নরখাদক শব্দটা শুনলে আপনার মস্তিষ্ক হয়তো চিন্তা করতে থাকে আফ্রিকা মহাদেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা। কিংবা কাপালিক বা অঘোরপন্থীদের কথাও; পিশাচ সাধকদেরও অপঘাতে নিহত ব্যক্তির লাশ লাগে বলে শোনা যায়।
কিন্তু নরখাদকের কথা উঠলে আমাদের কেউই ইউরোপের কথা মাথাতেই আনে না। অবশ্য নরখাদকের সাথে ইউরোপ মহাদেশের সম্পর্ক কেউ কল্পনাও করতে পারেন না।
কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো, ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতেও মানুষের মৃতদেহ খাওয়ার চল ছিল ইউরোপে।
শবের ভেষজগুণ আছে, আছে রোগ সারিয়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা, এমন এক বিবেচনা থেকে মৃতদেহের মাংস, করোটি, হাড় প্রভৃতি খাওয়া হতো। এ ভাবে নরখাদকের গড্ডলে যারা গা ভাসিয়ে ছিলেন সে দলে বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে যাজক পর্যন্ত সব শ্রেণির ইউরোপীয় মানুষের দেখা মিলবে।
মমি বা অন্যান্য সংরক্ষিত শব, কিংবা মৃতদেহের নানা অংশ সে কালের ওষুধের একটি সাধারণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সংক্ষেপে বলতে গেলে দাঁড়ায়, ইউরোপীয়রা নরখাদক ছিল, সেটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়।
নোবেলের বই, মেডিসিনাল ক্যানিবালিজম ইন আর্লি মডার্ন ইংলিশ লিটারেচার অ্যান্ড কালচার, এবং ইংল্যান্ডের ডারহাম ইউনিভার্সিটির রিচার্ড সুগের বই, মমিস, ক্যানিবালস অ্যান্ড ভ্যাম্পায়ারস: দ্য হিস্ট্রি অফ কর্পস মেডিসিন ফ্রম দ্য রেনেসাঁ টু দ্য ভিক্টোরিয়ান্স ইউরোপে নরখাদকের প্রচলনের বিষয় তুলে ধরেছে। কয়েকশ বছর ধরে এ ধারা চলেছে।
পরবর্তীতে ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে তা তুঙ্গে পৌঁছে। রাজরাজড়া, পুরোহিত এবং বিজ্ঞানীসহ অনেক ইউরোপীয় নিয়মিতই রোগ সারাতে বা প্রতিকার হিসেবে নরভোজ করেছেন। মাথাব্যথা থেকে মৃগী রোগ পর্যন্ত হরেক রোগের দাওয়াই হিসেবে মানুষের হাড়, রক্ত এবং চর্বিতে তৈরি ওষুধ খেয়েছেন বা ব্যবহার করেছেন। মিশরীয় সমাধি থেকে মমি চুরি করা হয়েছে এবং আইরিশ সমাধিস্থল থেকে মাথার খুলি নেওয়া হয়েছে, গোরখোদকরা কবর খুঁড়ে মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করেছে। বলা যায় মৃতদেহ নিয়ে চোরা এবং খোলা বাজারে রমরমা বেসাতি চলেছে।
রিচার্ড সুগের কথায়, “মানুষের মাংস খাওয়া কী ঠিক হবে?” এটা কোনও প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্ন হলো “কোন লাশের মাংস খাবো?”
