You are currently viewing এডগার অ্যালান পো: রহস্য সাহিত্যের জনকের বিষন্ন জীবন

এডগার অ্যালান পো: রহস্য সাহিত্যের জনকের বিষন্ন জীবন

ভৌতিক ও রহস্য সাহিত্যে তিনি আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি তার সাহিত্যকর্মে রহস্য ও ভৌতিকতার এতোটাই ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছেন যে তার নাম শুনলেই পাঠকদের মাথায় চলে আসে খুন,জীবন্ত কবর, রহস্যময় কাক কিংবা মৃত্যুর পর ফিরে আসা কোনো অদ্ভুত মহিলার দৃশ্য।

বলছিলাম অ্যাডগার অ্যালান পো এর কথা। তিনি একাধারে একজন কবি, ছোটগল্প লেখক, সাহিত্য সমালোচক এবং ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও গোয়েন্দা গল্পের স্রষ্টা।

প্রাথমিক জীবন

এডগার অ্যালান পো ১৯ জানুয়ারি ১৮০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এডগার অ্যালানে বাবা ডেভিড পো এবং মা এলিজাবেথ আর্নল্ড পো দুজনেই ছিলেন ইংরেজ বংশদ্ভূত অভিনেতা ও অভিনেত্রী।

ডেভিড পো
এলিজাবেথ আর্নল্ড পো

সংস্কৃতমণা পরিবারে জন্ম হওয়ায় তার বাবা মা তার নাম শেক্সপিয়ারের রচনা ‘কিং লেয়ার’ থেকে নাম রাখেন এডগার। ১৮১১ সালে এডগার অ্যালান পো এর মা ৩ সন্তান কে রেখে মারা যান। স্ত্রীর আকষ্মিক মৃত্যুর পর তার বাবা ডেভিড পো নিজের সন্তানদের রেখে পালিয়ে যান।

বাবা পালিয়ে যাওয়ার পর এডগার কে জন অ্যালান নামের এক ধনী তামাক ব্যাবসায়ী দত্তক নেন। ধারণা করা হয় তিনি তার গডফাদার মানে ধর্মপিতা ছিলেন। এডগারের অন্য ভাই বোনরা ও এভাবে অন্যান্য পরিবারে দত্তক হিসেবে চলে যায়।

ছোটবেলা থেকেই পো লেখাপড়ায় বেশ মেধাবী ছিলেন। জন অ্যালান চাইতেন, ছেলে বড় হয়ে তার মতো ব্যবসায়ী হবে। কিন্তু সংস্কৃতিমনা বাবা-মায়ের বীজ রয়ে গিয়েছিল তার মাঝে। তাই অল্প বয়সেই তিনি ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের বিশেষ ভক্ত হয়ে ওঠেন এবং তার মাঝে লেখক হওয়ার স্বপ্ন জেগে ওঠে।

জন অ্যালান credit: Wikipedia

এডগার অ্যালান পো কে (১৮১৫-১৮২০) এই সময়টায় স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে রাখা হয় শাস্ত্রীয় শিক্ষা দেওয়ার জন্য। এরপর তিনি রিচমন্ডে ফিরে আসেন। ১৮২৬ সালে এডগার রিচমন্ড ছেড়ে ভার্জিনিয়ায় চলে আসেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ায়’ পড়তে। সেখানে গিয়ে তাকে পড়তে হয় চরম দারিদ্র‍্যের মুখে। কারণ ভার্জিনিয়ায় থাকতে যে টাকার প্রয়োজন ছিল, জন অ্যালান তাকে তার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ টাকা দিয়েছিলেন। কাজেই খরচ যোগাতে তিনি তখন জুয়া খেলা শুরু করেন এবং আরো নিঃস্ব হয়ে যান। কয়েক মাসের মধ্যে তার দারিদ্র্য এমন পর্যায় পৌঁছে যে শীত থেকে বাঁচার জন্য তাকে তার আসবাবপত্র পোড়াতে হয়। চারিদিকে দেনা, দারিদ্র্যের লজ্জা এবং জন অ্যালানের প্রতি ক্ষোভে পো তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে রিচমন্ড ফিরে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরো হৃদয়বিদারক ঘটনা। ফিরে এসে তিনি দেখেন তার প্রেমিকা সারাহ (এলমিরা রোস্টার) এর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ মন নিয়ে তিনি আবার বোস্টন চলে আসেন।

সাহিত্য জীবন

বোস্টনে এসে তিনি ১৮২৭ সালে একটি বায়রনিক কবিতার ছোট বই প্রকাশ করেন। কিন্তু এখানেও অর্থাভাব জেঁকে ধরে তাকে। দারিদ্র‍্যের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি যোগ দেন আর্মিতে এবং নিজের নাম বদলে রাখেন অ্যাডগার এ. পেরি। কিন্তু তার সৎ মা মারা যাওয়ার পর জন আল্যান তাকে আর্মি থেকে সরিয়ে এনে ওয়েস্ট পয়েন্টে মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে মন না বসায় তিনি সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল শুরু করেন এবং অবশেষে এক সপ্তাহ টানা ড্রিল ক্লাস বাদ দেয়ার ফলে মিলিটারি একাডেমি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। এই সময়টায় পো বাল্টিমের, আল আরাফ, টেমেরেলেন এবং মাইনর পয়েমস এর একটি নতুন ভলিউম প্রকাশ করেছিলেন। মিলিটারি একাডেমি থেকে বের হয়ে তিনি এবার চলে আসেন নিউইয়র্কে এবং প্রচুর ইংরেজি সাহিত্য ও কবিতা পড়া শুরু করেন।

