রাণী এলিজাবেথের যুগের রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনার ধ্যান-লোকের কবি স্পেন্সার। তিনি ইংরেজি কবিতায় এতো সব ক্রিয়াকৌশল ও প্যাটার্ন এনেছেন যে তার আগে ও পরে যারা সাহিত্য চর্চা শুরু করেছেন সকলেই তাকে অনুসরণ করেছেন। আর এজন্য তাকে বলা হয় পয়েটস পয়েট। ইংরেজি সাহিত্যে তিনি রোমান্টিকতার প্লাবন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। চশারের মৃত্যুর পর ইংরেজি পোয়েট্রিতে যে দীর্ঘ খড়া চলছিলো সেখানে তিনি আশীর্বাদ হয়ে হাজির হয়েছেন।
কবিদের কবি এডমন্ড স্পেনসার ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। এডমন্ড স্পেনসারের পরিচয় আর গোত্র নিয়ে পণ্ডিত মহলের সংশয়ের অভাব নেই। কেউ স্বীকার করেন তিনি অ্যান্ড্রপের অভিজাত স্পেন্সার পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবার কেউ তা অস্বীকার করেন। এই সংশয় আজো থেকে গেছে তার সমাধান হয়নি।
যাইহোক, কবি শৈশবে শিক্ষালাভ করেছেন লন্ডনের মার্চেন্ট টেলার্স স্কুলে এবং কেম্ব্রিজের প্রেমব্রোক হলে। ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রমকে হল থেকেই তিনি ম্যাট্রিক পাস করন এবং ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকেই তিনি এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তাকে দারিদ্র্যের মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়। প্রেমব্রোক কলেজে ঝাড়ুদার ও চাকরের কাজ তাকে করতে হতো। বিনিময়ে পেতেন খাদ্য ও আশ্রয়।
কঠোর পরিশ্রম করেই অধ্যয়ন করেছেন। দারিদ্র্যের আঘাত হলকে সংকুচিত করতে পারেনি। বরং দারিদ্র্যের জীর্ণদশাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে তিনি সৃষ্টির নেশায় ব্যাকুল হয়েছিলেন। তাকে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছিলেন এরিয়েল হার্ভে। হার্ভে ছিলেন প্রতিষ্ঠাবান জ্ঞানী ও কবি। তিনি স্পেন্সারের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন প্রতিশ্রুতিবান এক প্রতিভা।
কলেজেই স্পেন্সারের সঙ্গে হার্ভের পরিচয় এবং সে পরিচয় ধীরে ধীরে নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। কেম্ব্রিজ ত্যাগ করে স্পেন্সার কিছুদিন ল্যাঙ্কাসায়ারে বাস করেন। এখানেই তিনি Shepheardes Calender কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে, কাব্যটি উৎসর্গ করেন স্যার ফিলিপ সিডনিকে। হার্ভেই স্যার ফিলিপ সিডনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন স্পেন্সারের। সম্ভবত ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্পেন্সার কবিখ্যাতি লাভ করেন এবং কাব্য জগতের নতুন তারকারূপে চিহ্নিত হন।
সিডনি এবং তার খুল্লতাত আর্ল অব লিসিস্টার স্পেন্সারকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করায় সাহায্য করেন। তাদেরই সহযোগিতায় ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে স্পেন্সার আয়ারল্যান্ডে লর্ড ডেপুটি গ্রে দি উইলটনের প্রাইভেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।
আয়ারল্যান্ডে সে সময় ডেসমন্ড বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থান ঘটল। লর্ড গ্রে দি উইলটন নির্মমভাবে সে অভ্যুত্থান দমন করলেন। উইলটনের ব্যবস্থাকে সমর্থন জানিয়ে স্পেন্সার প্রবন্ধ রচনা করলেন, “এ ভিউ অব দি স্টেট অব আয়ারল্যান্ড”। পুরস্কারস্বরূপ পেলেন মুনস্টার-তিনহাজার একর জমি, এবং কর্কের কিলকলম্যান প্রাসাদ।
১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ড থেকে উইলটন চলে আসার পরে তিনি সেখানে রয়ে গেলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর বিখ্যাত কাব্য “ফেয়ারী কুইন” রচনা করতে লাগলেন। ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার ওয়ালটার ব্যালে তার বাড়িতে বেড়াতে এলেন। তাকে কবি দেখালেন তাঁর কাব্যের পাণ্ডুলিপি। র্যালে কাব্যটি পাঠ করে অবিলম্বে তা প্রকাশ করবার জন্য অনুরোধ জানালেন কবিকে। স্পেন্সার এলেন লন্ডনে। দেখা করলেন রানি এলিজাবেথের সঙ্গে। রানি তাঁকে ৫০ পাউন্ড ভাতা মঞ্জুর করলেন এবং ‘ফেয়ারী কুইন’ কাব্য প্রকাশনার ব্যয়ও মঞ্জুর করেছিলেন। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি প্রকাশ হওয়া মাত্রই কবির কবিখ্যাতি সমগ্র ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ল। কবি পেলেন স্বীকৃতি। মর্যাদার আসন পেলেন কাব্যের জগতে।
