You are currently viewing শার্লট ব্রন্টি: ইংরেজি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

শার্লট ব্রন্টি: ইংরেজি সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

তার লেখায় দেখতে পাওয়া যায় সমাজ, নৈতিকতা, নারীর স্বাধীনতা, প্রেম রোমান্টিকতার সাথে বাস্তবতার অসাধারণ মিশ্রণ। আরো দেখতে পাওয়া যায়, অনাথ মেয়ের আত্মনির্ভরশীল হওয়া কিংবা ভিক্টোরিয়ান সমাজের মানুষের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যের ভয়াবহ চিত্র। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী নারী লেখক ও ঔপন্যাসিক শার্লট ব্রন্টি। 

শার্লট ব্রন্টি ১৮১৬ সালের ২১ এপ্রিল  ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের থর্নটনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের ছয় ভাইবোনের মধ্যে শার্লট ছিলেন তৃতীয়।  শার্লটের বাবা প্যাট্রিক ব্রন্টি ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত ধর্মযাজক, আর মা ছিলেন মারিয়া ব্রন্টি। 

১৮২১ সালে ক্যান্সারে মারিয়া ব্রন্টির মৃত্যু হলে শার্লট ব্রন্টি ও তার ভাই-বোনেরা মাতৃহীন হয়ে পড়েন। তাদের বাবা তাদের সকল ভাই-বোনকে খ্রিস্টান মূল্যবোধ ও সাহিত্য চর্চার দিকে ধাবিত করেন। এর ফলে তাদের পরিবারের মধ্যে সৃজনশীল ও সাহিত্যধারার একটি পরিবেশ তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে তাদের লেখালেখিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মায়ের মৃত্যুর পর তাদের আন্টি এলিজাবেথ ব্র্যানওয়েলের তত্ত্বাবধানে বড় হন। এলিজাবেথ ব্র্যানওয়েল ছিলেন তাদের মায়ের বোন এবং তিনি কর্নওয়াল থেকে ইয়র্কশায়ারের হাওর্থে চলে আসেন ব্রন্টি পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য। শার্লটের মাসি এলিজাবেথ ব্র্যানওয়েল ছিলেনঅতি কঠোর ও নিয়মতান্ত্রিক মহিলা। শার্লটের ‘জেন আয়ারের’ উপন্যাসে যে মিসেস রেড নামে কঠোর নারী চরিত্রটি দেখতে পাই, সেটি তিনি তার মাসি এলিজাবেথকে কল্পনা করেই তৈরি করেছেন। এলিজাবেথ যদিও স্নেহশীল মহিলা ছিলেন না, তবে তার উপস্থিতি ব্রন্টি পরিবারের ভাইবোনদের জীবনে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

শার্লট ব্রন্টি তার বোনেদের সঙ্গে প্রথমবার স্কুলে ভর্তি হন ১৮২৪ সালে। তাদের বাবা প্যাট্রিক ব্রন্টি তাদের সকল কণ্যাকে “কাওয়ান ব্রিজ স্কুল” নামক এক স্কুলে পাঠান। এই স্কুলটি ছিলো শুধুমাত্র গরিব ধর্মযাজকের মেয়ে সন্তানদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি বোর্ডিং স্কুল। এই স্কুলের পরিবেশ ছিলো খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং কঠোর। আর এই স্কুলের জীবনযাত্রার মান এতোটাই নিম্নস্তরের ছিলো যে শার্লটের দুই বোন মারিয়া ও এলিজাবেথ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

দুই মেয়ের সাথে এমন দুঃখজনক ঘটবার পর প্যাট্রিক ব্রন্টি তার বাকি মেয়েদেরকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। এই স্কুল ও বড় দুই বোনের মৃত্যু শার্টলের জীবনে বড় রকমের প্রভাব ফেলেছিল। আর সেই অভিজ্ঞতাই প্রভাব ফেলে তার বিখ্যাত উপন্যাস জেন আয়ারের লোউড স্কুলের স্কুলের ঘটনাকে। জেন আয়ার উপন্যাসে জেন আয়ারের বন্ধু হেলেন বার্নসের মৃত্যুও তার দুই বোনের মৃত্যু থেকে কল্পনা করে চিত্রিত করেছেন।

