You are currently viewing ডিটেকটিভ নিউটন

ডিটেকটিভ নিউটন

গোয়েন্দা চরিত্রের কথা বললে প্রথমেই আর্থার কনান ডয়েলের সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের কথা আমাদের মাথায় আসে। কিন্তু শার্লক হোমস সৃষ্টির আরো ২০০ বছর আগেই ইংল্যান্ডের মাটিতে ডিটেকটিভ ভূমিকা পালন করেছিলেন আমাদের প্রিয় বিজ্ঞানী নিউটন। চলুন আজ জানি বিজ্ঞানী নিউটনের গোয়েন্দাগিরির সেই ঘটনা।

সময়টা ১৬৯৬ সালের কোনো এক সকাল বেলা আমাদের বিজ্ঞানী নিউটন চা খেতে খেতে একটি চিঠি পড়ছেন। চিঠিটি নিউটনের বন্ধু চার্লস মন্টাগো পাঠিয়েছেন। তার বন্ধু ছিলেন হালিফাক্স অঞ্চলের আর্ল। চিঠিতে নিউটনের বন্ধু বলেছেন ইংল্যান্ডের রাজার আদেশ মহামান্য বিজ্ঞানী নিউটন যেন Royal Mint-এর ওয়ার্ডেন-এর পদ অলংকৃত করেন। Royal Mint হচ্ছে ইংল্যান্ডের যাবতীয় ধাতব মুদ্রা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান।

মুদ্রা তৈরির এই প্রতিষ্ঠানটি খুবই প্রাচীন। এই প্রতিষ্ঠানটি ৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে মুদ্রা তৈরির কাজ করছে, যা আজও চলমান। আর রাজা নিউটনকে এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে উঁচু পদ ওয়ার্ডেনের দায়িত্ব নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। নিউটন তখন কিছুটা বুড়িয়ে এসেছেন, বয়স প্রায় ৫৫ বছর। নিউটনকে এই পদটা রাজার পক্ষ থেকে এক প্রকার সম্মতা স্বরূপ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। নিউটন এই পদের কাজকর্ম আদৌও পারবেন কিনা সেসব বিষয় ভাবনা চিন্তা করা হয়নি। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানী মশাই তার সদ্য পাওয়া কাজটি খুবই সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন। আর তাতে লাভটা ইংল্যান্ডেরই হয়েছিল।

সেই সময়ে রাজা চতুর্দশ লুই বনাম অস্ট্রিয়ার ইউরোপিয়ান কোয়ালিশনের সাথে ৯ বছরের যুদ্ধে (১৬৮৮-১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ) ইংল্যান্ডের মুদ্রার বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। মুদ্রার মানের অবস্থা এতোটাই বেহাল দশা হয়েছে যে একটা সিলভারের মুদ্রার মূল্যমান ঐ মুদ্রার ভেতরে থাকা সিলভারের ওজনের মূল্যমানের থেকেও কম। অর্থাৎ ১ টাকার একটা সিলভার কয়েনের ভেতরে থাকা সিলভারের পরিমাণের বাজারি মূল্য ১ টাকার অধিক। সিলভারের এমন মূল্যের কারণে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সেও পাচার হচ্ছিলো সিলভারের কয়েন। তখন সরকারিভাবে ঘোষিত হলো সমস্ত সিলভারের মুদ্রা রাজকোষাগারে ফিরিয়ে দেয়ার। সেখান থেকে আবার নতুন করে সিলভার কয়েন বানিয়ে বাজারে ছাড়া হবে।

এক্ষেত্রে যা ঘটার তাই ঘটলো। শুরু হয়ে গেলো সিলভারের মুদ্রার জাল তৈরি করা। মুদ্রা জাল করার পাশাপাশি ক্লিপিং করাও শুরু হয়ে গেলো। ক্লিপিং মানে হলো কয়েনের চারপাশ থেকে একটু একটু করে সিলভার কেটে রেখে দিয়ে পরে সেই জমানো সিলভার দিয়ে আবার নতুন মুদ্রা বানিয়ে ফেলা (এইজন্যে আমাদের পরিচিত সব ধাতব কয়েনের বাইরের দেয়ালে খাঁজকাটা থাকে। কোনোভাবে এই খাঁজকাটা অংশটা না থাকলে ধরে নিতে হবে মুদ্রাটাকে কেটে বিকৃত করা হয়েছে। তখন সেই মুদ্রা বাতিল হয়ে যাবে, বাজারে আর চলবে না)।