দুবছর লন্ডনে বাস করে ১৫৯১ খ্রীস্টাব্দে ফিরে এলেন আয়ারল্যান্ডে। লন্ডনে থাকার সময় তিনি যে কাব্যটি রচনা করেন তা হলো, “কলিন্স ক্লাউটস্ কাম হোম এগেন”। তার রচনার একটি শ্রেষ্ঠ ফসল। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জুন কবি এলিজাবেথ বয়লীকে বিবাহ করেন। ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে কবি পুনরায় ইংল্যান্ডে এলেন। “ফেয়ারী কুইন” কাব্যের আরো কয়েকটি খণ্ড প্রকাশ করলেন। ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে ফিরে এলেন আয়্যারল্যান্ডে । এবারের প্রত্যাগমন হতাশা আর ব্যর্থতায় ভরা, কারণ কবি তার শত্রুদের চক্রান্তে এলিজাবেথের দরবারে কোনো কিছুই সুবিধা করতে পারেননি।
১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কর্কের শেরিফ নিযুক্ত হন। এই সময় টাইরন বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থান ঘটে। বিদ্রোহীরা স্পেন্সারের কিলকলম্যান প্রাসাদের নিকটবর্তী বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ লাল হয়ে উঠল। বিদ্রোহীরা এগিয়ে আসতে লাগল প্রাসাদের দিকে। সময় থাকতে পালাবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি কবি। কারণ তার স্ত্রী অসুস্থ। সদ্য জন্ম দিয়েছেন একটি শিশুর। কেমন করে তিনি রুগ্ন-স্ত্রী-কে নিয়ে পালাবেন। দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় লক্ষ্য করলেন প্রাসাদের চারদিক ঘিরে ফেলেছেন বিদ্রোহীরা, আগুন লাগিয়েছে প্রাসাদের কোণে কোণে। তখন আর উপায়ান্তর না দেখে কবি সদ্য প্রসূতি আর চারটি সন্তানকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেলেন। ফেলে গেলেন সদ্যোজাত শিশুটিকে আগুনের কবলে। অসহায় সর্বস্ব নিঃস্ব কবি এসে উপস্থিত হলেন স্যার টমাস নরিসের বাড়িতে।
স্যার নরিস বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট তৈরি করে স্পেন্সারকে পাঠালেন ইংল্যান্ডে। স্পেন্সার রিপোর্টটি পৌঁছে দিলেন বটে কিন্তু রানি এলিজাবেথের সঙ্গে বিরোধীদের চক্রান্তে দেখা করতে পারলেন না। সহায়হীন, সম্বলহীন, কপর্দকহীন নিঃস্ব কবি অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবং রোগের তীব্রতায় কিং স্ট্রিটের একটি বাড়ির নোংরা গৃহে শুশ্রূষাবিহীন পরিচর্যাবিহীনভাবে কবি ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যু সংবাদ সমস্ত জাতিকে শোকে মুহ্যমান করে তুলেছিল। রানি এলিজাবেথ ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে কবিকে সমাধিস্থ করার নির্দেশ দান করেন যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কবি চসার।
স্পেন্সারের শোকে মিছিলে যোগদান করেছিলেন শেক্সপিয়র, বেন জনসন প্রমুখ প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকারেরা এবং আরো অনেক গুণমুগ্ধ কবি ও সাহিত্যিক। তার সমাধিভূমির উপর স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য রানি এলিজাবেথ যে অর্থ মঞ্জুর করেছিলেন সেই অর্থ একজন রাজকর্মচারী কর্তৃক আত্মসাৎ করার ফলে নির্মিত হতে পারেনি। একুশ বছর পরে ডরসেটের কাউন্টেস অ্যান ক্লিফোর্ড একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন এবং তাতে একটি বাণী মুদ্রিত করে দিয়েছিলেন।
সেই বাণী হলো,
Heare lyes (Expecting the second comminge of ovr saviovr christ lesvs) the body of Edmond Spencer.
বাংলায় যার অর্থ,
আমাদের পরিত্রাতা যিশু খ্রিস্টের দ্বিতীয়বার আগমন প্রতীক্ষায় এখানে শায়িত আছেন এডমন্ড স্পেন্সার ।
রেফারেন্স: উইকিপিডিয়া,ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস,ব্রিটনিকা এনসাক্লোপিডিয়া