পেন্সিলে লেখার সুবিধা হলো ভুল করলেই সেটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা যায়। কিন্তু কলমে এই সুবিধাটা নেই। সরাসরি ভুল হওয়া অংশটাই কেটে দিতে হয়। সেই ভুলটা যদি অফিসিয়াল কোনো দরকারি কাগজে হয় কিংবা কোনো অ্যাসাইনমেন্টে, তাহলে আবার ঝামেলা। তখন আমরা না কেটে বরং ‘ফ্লুইড’ দিয়ে সেটাকে ঢেকে দেই। এরপর সাদা রঙের সেই ফ্লুইডটা শুকিয়ে গেলে ওটার উপর কলম চালাই। সিম্পল কাহিনী।
সাদা রঙের যে লিকুইডটাকে আমরা সিম্পলি ‘ফ্লুইড’ বলে চালিয়ে দিচ্ছি কিংবা দোকানে গিয়ে এই নাম বললেই দোকানদারও আমাদের হাতে কাঙ্ক্ষিত পণ্যই তুলে দিচ্ছে, ওটার আসল নাম কিন্তু ফ্লুইড না। এর প্রকৃত নাম হচ্ছে ‘কারেকশন ফ্লুইড’।
এই কারেকশন ফ্লুইডের সাধারণত দুটো রুপের সাথে আমরা পরিচিত। একটি টিউব আকৃতির, যার ভেতর থেকে তুলির মতো একটি অংশের সাহায্যে আমরা অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে দেই। আরেকটি কলমের মতো, তবে সাধারণ কলমের আকৃতির না, একটু মোটা ও লম্বা।
আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন এই কারেকশন ফ্লুইড কিভাবে আবিষ্কার হয়ে আমাদের হাতে আসলো?
না শুনে থাকলে চলেন, আপনাকে সেই গল্পই শোনাই।
সময়টা ১৯৫১ সাল। বেটি নেস্মিথ গ্রাহাম নাম্নী এক মহিলা চাকরি পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ব্যাংক এন্ড ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ডব্লিউ ডব্লিউ ওভারটনের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি হিসেবে। সিঙ্গেল মাদার তিনি, ফলে এই চাকরি পেয়ে যেন তিনি সোনার হরিণই পেয়ে গেলেন।
আজকের দিনের মতো তখন ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটারের চল ছিল না অফিসগুলোতে, বরং সেখানে রাজত্ব করতো টাইপ রাইটারের খটাখট শব্দই। তবে কম্পিউটারে টাইপের বেলায় কোনো ভুল হলে যেমন ব্যাকস্পেসে চাপ দিলেই কাজ সেরে যাচ্ছে, টাইপ রাইটারের বেলায় তেমনটা ছিল না। কখনও কখনও মেশিনে জ্যাম লেগে যেত, কখনও আবার হুট করেই লেখাটা ভুল লাইনেও চলে যেত।
বর্তমান সময়ে লেখালেখিতে আমরা কিন্তু খুব চমৎকার একটা সুবিধা পাই। প্রথমে আমরা পিসিতে সফটকপিতে লিখছি। কোনো ভুল হলে সেখানেই তা সংশোধন করে নিতে পারছি। এরপর সেই সংশোধিত লেখাটাই আমরা প্রিন্ট আউট করে কাগজে পাচ্ছি। ফলে চেকিংয়ে ভুল না হলে প্রিন্ট হওয়া কাগজে ভুল না থাকার নিশ্চয়তা শতভাগ। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন টাইপ হতো সরাসরি কাগজেই। ফলে কেউ যদি একটা ভুলও করত, কিংবা যান্ত্রিক কোনো ত্রুটি দেখা দিত, তাহলে সেই পেজটি বের করে আবারও শুরু থেকে টাইপ করতে হতো, যা ছিল নিঃসন্দেহে বেশ পরিশ্রমসাধ্য একটি কাজ।
গ্রাহামের ভুল হতো প্রায়ই, ভুল হতো তার সহকর্মীদেরও। কিন্তু কোনো উপায় তারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না যার মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে। ফলে এভাবেই দিনগুলো কেটে যেতে থাকলো।
একদিনের কথা। সেদিন অফিসের জানালাগুলোতে রঙ করছিল কয়েকজন রংমিস্ত্রী। গ্রাহামও কাজের ফাঁকে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ এক মিস্ত্রী এক জায়গায় ভুল রঙ দিয়ে ফেললো। কিন্তু এটা নিয়ে তেমন একটা মাথা না ঘামিয়ে তারা বরং এর উপর আরও কয়েক স্তর রঙ বসিয়ে দিল ব্রাশ দিয়ে। ব্যাস ঝামেলা শেষ। নতুন করে রঙ দেয়ার বদলে তারা বরং ভুলটাকেই পুরোপুরি ঢেকে দিল।