আরো পড়ুন:  পার্শি বিশি শেলি: নাস্তিক হওয়ায় পরিবার থেকে বিতারিত হয়েছিলেন

নিউইয়র্ক আসার পর পো বেশ কয়েকটি সম্বলিত কবিতার একটি ভলিউম বের করেন। তার এই প্রকাশিত বেশ কিছু রচনায় কীটস, শেলী এবং স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের প্রভাব দেখা যায়।

Credit: Litarariy Theory and criticism

বেশ কিছুকাল নিউইয়র্ক থাকার পর পো বাল্টিমোরে ফিরে আসেন, এখানে এসেই তিনি গল্প লিখতে শুরু করেন। ১৮৩৩ সালে তার গল্প ‘এম.এস ফাউন্ট ইন এ বোটল’ প্রকাশিত হলে বাল্টিমোরের সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে তিনি ৫০ ডলার পুরষ্কার পান, যা সে সময়ে বিশাল পরিমাণ অর্থ। এর ২ বছর পর ১৮৩৫ সালে তিনি রিচমন্ডের ‘সাউদার্ন লিটারেরি মেসেঞ্জার’ এ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। আর এ সময়ই তিনি তার ফুপাতো বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যান, অতঃপর তারা বিয়েও করেন। বিয়ের সময় অ্যাডগার অ্যালান পোর বয়স ছিল ২৭ এবং ভার্জিনিয়ার বয়স ছিল ১৩। স্বামী হিসেবে পো একজন স্নেহময় ছিলেন বলেই ধারণা করা হয়।

ভার্জিনিয়া credit: History of American women

ভার্জিনিয়া এবং পো এর সংসার বেশ সুখেই চলছিলো, তবে বেশিদিন চললো না দারিদ্র্যতা আবারো আঘাত করলো পো এর জীবনে। এবার হয়তো এজন্য পো নিজেই দায়ী। পো মদ্যাপানে আসক্ত হয়ে পড়েন, যার জন্য তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

চাকরি হারিয়ে তিনি রিচমন্ড থেকে আবার নিউইয়র্ক চলে আসেন, কিন্তু মদের নেশা আর ছাড়তে পারেন না। আর এ নেশাই তখন তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বেশ কিছু যায়গায় জনসম্মুখে মাতলামি করে মাতাল হিসেবে নামও হয়ে যায় তার। এমন অবস্থায় ১৮৩৮ সালে তিনি তার ‘দ্য ন্যারেটিভ অফ আর্থার গরডন প্যম’ বইটি প্রকাশ করেন এবং ১৮৩৯ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ‘বার্টনস জেন্টেলম্যানস ম্যাগাজিন’ এ সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। একই সালেই তার ‘টেলস অফ গ্রোটেক্স অ্যান্ড অ্যারাবস্ক’ বইটিও প্রকাশিত হয়।

১৮৪০ সালে তিনি তার চাকরিটি ছেড়ে দেন এবং ‘গ্রাহামস লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ থেকে ইতিহাসের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘দ্য মার্ডার ইন দ্য রিউ মর্গ’ প্রকাশ করেন। ১৮৪৩ সালে তার ‘দ্য গোল্ড বাগ’ গল্পটি ফিলাডেলফিয়ার ‘ডলার নিউজপেপার’ থেকে ১০০ ডলার পুরষ্কার জিতলে এটি তাকে বেশ জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ১৮৪৪ সালে তিনি আবার নিউইয়র্কে ফিরে আসেন এবং ১৮৪৫ সালের ২৯ জানুয়ারি ‘আমেরিকান রিভিউ’ থেকে তার কালজয়ী কবিতা ‘দ্য র‍্যাভেন’ প্রকাশিত হয়। এটি রাতারাতি তাকে দেশজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। এর পর বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি বেশকিছু ছোটগল্প এবং আরো কিছু বিখ্যাত লেখা প্রকাশ করেন। ভৌতিক এবং রহস্য গল্পের জন্য তার খ্যাতি বাড়তে থাকে।

