার মধ্যবিত্ত ও ধনী শ্রেণীর মেয়েদের দিকে হাত বাড়ায়। এতেই এলিজাবেথ ব্যাথরির পাপ প্রকাশিত হয়ে যায়। গরীর ঘরের খবর কেউ রাখতো না কেউ সেসবের খোঁজ করতেও সাহায্য করতো না, ফলে গরীব পরিবার রা চুপ করে বসে থাকতো। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও ধনীরা চুপ করে বসে থাকে নি, তারা সেসব বিষয়ে খোঁজ খবর চালাতে ও তদন্ত করতে শুরু করে।
সর্বশেষ যে হত্যা টি এলিজাবেথের কাল হয়ে দাড়ায় সেটি হল একটি গানের দলের প্রধান মেয়ে কে যখন সে হত্যা করে।
যেভাবে ধরা পড়লেন এলিজাবেথ ব্যাথরি
হাঙ্গেরির রাজা দ্বিতীয় ম্যাথিয়াসের আদেশে কাউন্ট গাইর্গি থুরজো, ১৬০৯ সালের ডিসেম্বর, মাসে আকস্মিক ভাবে এলিজাবেথ ব্যাথরির বাড়ি তল্যাসি করতে যান। এর জন্য এলিজাবেথ ব্যাথরি একদম প্রস্তুত ছিলেন না।
সেখানে তল্লাসি চালিয়ে এলিজাবেথ ব্যাথরির বাড়ি থেকে কাউন্ট গাইর্গি থুরজো অনেকগুলো আহাত ও প্রায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মেয়েদের উদ্ধার করেন। শুধু তাই নয় পুরো বাড়ি তে আরো ৫০ টি মৃতদেহ ও আবিষ্কার করেন।
সাথে সাথেই এলিজাবেথ ব্যাথরি কে গ্রেপ্তার করা হয়। এলিজাবেথ ব্যাথরি কে সাহায্য করা তার কর্মচারীরা সব নৃশংস ঘটনাগুলো বিচারের সময় প্রকাশ করে। যখন তার বিচার করা হয় তখন প্রধান দুই সহযোগীর ভাষ্যমতে সে ৫০ জন মেয়েকে হত্যা করেছিল, এবং তৃতীয় জনের মতে ৮০ জন। এই ৮০ জন মেয়ের হত্যার দায়ে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আসলে তার হত্যা করা নারীর সংখ্যা ছিল ৬৫০ এরও অধিক যা জানা যায় নিজের হাতে লিখা ডায়েরি থেকেই।
এলিজাবেথ তার অভিজাত্য এবং প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের প্রভাবের কারণে মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা পান। কর্তৃপক্ষ তাকে তার নিজের দুর্গে (যেখানে এলিজাবেথ ব্যাথরি থাকতো) সেখানে। যে রুমে তাকে বন্দী করা হয় তা পুরোপুরি বদ্ধ ছিলো, সামান্য একটু খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল যাতে সে খাবার এবং পানীয় পেতে পারে।
এলিজাবেথ বাথরির তিনজন সহযোগীকে জেলখানায় নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল, আর চতুর্থ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
এলিজাবেথের সম্পদ তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগ করা হয়েছিল।
এলিজাবেথ ব্যাথোরি ২১ আগস্ট, ১৬১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন,তাকে গৃহবন্দী করার কয়েক মাস পরে। এলিজাবেথ ব্যাথরি কে Csejte Church এর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
গুজব রয়েছে যে তার মৃতদেহ খুব শীঘ্রই কবর থেকে সরানো হয়েছিল। কেউ চায়নি এই খুনি মহিলাকে তাদের পবিত্র ভূমিতে সমাহিত করা হোক। এরপর তার স্বজনরা লাশ গ্রহণ করে অজ্ঞাত কোনো স্থানে পুনঃস্থাপন করে।