১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের আগের সব কয়েন ক্লিপিং করা হতে লাগলো, কারণ সেগুলোর চারপাশে অমন খাঁজকাটা ছিলো না। আর ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের পরের কয়েনগুলো মেশিনে জাল করা হতে লাগলো। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো, সেই যুদ্ধের বাজারে ইংল্যান্ডের মুদ্রার ১০ শতাংশই হয়ে গিয়েছিলো এমন জাল মুদ্রা! একপর্যায়ে ঘোষণা করা হলো, যারা মুদ্রা ক্লিপিং এবং জাল করে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। এদের ধরতে পারলে সরাসরি ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।

ইংল্যান্ডের মুদ্রাবাজারের এই দিশেহারা অবস্থায় এগিয়ে এলেন নিউটন। তিনি যেহেতু তাঁর চাকরিটাকে সিরিয়াসলিই নিয়েছিলেন, তাই ভাবতে লাগলেন কিছু একটা করার। তিনি মুদ্রাগুলোকে তাদের গায়ের মূল্যে না কিনে ভেতরের সিলভারের ওজন করে নিয়ে পরে প্রতি কেজি সিলভারের মূল্যে কিনে নিতে পরামর্শ দিলেন।

সেই সাথে নিউটন শুরু করলেন আরো একটি পরিকল্পনা। ইংল্যান্ডের বিশেষত লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডে ছেলেছোকরা, ভিখারিদের দিয়ে তাঁর এক বিশাল নেটওয়ার্ক বিস্তার করতে লাগলেন। প্রায় বছর দুয়েক ধরে তিনি করেছিলেন এই কাজ। তাদের সবার থেকে তথ্য নিয়ে ইংল্যান্ডের অনেক মানুষের প্রোফাইল বানালেন তিনি। তাদের অনেকের সাথে মিশলেন। মিশে তাদের চরিত্রের প্যাটার্নের সাথে মিলিয়ে তথ্য-প্রমাণ দাঁড় করাতে লাগলেন যে, কারা আসলে ইংল্যান্ডে মুদ্রা জালকারী চক্রের মূলহোতা? নিউটন প্রায় ১০০ জনের অধিক মানুষের প্রোফাইল কাঁটাছেড়া করে সর্বশেষ ২৮ জনের একটি তালিকা তৈরি করলেন। এই ২প জনের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই নিউটন মুদ্রা জাল করার প্রমাণ জড়ো করেছিলেন। আর পরবর্তীতে তাদের সবাইকে শাস্তি হিসেবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দেওয়া হয়েছিল।

গল্পটা এখানেই শেষ করতে পারলে ভালোই ছিলো। কিন্তু গল্পের টুইস্ট এখনো বাকি আছে।

গল্পের শার্লক হোমসের যেমন ভয়ংকর শত্রু ছিলেন জেমস মারিয়ার্টি। নিউটনেরই তেমন এক শত্রু ছিলো, তার নাম ছিল William Chaloner। মারিয়ার্টির মতোই সে ছিলো ভয়ংকর মানুষ। নিউটনের এই শত্রু লোকটি ছিলেন স্বয়ং ইংল্যান্ডের রাজার প্রধান উপদেষ্টাদের একজন।

তার এই গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার পেছনে একটি প্রেক্ষাপট আছে। তাহলে আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক। ইংল্যান্ডে খ্রিস্টান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টেন্ট মতবাদীদের মাঝে সবসময় কহল লেগেই থাকতো। আমাদের নিউটনের এই শত্রু লোকটি বিভিন্ন সময়ে ক্যাথলিক বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। সে ক্যাথলিকদের কে প্রোটেস্টেন্টদের বিরুদ্ধে সন্তরাসী হামলার পরামর্শ দিতো। আর হামলার পূর্বেই ইংল্যান্ডের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হামলাকারীদের ধরিয়ে দিতো। আর নিজে হয়ে যেতেন সাধারণ মানুষের কাছে দেশপ্রেমিক ও ভালো মানুষ।