আর এটা দেখেই গ্রাহামের মাথায় আইডিয়া এসে গেল। বাসায় ফিরেই রান্নাঘরে থাকা সাদা টেম্পেরা পেইন্ট নিয়ে পরীক্ষা শুরু করে দিলেন তিনি, কারণ ওগুলো খুব দ্রুত শুকিয়ে যেত, আবার টিকতোও বেশি দিন। সফলও হলেন তিনি তার পরীক্ষায়। এরপর থেকে তিনি অফিসে একটি বোতলে করে সেই রঙ নিয়ে যেতে থাকলেন। এখন আর ভুল হলে তাকে পুরো কাগজ ফেলে দেয়া লাগে না, বরং সেখানে এই নতুন সাদা রঙ মাখিয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে।
গ্রাহামের এই অদ্ভুত আইডিয়ার কথা সহকর্মীদের মাধ্যমে আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়াতে লাগলো। নতুন এই লিকুইডকে তখন সবাই ‘মিসটেক আউট’ নামে চেনে। ১৯৫৬ সাল নাগাদ তার কাছে এজন্য নিয়মিত বিক্রির অর্ডারও আসা শুরু হলো। এবার তিনি বুঝলেন, তার সামনে আসলে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার উন্মোচন হতে শুরু করেছে, যেটা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে জীবিকা নিয়ে তার হয়তো আর কোনো চিন্তা থাকবে না।
মিসটেক আউটের উন্নতি ঘটাতে গ্রাহাম তাই শরণাপন্ন হলেন তার ছেলেরই কেমিস্ট্রি টিচারের, যার সাহায্যে টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড ব্যবহার করে লিকুইডটাকে আরও দ্রুত শুকানোর ব্যবস্থা করা গেল। নতুন এই প্রোডাক্টের নাম তিনি দিলেন ‘লিকুইড পেপার’। এরপর এর বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিংয়ের দিকে নজর দিলেন তিনি। পাশাপাশি চলছিল তার সেক্রেটারির চাকরিও।
কিন্তু খুব বেশি দিন জীবিকার্জনের দুই নৌকায় একসাথে পা রাখতে পারলেন না গ্রাহাম। যে টাইপিং মিস্টেক এড়াতে তিনি লিকুইড পেপার এনেছিলেন, একদিন সেই ভুলের কারণেই চাকরি চলে যায় তার। তিনি নিজের ব্যবসার চিন্তায় এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন যে টাইপ করতে গিয়ে কাগজের উপরে ব্যাংকের নামের জায়গায় নিজের কোম্পানির নাম লিখে বসেন। ফলে চাকরি চলে যায় তার। অবশ্য ততদিনে লিকুইড পেপারের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এই চাকরিচ্যুতি শাপেবর হয়ে আসে তার জন্য। নিজের ব্যবসায় পূর্ণ মনোযোগ দেয়া শুরু করলেন তিনি।
লিকুইড পেপারের ফর্মুলা নিজের নামে পেটেন্ট করিয়ে নিলেন গ্রাহাম। এমনকি এর বাজার বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগের আশায় ১৯৫৭ সালে আইবিএম-এ নিজের পণ্যটি উপস্থাপনও করেন তিনি, দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে সেখান থেকে খালি হাতেই ফেরত আসতে হয়। তবে তারপরও কাজ থামাননি। যার ফলশ্রুতিতে মাত্র এক বছর পরেই তার ফ্যাক্টরি থেকে দিনে ১০ হাজার বোতল লিকুইড পেপার তৈরি হতো!
১৯৮০ সালে মৃত্যু হয় গ্রাহামের। এর এক বছর আগে জিলেটের কাছে এই প্রোডাক্টের স্বত্ব বিক্রি করে দিয়ে যান তিনি। তার মৃত্যুর প্রায় চার দশক পেরিয়ে গেলেও আজও কদর কমেনি তার উদ্ভাবিত লিকুইড পেপার ওরফে কারেকশন ফ্লুইড ওরফে ফ্লুইড এর। আজও প্রিন্ট বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখালেখিতে ভুল হলেই আমরা হাত বাড়াই সেই ফ্লুইডের দিকেই।
তথ্যসূত্রঃ Wikipedia