প্রথমে এর জবাবে বলা হয়েছে মিশরের মমি। মমিকে গুড়ো করে আরকের সাথে মিশিয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত বন্ধের ওষুধ হিসেবে খাওয়ানো হয়েছে। এরপর অন্যান্য দেহাংশ ব্যবহারও শুরু হয়। মাথার রকমারি রোগের চিকিৎসার সাধারণ উপাদান হিসেবে ব্যবহার হতো করোটি গুড়া।
সপ্তদশ শতকের মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের অগ্রদূত টমাস উইলিস অ্যাপোলেক্সি বা মস্তিষ্কে রক্তপাত বন্ধে একটি পানীয় তৈরি করেন। এর উপাদান ছিল মানুষের মাথার খুলি এবং চকোলেট। ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস “দ্য কিংস ড্রপস” নামের নিজস্ব আরক পান করতেন। এতে মদে চুবানো মানুষের মাথার খুলি থাকত। এমনকি মাটি চাপা মাথার খুলিতে গজাত টুপির মতো শ্যাওলার আস্তরও ব্যবহার হতো অসুখ সারাতে । ইউসেনা নামে পরিচিত এই আস্তরকে মূল্যবান ভেষজগুণ সম্পন্ন বলে মনে করা হতো। নাকের রক্ত-ক্ষরণ এবং মৃগীরোগ নিরাময় করে বলেও সে সময়ে মানা হতো। মানুষের চর্বি শরীরের বাইরের চিকিত্সার জন্য ব্যবহৃত হতো। যেমন, জার্মান চিকিত্সকরা ক্ষত চিকিৎসায় চর্বিমাখা ব্যান্ডেজ লাগানোর ব্যবস্থাপত্র দিতেন। গেটে বাতের প্রতিকার হিসেবে ত্বকে চর্বি ঘষারও ব্যবস্থাপত্র সে যুগের জার্মানিতে দেওয়া হতো। আর এ সবই ছিল মানুষের চর্বি।
রক্তকে যতদূর সম্ভব তাজাই সংগ্রহ করা হতো এবং রক্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর বলেই বিশ্বাস করা হতো। ষোড়শ শতকের জার্মান-সুইস চিকিৎসক প্যারাসেলসাস বিশ্বাস করতেন যে রক্ত অনবদ্য পানীয়। এমনকি তার এক অনুসারী জীবিত দেহ থেকে রক্ত যোগাড়ের পরামর্শও দিয়েছেন। তবে এ ভাবে তাজা রক্ত পানের চল হয়ত তেমন বেশি ছিল না। গরিবের পক্ষে ভেষজ দোকান থেকে দামি ওষুধ কেনা সম্ভব ছিল না। তবে তারাও নরদেহজাত কথিত ওষুধ সেবনের সুযোগ পেতো। মৃত্যুদণ্ডের পর দণ্ডিতের দেহের গরম রক্ত অল্প মাত্রা পান করার সুযোগ তাদের জন্য আসত। এ সুযোগ মাগনা ছিল না। বরং এ জন্য দিতে হতো সামান্য পরিমাণ অর্থ। “জার্মানিক(সরকারী ভাষা জার্মানি এমন ছয় রাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি, লিচেনস্টাইন, লুক্সেমবার্গ এবং সুইজারল্যান্ড) দেশগুলোতে জল্লাদকে একজন বড় নিরাময়কারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
” সুগ বলেন, “জল্লাদ ছিলেন প্রায় ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা সম্পন্ন সামাজিক অচ্ছুত।”
১৬৭৯ সালে খ্রিস্টান রোমান ক্যাথলিকদের একটি গোষ্ঠী, ফ্রান্সিসকান, রক্ত দিয়ে মোরব্বা জাতীয় খাবার তৈরির রন্ধন প্রণালী প্রকাশ করেন। ভক্তদের মধ্যে যারা রক্তে তৈরি খাবার খেতে পছন্দ করেন তাদের জন্যেই এটি প্রকাশ করা হয়।
শরীরের কোনও জায়গায় বিশ-ব্যথা হচ্ছে? নরমেদ মালিশ করুন, বেদনা সেরে যাবে। করোটির শ্যাওলা শুকিয়ে গুড়া করে নাক দিয়ে টেনে নিন, নাকের রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ‘কিংস ড্রপস’ সেবনে মানসিক চাপ সাময়িক ভাবে হলেও কেটে যাবে। জাদুকরী হিসেবে বিবেচনা করায় হয়ত এ সব এসব ওষুধ কাজ করেছে। মানুষ যখন শরীরের রক্ত সঞ্চালন নিয়েও কিছুই জানে না তখন রোগীর চিকিৎসার আর কি পথ থাকতে পারে!
চিকিৎসার জন্য মৃতদেহ সেবন করার চল অনর্থক সৃষ্টি হয়নি। নোবেল বলেন, এ চলের সাথে সে সময়ে প্রচলিত চিকিৎসা তত্ত্বের মিল রয়েছে। “সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার” বা “সদৃশ সদৃশকে আরোগ্য করে” হিসেবে পরিচিত “হোমিওপ্যাথিক ধারণা থেকে উদ্ভূত।” তিনি আরও বলেন, তাই মাথার ব্যথা করলে মাটির তলা থেকে নিয়ে আসা খুলি খান। অথবা রক্ত রোগ সারাতে রক্ত সেবন করুন।
