আজকের এই দিনে এসে এটা আপনার কাছে হয়তো অদ্ভুত লাগতেই পারে। কিন্তু এই অদ্ভুত ঘটনাটি ঘটেছিল ১৫১৮ সালে স্ট্রাসবার্গ নামের একটি ছোট্ট শহরে। ১৫১৮ সালের এই ডান্সিং প্লেগে মৃত্যু হয়েছিল ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের।
ডান্সিং প্লেগের শুরু কিভাবে হয়েছিল?
১৫১৮ সালের জুলাই মাসে লেডি ট্রফিয়া (বা ফ্রাউ ট্রফিয়া) নামে একজন মহিলা স্ট্রাসবার্গের (তখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, আজকের আধুনিক ফ্রান্স) একটি ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ উম্মাদের মতো নাচতে শুরু করেন। তার নাচ দেখে অনেক দর্শক জমে যায়, সাথে তার নাচের ক্ষমতার প্রশংসাসূচক হিসেবে হাত তালিও দিতে শুরু করেছিলেন।
কিন্তু লেডি ট্রফিয়ার এই নৃত্য কিছু সময়ের জন্য ছিলো না। শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। মহিলাটি দীর্ঘ ৬ দিন উম্মাদের মতো নেচেছ! এই ৬ দিন সে সন্ধ্যায় নাচ থামাতো আবার সকালেই তার উম্মাদ নৃত্য শুরু করতো। এক সপ্তাহের মধ্যে তার সঙ্গে আরো চৌত্রিশ জন স্থানীয় লোক নৃত্যে যোগ দিয়েছিল।
সেসময়ে চিকিৎসকদের এই ব্যাপারে কোনোরকম ধারণা ছিল না। চিকিৎসকরা উল্টো পরামর্শ দিয়েছিল যে মানুষদের শরীরের জ্বর এসেছে এবং রক্ত গরম হয়ে গেছে, আরো নাচলে তাদের অসুখ নিরাময় হবে।
সেই শহরের সিটি কাউন্সিল এই পরামর্শটি গ্রহণ করেছিল এবং নৃত্যের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল। নাচার জন্য মিউজিক হিসেবে ব্যান্ড পার্টির ও ব্যবস্থা করেছিল। এবং সঠিকভাবে নাচতে শেখার জন্য নৃত্য প্রশিক্ষক ও আনা হয়েছিল।
আগস্টের শেষের দিকে, রাস্তাটি একটি আধুনিক দিনের কোনো কনসার্টের মতোই অবস্থা হয়েগিয়েছিল। অসংখ্য মানুষ নাচছে আর হাজার হাজার মানুষ সেই নাচ দেখে হাসছে। নাচ দেখে হাসতে হাসতে তারাও সেই নাচে দলে দলে যোগ দিচ্ছে। সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষন অতিরিক্ত ক্লান্তি ও স্ট্রোক করে মরতে শুরু করে। কিছু কিছু জায়গায় উল্লেখ আছে যে প্রতিদিন নাচতে নাচতে ১৫ জনের মৃত্যু হতো আর এই নৃত্যের ধারা ১৫১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?
ইতিহাসবিদ ‘জন ওয়ালার’ তার লেখা A Time to Dance, A Time to Die: The Extraordinary Story of the Dancing Plague of 1518 (2008) বইটিতে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলিতে (ভুক্তভোগীরা) নাচের বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।
একজন জার্মান প্রত্যক্ষদর্শী ও পুরাতত্ত্ববিদ জোহান শিল্টার তখনকার রাস্তা, গলি এবং পাবলিক মার্কেটে লোকেদের নাচের বর্ণনা দিয়েছেন; যে তারা দিনরাত কিছু না খেয়ে নেচে যাচ্ছিল।এদের কেই অজ্ঞান হচ্ছে আবার মারা যাচ্ছে। এ যেনো এক মৃত্যুনৃত্য।
নাচের প্লেগ যে বাস্তব ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কেনো এমন উন্মাদ নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছিল?
এই ঘটনার জন্য আজকের দিনের বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সম্ভাব্য কারণ Ergot বিষক্রিয়া: Ergot হল একটি ছত্রাক যা রাই রুটিতে বেশি জন্মায়। এই ছত্রাকে সাইকোঅ্যাকটিভ রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যা মারাত্মক হ্যালুসিনেশন এবং খিঁচুনি সৃষ্টি করতে পারে।
সেই সময়ে রাই রুটি একটি সাধারণ খাদ্য আইটেম ছিল। ১৫৫৮ সালের প্লেগ নৃত্যের কারণ Ergot বিষক্রিয়ায় হতে পারে। কিন্তু জন ওয়ালার একটি বিজ্ঞান জার্নালে যুক্তি দেওয়ার পরে এই তত্ত্বটি বাতিল করা হয়েছিল। এই তত্ত্বটি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না, কারণ এটি অসম্ভ যে Ergot বিষক্রিয়ায় কোনো একদল মানুষ একাধারে অনেকদিন নাচবে।
গণ হিস্টিরিয়া: অনেক বিশেষজ্ঞ নৃত্য প্লেগকে গণ হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেন। গণ হিস্টিরিয়া মানে জনসংখ্যার সংগ্রহ যা একই আচরণ প্রদর্শন করে, প্রায়শই উদ্ভট, অজানা বা ব্যাখ্যাতীত কারণে।
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির সায়েন্স স্টাডিজ ইউনিটের লেকচারার ইভান ক্রোজিয়ার এই তত্ত্বকে সমর্থন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, লেডি ট্রফিয়া (প্রথম নর্তকী) ইর্গট বিষের শিকার হয়েছিলেন। তার নাচের উন্মত্ততা গণ হিস্টিরিয়ার প্রভাব ফেলেছিল, এবং অন্যরা পরে যোগ দেয়।
মানসিক চাপের উচ্চ মাত্রা সহ জনসংখ্যায় গণ হিস্টিরিয়া প্রাদুর্ভাব ঘটে।
জন ওয়ালার তত্ত্ব দেন যে রোগ, অনাহার এবং স্ট্রাসবার্গের মানুষের কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস স্ট্রেস-সম্পর্কিত সাইকোসিসকে প্ররোচিত করতে পারে যা ১৫১৮ সালের ডান্সিং প্লেগ হয়ে ওঠে।