যাই হোক এবার মূল ঘটনায় ফিরে আসি।নিউটনের এই শত্রু রাজদরবারে দাবী করে বসলো যে Royal Mint এর লোকজনই বাহিরের লোকদের কাছে মুদ্রা জাল করার যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি পাচার করে দিচ্ছে। আর তাই সে আবেদন করে তাকে যেনো Royal Mint এর সকল কিছু পরিদর্শন করার সুযোগ দেওয়া হয়। সে সেখানকার সকল দূর্নীতিকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মুখোশ খুলে দেবে।

তাকে সেই অনুমতি দেয়া হলো। কিন্তু Royal Mint-এর নিজস্ব অনুসন্ধানে ধরা পড়লো ইংল্যান্ডের যেসব রুই-কাতলা লেভেলের মুদ্রা জালকারী আছে, Chaloner তাদের একজন। তখন তাকে ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে সরকারী আদেশে জেলে নিয়ে রাখা হলো। কিন্তু ৩ দিন পরেই প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো তাকে আবার। সে তখন গিয়ে নিজেই আরেকটা তদন্ত কমিটি খুললো এবং দাবী করলো Royal Mint-এর কর্ণধাররাই ইংল্যান্ডের মুদ্রা জাল এবং পাচারের সাথে জড়িত। সে ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজের কয়েকজনের নামও দিয়েছিলো তালিকায় মুদ্রা জালকারী হিসেবে।

প্রথমবার Chaloner ছাড়া পাওয়ার পরে নিউটন বেজায় চটে যান। নিউটন তার লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডের স্পাইদের জাল আরও বিস্তৃত করেন। নিউট তার স্পাইদের মাধ্যমে Chaloner এর বিরুদ্ধে সকল প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকেন। সেইসব তথ্য ও প্রমাণ নিয়ে নিউটন লন্ডনে Chalone-এর গতিবিধি এবং তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলের সাথে মেলাতে থাকেন।

১৬৯৯ সালে নিউটন Chaloner এর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করেন। ১৬৯৯ সালে নিউটনের দেওয়া রিপোর্টের পর Chaloner কে আবারো ধরে এনে আদালতে হাজির করা হয়। সে হয়তো এবারেও ছাড়া পেয়ে যেতো কিন্তু নিউটন এবার তার টুটি চেপে ধরেছিলেন। নিউটন এবং Royal Mint. তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগ পর্যন্ত নিউটনের উপস্থাপিত রিপোর্ট সম্পর্কে কাউকে কিছুই জানতে দেয়া হয়নি।

কোর্টে Chaloner এর বিরুদ্ধে ৮ জনকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে দাগী আসামীরাও ছিলো, যারা বিভিন্ন সময়ে Chaloner-এর সাথে অপরাধে জড়িত ছিলো। নিউটনের তৈরি করা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট নিয়ে এই মামলা লড়ার কাজ শুরু করা হয় ৩ মার্চ, ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে। এই মামলার বিচারক ছিলেন Sir Salathiel Lovell, যিনি ইংল্যান্ডের ইতিহাসে বিখ্যাত “ফাঁসি প্রদানকারী বিচারক” হিসেবে।

মামলা লড়াকালীন সময়ে Chaloner পাগল হয়ে যাওয়ার অভিনয়ও করেছিলেন। কারন আইন অনুযায়ী কেনো পাগলকে ফাঁসি অর্থাৎ মৃত্যুদন্ড দেওয়া যায় না। কিন্তু তার এই ছলচাতুরী আর টেকেনি। মামলার রায়ে বিচারক Salathiel Lovell তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।

১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ William Chaloner কে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর আগে Chaloner নিউটনের উদ্দেশ্যে কদর্য ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। বলা বাহুল্য আমাদের বিজ্ঞানী নিউটন মশাই সে চিঠির উত্তর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি।

Leave a Reply