মানুষের দেহাবশেষকে শক্তিআধার হিসেবে ধরে নেওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। যে দেহ থেকে এই দেহাংশ যোগাড় করা হয়েছে তাতে সে দেহের আত্মাও রয়েছে বলেই মনে করা হতো। “আত্মা”কে শরীরের বাস্তব অংশ বলেই ধরা হতো। এ ভাবেই দেহ ও আত্মার সম্পর্কের কথা এসেছে। এ ক্ষেত্রে রক্ত বিশেষভাবে শক্তিশালী ভূমিকায় রয়েছে বলেও ধরে নেওয়া হতো। সুগ বলেন, “তারা ভাবত রক্ত আত্মাকে বহন করে এবং বাষ্পীয় রূপে আত্মাকে বহন করা হয়।” তাজা রক্তকে শক্তির সবচেয়ে বড় আধার বলেই বলেই গণ্য করা হত। কখনও এমন শক্তি লাভের প্রত্যাশায় তরুণের রক্ত কাঙ্ক্ষিত হতো, কখনও বা কুমারী তরুণীর রক্ত। মৃতদেহ থেকে আহরিত দেহাংশ সেবনের মাধ্যমে সে ব্যক্তির বল-বীর্যও অর্জন করা হয় বলে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। নোবেল এ ক্ষেত্রে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বক্তব্য তুলে ধরেন। “আমরা অন্যের মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের জীবন রক্ষা করি। একটি মৃত বস্তুর মধ্যেও অসাড় জীবন থেকে যায়, যা জীবিতদের পাকস্থলীতে মিলিত হলে আবারও সংবেদনশীল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে ফিরে পায়।”
এমন ভাবনা রেনেসাঁ যুগের জন্যও নতুন নয় কেবল নতুন করে জনপ্রিয় হয়েছে। রোমানদের মধ্যে নিহত গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত পানের চল ছিল। শক্তিশালী যুবকটির জীবনীশক্তি হাতিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এ কাজটি করা হতো। পঞ্চদশ শতাব্দীর দার্শনিক মার্সিলিও ফিসিনো একই লক্ষ্য অর্জনে তরুণের হাত কেটে রক্ত পান করার পরামর্শ দেন। নোবেল লিখেছেন, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং ভারত সহ অন্যান্য সংস্কৃতির অনেক চিকিৎসক বা বৈদ্য বিশ্বাস করতেন রোগ নিরাময়ে বা শক্তি অর্জনে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপযোগিতা রয়েছে।
বিজ্ঞান এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসায় নরখাদক প্রবণতাগুলো বিদায় নিতে থাকে। ১৮ শতকে ইউরোপীয়রা নিয়মিতভাবে খাওয়ার ক্ষেত্রে কাঁটাচামচ এবং গোসলের জন্য সাবান ব্যবহার করতে শুরু করলে এই অভ্যাসটি খুব কমে যায়। মৃতদেহকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারে প্রবণতা কমলেও একদম বিদায় নেইনি তখনও। সুগ জানান, ১৮৪৭ সালে এক ইংরেজকে পরামর্শ দেওয়া হয়, তরুণীর মাথার খুলির সাথে ঝোলা গুড় মিশিয়ে খাওয়ালে তার মেয়ের মৃগীরোগ সেরে যাবে। ভদ্রলোক কথিত ভেষজটি যোগাড় করতে এবং আত্মজাকে খাওয়াতেও পেরেছিলেন। তারপর কি হলো? সুগ বলেন, রোগের ওপর এর কোনও প্রভাবই পড়েনি। এদিকে ‘জাদুর মোমবাতি’ নিয়ে একটি বিশ্বাস ১৮৮০’এর দশক পর্যন্ত বজায় ছিল। মানুষের চর্বি দিয়ে বানানো এমন মোমবাতিকে “চোরের মোমবাতি” বলা হতো। এ দিয়ে যে কাউকে হতবুদ্ধি এবং পঙ্গু করে দেওয়া যেত বলে বিশ্বাস করা হতো। ২০ শতকের শুরুতে একটি জার্মান চিকিৎসা ক্যাটালগে মমিকে ওষুধ হিসেবে বিক্রির জন্য তালিকাভুক্তি করা হয়। ১৯০৮ সালে জার্মানিতে ফাঁসির পর মৃত আসামির রক্ত পান করার সর্বশেষ ঘটনা ঘটে।
তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মানবদেহ ব্যবহারের চল রয়েছে, সে কথা হয়ত অনেকেই ভুলেই যাই। রক্ত সঞ্চালন, অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং ত্বক যোজনা হলো মানব শরীরকেই চিকিৎসার কাজে বা রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহারের উদাহরণ। জন ডন এবং শেক্সপিয়ার মমি নিয়ে যে কাব্যিক সম্ভাবনার কথা বলেছেন আজকের আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এক অর্থে তাই চর্চা করছে। এক মানুষের রক্ত এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরেক মানুষকে অবাধে দেওয়া হচ্ছে। এতে অনেক অন্ধ জনের জীবন আলোয় আলোয় ভরে উঠছে। কিংবা কারো আয়ু দীর্ঘ হচ্ছে। জটিল রোগ কাটিয়ে উঠতে কিংবা সুন্দর মানসম্পন্ন জীবন-যাপন করতে পারছেন। পাশাপাশি আধুনিক এ চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যদিকটিও তুলে ধরেন নোবেল।
তথ্যসূত্রঃ Smithsonian
Magazine
ভহডিস ুৃ িবহুটগপচ
Hidden sad history