You are currently viewing মৃত্যুর রেলপথ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডেথ রেলওয়ে

মৃত্যুর রেলপথ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডেথ রেলওয়ে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য জাপানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়েছিল। আর সেইসব সৈন্যদের দিয়ে থাইল্যান্ড থেকে বার্মা পর্যন্ত রেল লাইন তৈরিতে শ্রম দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল।

আর এই রেলওয়ের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ডেথ রেলওয়ে’ অর্থাৎ মরণ রেলওয়ে। এই নামকরণের কারণ ছিল এটি তৈরি করতে গিয়ে অনাহার, রোগ-বালাই, বৈরি আবহাওয়া আর জাপানী সৈন্যদের নৃশংস আচরণে বহু যুদ্ধবন্দী প্রাণ হারায়েছিল।

সেসিল ডয় নামে সেসময় ব্রিটিশ সৈন্য তখন জাপানি সৈন্যদের হাতে আটক হয়। যুদ্ধ শেষে মুক্তি পেয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান তার সেই বিভৎস দিনগুলোর অভিজ্ঞতার কথা।

সেই দিনগুলো ছিল একেবারে আদিম জীবনের মতো। মনে হচ্ছিল আমরা সভ্যতার থেকে হাজার বছর দূরে চলে গিয়েছিলাম। ঢুকে পড়েছিলাম এক ভিন্ন জগতে।

জাপানীরা যখন সিরিল ডয়কে আটক করে তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর।

বন্দী অবস্থায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এক গভীর জঙ্গলে। সেখানে তার শরীর থেকে তার পরনের সামরিক পোশাক খুলে ফেলা হয়।

তার ব্যবহৃত সকল জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। পরনের জন্য তাকে দেয়া হয় শুধুমাত্র একটি লেংটি।

বন্দী জীবনের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলছিলেন,

আজকাল আমরা যেগুলো কে খুব সাধারণ ব্যবহার্য জিনিসপত্র বলে মনে করি, যেমনঃ- খাবার প্লেট, টুথব্রাশ, তোয়ালে কিংবা গরম পানি এসব কিছুই আমাদের ছিল না। আমাদের কাছে যা ছিল তাও সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় ১৯৪২ সালের একদম শুরুর দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি সিঙ্গাপুরের পতন ঘটে। (সেই যুদ্ধে জাপান ছিল হিটলারের মিত্র-দেশ)

সে সময় প্রায় ৬০,০০০ ব্রিটিশ সৈন্য যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক হয়; সেখানে সেসিল ডয় ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।

জনবসতি থেকে বহু দূরে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে তাকে শ্রম-দাস হিসেবে আটক রাখা হয়।

তিনি আরো বলছেন,

প্রতিটি ক্যাম্পে ছিল একজন করে কমান্ডেন্ট। আর ক্যাম্পগুলোকে পাহারা দিত কোরিয়ান সৈন্যরা। ক্যাম্পের চারিদিক ঘিরে ছিল না কোন কাঁটাতারের বেড়া।

কিন্তু তারপরও আপনি সেখান থেকে পালাতে পারবেন না। কারণ সেখানে আশে পাশে কোন কিছু ছিল না। আমি যে ক্যাম্পে ছিলাম সেখানে তিন জন বন্দী পালানোর চেষ্টা করেছিল।কিন্তু তিনজনই পরে ধরা পড়ে যায়। তাদের হত্যা করার আগে তাদের দিয়েই কবর খোঁড়ানো হয়। ঐ ধরনের মানুষই ছিল ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে।

বন্দীদের মানবেতর জীবন (photo copyright)

থাইল্যান্ড থেকে বার্মা পর্যন্ত একটি রেল লাইন তৈরির কাজে জাপানীরা এই যুদ্ধবন্দীদের ব্যবহার করেছিল।এই রেলপথ দিয়ে তারা সৈন্য, খাবার, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য রসদ-পত্র আনা নেয়া করতো।এটা ছিল বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। পাহাড়-পর্বত কেটে, পাথর ভেঙে, জঙ্গল পরিষ্কার করে এই রেললাইন বসানো হয়েছিল।

জাপানিজ রা ইংরেজি জানতো না, তবে তারা কোনোভাবে ইংরেজি শব্দ ‘স্পিড’ (গতি) শিখেছিল। আর তাই দ্রুত কাজ করার জন্য তারা স্পিডো, স্পিডো বলে কড়া ভাবে ধমকাতো।

মৃত্যুর রেলপথ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডেথ রেলওয়ে
রেলন লাইন তৈরিতে কর্মরত সৈনিক (photo copyright)

বন্দীদের দিয়ে সারাক্ষণ কাজ করানো হতো। সরাতে হতো টনকে টন মাটি আর পাথর। বর্ষাকালে কাজ করতো হতো কাদা আর পানির মধ্য দিয়ে, তখন কাজ করা হয়ো উঠতো আরো যন্ত্রণাদায়ক।

সেসিল ডয়-এর দায়িত্ব ছিল কোয়াই নামের এক নদীর আশেপাশে গাছ কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করা। সারা দিনে তাকে খাবার দেয়া হতো মাত্র আধা-কাপ ভাত!

সেসিল তার স্মৃতিকথায় আরো বলেন, আমার পাশে যে শুয়ে ছিল তার সারা গা ভরা ছিল ফোঁড়ায়। সেগুলোতে পোকা দেখা দিয়েছিল। বড় বড় মাছি ঢুকে যেত ফোঁড়ার মধ্যে।প্রচণ্ড সে জ্বরে প্রলাপ করতো। আমার পাশের বিছানাতেই একসময় সে মারা যায়।

থাইল্যান্ড-বার্মা রেললাইনটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল মোট ১৪ মাস।এই রেল লাইনটি তৈরি করতে গিয়ে এক লক্ষেরও বেশি এশীয় শ্রম-দাস প্রাণ হারায়।তাদের পাশাপাশি ১৬,০০০ ব্রিটিশ, আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান এবং ডাচ যুদ্ধবন্দী মারা যায়।

এই রেললাইনের প্রতি চারটি স্লিপারের মধ্যে একটি একজন করে মানুষের মৃত্যুর প্রতীকী বহন করছে।সে সময়টাতে যারা আমদের প্রতি এধরনের আচরণ করেছিল তাদের প্রতি আমার ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা।

যুদ্ধবন্দী হিসেবে সেসিল ডয় আটক ছিলেন প্রায় চার বছর!

হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর জাপানীরা আত্মসমর্পণের রাজি হয়।আর তার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।

সেসিল ডয় তার বক্তব্যের শেষে বলেছেন,

মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদ এমনই যে কোনভাবেই আপনি আপনার বিশ্বাস হারাতে চাইবেন না। সবসময় আপনার মাথায় ঘুরতে থাকবে কোন না কোন একদিন আপনি নিশ্চয়ই মুক্ত হবেন।

Leave a Reply