Credit: Amazon

কিছু সময়ের জন্য সুখের মুখ দেখলেও এরপর আবার ঝড় নেমে আসে পোর জীবনে। ১৮৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে তিনি যখন শহরের বাইরে ছিলেন, এমন সময় তার স্ত্রী ভার্জিনিয়া টিউবারক্যুলোসিসে মারা যান। পোর জীবনে নেমে আসে বিষণ্ণতার আরেকটি গাঢ় অধ্যায়। মৃত স্ত্রীর স্মৃতি ভোলার জন্য তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে আসেন এবং বাউন্ডুলের মতো বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। ঘুরতে ঘুরতে প্রভিডেন্স রুধ আইল্যান্ডে তার দেখা হয়ে যায় প্রাক্তন প্রেমিকা সারাহ এর সাথে। সারাহও তখন বিধবা অবস্থায় ছিলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গিয়েছিল তার। সারাহকে পেয়ে তখন পোর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। সারাহ তাকে তার আর্থিক এবং মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানাভাবে সাহায্য করেন এবং একসময় তারা বিয়ের সিদ্ধান্তও নেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র দশদিন আগে ১৮৪৯ সালের ৭ই অক্টোবর অ্যাডগার অ্যালান পোর আকস্মিক মৃত্যু হয়।

আরো পড়ুন:  হিরো ওনোদা: জীবনের ৩০ বছর এক ভুল যুদ্ধে কাটানো অপরাজিত জাপানি সৈনিক

রহস্যময় পো

রহস্য সাহিত্যের জনক এডগার অ্যালান পো তার সাহিত্যের মতো জীবনেও রেখে গেছেন রহস্য। তেমনই কিছু রহস্য কথা এখানে জানাচ্ছি।

অলৌকিক মিল

মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো অনেক ছোটগল্প লিখলেও উপন্যাস লিখেছেন মাত্র একটি—ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম ন্যানটাকিট। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৮৩৮ সালে। পো দাবি করেন উপন্যাসটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক কোনো সমালোচক বা পাঠক পোর দাবিকে সত্য বলে মানতে চাননি। কিন্তু অলৌকিকভাবে বই প্রকাশের ঠিক ৫ বছর পর, উপন্যাসের ঘটনার মতো একটি জাহাজডুবি ঘটে। এমনকি ওই উপন্যাসের একটি চরিত্রের সঙ্গে বাস্তব ঘটনার একজন নাবিকের নামেরও মিল পাওয়া যায়—রিচার্ড পার্কার। শুধু তাই নয়, পোর মৃত্যুর পর ১৮৮৪ সালে আরেকটি জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে এবং পরবর্তীকালে রিচার্ড পার্কার নামের একজনের মৃত্যু হয় নরখাদকদের হাতে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বহু আগে লেখা ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম ন্যানটাকিট–এর রিচার্ড পার্কারের মৃত্যুও হয়েছিল একইভাবে।

Credit: Amazon

বিড়াল-রহস্য

এডগার অ্যালান পোর ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’ তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ভৌতিক এই গল্পে প্লুটো নামে এক কালো বিড়ালের প্রতি গল্পকথকের ভালোবাসা প্রকাশ পায়, যদিও একপর্যায়ে প্লুটোর চোখ উপড়ে ফেলা হয়। পোর লেখকজীবনেও বিড়ালের প্রতি অনন্যসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন পাওয়া যায়। যেকোনো কবিতা লেখা শুরু করার আগে পো তাঁর পরম পছন্দের এশীয় বিড়ালটিকে কাঁধে তুলে নিতেন। এরপর লিখে যেতেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা।

Credit: The Great Cate

তার মৃত্যুর পর যখন তার শাশুড়িকে যখন মৃত্যু সংবাদটি দেওয়া হয় তিনি বিড়ালটিকে মৃত অবস্থায় খুঁজে পান। পোকে নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে ব্যপারটি হলো মৃত্যুও তার লেখালেখি থামাতে পারেনি! ১৮৬০ সালে লিজ্জি ডোটেন নামের একজন মহিলা কবি বেশ কিছু কবিতা প্রকাশ করেন এবং তিনি দাবি করেন পোর প্রেতাত্মা তাকে কবিতাগুলো বলে গিয়েছেন। এ কথা শোনার পর পোর বাগদত্তা সারাহ ওই মহিলার সাথে যোগাযোগ করেন এবং তার সাথে থাকতে চলে যান এই ভেবে যে, হয়ত সেই প্রেতাত্মা তার সাথেও যোগাযোগ করবে!

অদ্ভুত মৃত্যু

মাত্র ৪০ বছর বয়সে পোর মৃত্যু হয়। সেই অকাল মৃত্যু ঘিরে থাকা রহস্যের আজও কোনো কূলকিনারা হয়নি। মৃত্যুর আগে ৫ দিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ৫ দিন পর যখন তাঁকে পাওয়া গেল, তখন তিনি শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি। ১৮৪৯ সালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে যা প্রচার করা হয় তা-ও বেশ অদ্ভুত: ‘মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক সংকোচন’। ইতিহাসবিদ ও আলোচকেরা তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিভিন্ন সময় হত্যা থেকে শুরু করে রেবিস পর্যন্ত নানান রকম কারণ অনুমান করলেও আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।

তথ্যসূত্র: কিল অ্যাজেকটিভস, ইন্টারেস্টিং লিটারেচার এবং ফ্যাসিনেটডটকম, ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া