স্কুল ছাড়ার পর ১৮৩১ সালে শার্লট রো হেড স্কুলে  ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব ছিলেন মিসেস হুলার। এই স্কুলে ভার্তি হবার পর শার্লট কে তার আইরিশ উচ্চারণের জন্য অন্য শিক্ষার্থীরা বোলিং করতো। সেসময় মিসেস হুলার শার্লটকে এই প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলায় সাহায্য করেন। এছাড়াও শার্লটের পড়াশোনায় যে বিশাল গ্যাপ ছিলো, সেই সমস্যা সমাধান করতে তিনি সহযোগিতা করেন। এই মিসেস হুলার চরিত্রটি শার্লটের জেন আয়ার উপন্যাসের মিস টেম্পলের সাথে পুরোপুরি মিল রয়েছে। শার্লট মিসেস হুলারকে কল্পনা করেই এই চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ভাবা হয়।

আরো পড়ুন:  টমাস হার্ডি: ভিক্টোরিয়ান সমাজের বিপরীতে এক সাহসী কণ্ঠ
ভাই ব্র্যানওয়েল ব্রন্টির আঁকা ছবিতে অ্যান, এমিলি ও শার্লট ব্রন্টি Image Source : Wikimedia

নতুন এই স্কুলের মাধ্যমে শার্লটের জীবনে শুরু হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়ের।তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠেন, সেই সাথে তিনি সাহিত্য চর্চায়ও আরো মনোযোগী হয়ে উঠেন। এই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই শার্লট কবিতা ও গল্প লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। নতুন এই স্কুলে শার্লটের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন এলেন নেসি ও মেরি টেলর। তারা দুজন ছিলো শার্লটের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শার্লটের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের সাথে চিঠি আদানপ্রদান হতো।

১৮৩৫ সালে শার্লট ব্রন্টি রো হেড স্কুলেই শিক্ষিকা হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতা সেই সাথে একাকী জীবন তাকে বিষন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। এখানে পড়াশোনা ও শিক্ষকতা করবার মাধ্যমে তিনি তার সমাজ, সমাজে নারীদের স্বাধীনতা ও অবস্থান নিয়ে ভাবতে থাকেন। আর সেসব চিন্তা তার উপন্যাসগুলোতে পরবর্তীকালে প্রতিফলিত হয়েছে।

বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা করার পর শার্লট এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮৩৯ সালে গৃহশিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। একাধিক পরিবারের গৃহশিক্ষিকা হিসবে কাজ করবার পর শার্লটের আর এই পেশা ভালো লাগেনি। তার কাছে মনে হয়েছে গৃহশিক্ষিকারা অবমূল্যায়িত ও এই পেশায় যথেষ্ট স্বাধীনতা ও সম্মান নেই। তবে তার এই গৃহশিক্ষিকা জীবনের অভিক্ষতা তিনি জেন আয়ার উপন্যাসে কাজে লাগিয়েছেন।

শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেবার পর শার্লট ব্রন্টি তার ছোট বোন এমিলি ব্রন্টি কে সাথে নিয়ে ১৮৪২ সালে ব্রাসেলে গিয়েছিলেন তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য। এই যাত্রার উদ্দেশ্য ছিলো তারা ভবিষ্যতে একটি স্কুল খুলবেন এবং সেখানে নিজেরা শিক্ষকতা করবেন। আর এই যাত্রার মাধ্যমে তারা ফরাসি ও জার্মান ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন। এই যাত্রার খরচের একটা বড় বহন করেছিলেন তাদের বাবা প্যাট্রিক ব্রন্টি। 

ব্রাসেলে থাকার সময় শার্লট ‘পেনসিওনাট হেগার’ নামক একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা করবার সময় তিনি  কন্সট্যান্টিন হেগার নামক এক বিবাহিত পুরুষের প্রেমে পড়ে যান। এই প্রেম পুরোপুরি এক তরফা ছিলো। আর এই ঘটনা শার্লটের পরবর্তী দুই উপন্যাস ‘দ্য প্রফেসর’ ও ‘ভিলেটে’ প্রভাব ফেলে। 

ভিলেট Image Source : libris.in

দ্য প্রফেসর উপন্যাসে তিনি ব্রাসেলে শিক্ষকতা করা এক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। আর ভিলেট শার্লট ব্রন্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। এই উপন্যাসে নিজের একাকিত্ব ও কন্সট্যান্টিন হেগারের প্রতি তার প্রেমের বিষয়টি ব্যবহার করেন। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ছিলো মাদাম বেক, যিনি একই সাথে কঠোর ও সন্দেহপ্রবন। শার্লট কন্সট্যান্টিন হেগারের স্ত্রী মিসেস হেগার চরিত্র কে এই উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন।

আরো পড়ুন:  রাজা ঈডিপাস: নিয়তি যার অভিশাপ

দুই বছর ব্রাসেলে থাকার পর ১৮৪৪ সালে শার্লট ও তার ছোট বোন এমিলি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং নিজের বোনদের সাথে নিয়ে একটি স্কুল শুরু করেন। কিন্তু একপর্যায়ে অর্থ ও ছাত্রের অভাবে তাদের সেই স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে শার্লট ও তার বোনেরা সাহিত্য চর্চায় মন দেয়।

১৮৪৬ সালে, শার্লট, এমিলি, এবং অ্যান ব্রন্টি যৌথভাবেএকটি কবিতার সংকলন করেন। তারা এই বই প্রকাশে Currer, Ellis ও Acton Bell ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। কারন সেসময় নারীদের সাহিত্যকে সমাজ ও পাঠকরা তেমন গুরুত্ব দিতো না। সেসময় বইটি সেরকম সাড়া না পেলেও কিছু পাঠককে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলো।

এর পরের বছর শার্লট ‘দ্য প্রফেসর’ উপন্যাসটি লিখেন কিন্তু তা সেসময় প্রকাশকরা প্রকাশ করতে প্রত্যাখান করে। একই বছরে তিনি ‘জেন আয়ার’ উপন্যাসটি লিখেন। আর এই উপন্যাস তাকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়। এরপর শার্লট আরো দুটো উপন্যাস লিখেছিলেন “শার্লট ব্রন্টি (১৮৪৯)” ও “ভিলেট (১৮৫৩)”।

শার্লট ব্রন্টি তার সাহিত্য জীবনে মোট চারটি উপন্যাস রচনা করেছেন। সবগুলো উপন্যাসই তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্র কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকে বলেন, শার্লট ব্রন্টির চারটি উপন্যাস তার নিজেরই অটোবায়োগ্রাফি। 

শার্লট ব্রন্টির আরো দুই বোন এমিলি ব্রন্টি ও অ্যান ব্রন্টি ইংরেজি সাহিত্যে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। এমিলির উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাস হলো Wuthering Heights, আর অ্যান ব্রন্টির রচনাকৃত উপন্যাস Agnes Grey ও The Tenant of Wildfell Hall বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলো। 

শার্লট ব্রন্টির একমাত্র ভাই ছিলেন ব্র্যানওয়েল ব্রন্টি। তিনি ছিলেন একজন কবি ও চিত্রশিল্পী। তিনিও একজন প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার জীবন ছিলো হতাশা আর ব্যর্থতার। ব্র্যানওয়েল একপর্যায়ে আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং ১৮৪৮ মাত্র ৩১ বছর বয়সে নেশার প্রভাব ও যক্ষ্মার কারনে তার অকাল মৃত্যু ঘটে। একই বছরে বোন এমিলিও অসুস্থ হয়ে মারা যান। এর পরের বছর ১৮৪৯ সালে অ্যানি ব্রন্টিও অসুস্থ হয়ে মারা যায়।

ছয় ভাই-বোনের মধ্যে রয়ে গেলেন কেবল শার্লট ব্রন্টি। বাবার অনুমতি পেয়ে ১৮৫৪ সালে শার্লট তার বাবার সহকারী আর্থার বেল নিকোলাসকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের সুখী জীবন শার্লটের কপালে আর স্থায়ী হয়নি। বিয়ের মাত্র ১ বছরের মাথায় ১৮৫৫ সালের ৩১ মার্চ শার্লট ব্রন্টি গর্ভাবস্থায় অসুস্থ হয়ে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। 

Leave a Reply