১ মার্চ ১৮৪৯
ফ্রান্সের এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। মনিয়ের পরিবার তাদের পদবী অনুসারে মেয়েটির নাম রাখেন ‘ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের’। মা ‘মাদাম মনিয়েরের’ দানশীলতার জন্য এলাকায় বেশ নাম-ডাক ছিল মনিয়ের পরিবারের। এমনকি তার উদারতার জন্য সে একটি ‘কম্যিউনিটি এওয়ার্ড’ পর্যন্ত পেয়েছিল স্বীকৃতিস্বরুপ। মেয়ে ‘ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের’ ছাড়াও মাদাম মনিয়েরের এক ছেলে সন্তান ছিল,তার নাম ‘মারসেল মনিয়ের’। পেশায় তিনি ছিলেন একজন স্বনামধন্য উকিল। এক ছেলে-এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার মাদাম মনিয়েরের।
ছোটবেলায় ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের যতোটা সুন্দরী ছিলেন বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার শরীরের রূপ লাবণ্য ও সৌন্দর্য্য আরো বাড়তে থাকে। আর তাই মেয়ের সৌন্দর্য্য নিয়ে মা মাদাম মনিয়েরের খুব অহংকার। ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের তখন যুবতী; বয়স ২৫ বছর। মাদাম মনিয়ের তার পছন্দ করা এক অভিজাত পরিবারের পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন। কিন্তু ততদিনে আমাদের ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের নিজের মন দিয়ে বসে আছে অন্য একজনকে। পেশায় সে সাধারণ একজন উকিল। পরিবারের আভিজাত্য বলে তেমন কিছুই নেই খুবই সাদামাটা।
ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের তার পছন্দের মানুষটিকে তার মায়ের সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু পারিবারিকভাবে অভিজাত ও স্বনামধন্য না হওয়ায় তার মা বিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। নিজের পছন্দ করা পাত্রকেই বিয়ে করতে হবে ‘ব্ল্যাঞ্চ মনিয়েরের’ এ কথা জানিয়ে দেন তিনি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মানতে রাজি না হওয়ায় মাদাম মনিয়ের ব্ল্যাঞ্চকে একটি ছোট রুমে আটকে রাখেন। কড়াভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয় সেদিনই এ ঘর থেকে মুক্তি পাবে ব্ল্যাঞ্চ, যেদিন সে তার মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিবে। কিন্তু মায়ের মতো মেয়েও যে এক কথার মানুষ, নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইলেন ব্লাঞ্চ মনিয়ের। বিয়ে যদি করতেই হয়, নিজের ভালোবাসার মানুষটিকেই করবে। এছাড়া অন্য কাউকে নয়!
বছরের পর বছর চলে যায়, ব্ল্যাঞ্চ তার সিদ্ধান্তে থাকে অনড়। মায়ের অহংকারী-জেদী মনও গলে না। ফলে মুক্তিও আর মেলে না। ১৮৮৫ সালে, ব্ল্যাঞ্চের ভালোবাসার মানুষটি মারা যাবার পরও তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়! এদিকে ব্ল্যাঞ্চের মা আর ভাই সমাজে এমন ভান করে থাকে যে ব্ল্যাঞ্চকে হারিয়ে তারা শোকে কাতর! বাড়ির কাজের লোকেরা এই ব্যাপারে জানলেও কাউকে জানাতে ভয় পেত মনিয়ের পরিবাটে সামাজিক অবস্থা, ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে। আর এইভাবে কেটে যায় দীর্ঘ পঁচিশটি বছর!
২৫ বছর পর, ১৯০১ সাল
প্যারিসের এটর্নি জেনারেলের কাছে বেনামি একটি চিঠি আসে। কে বা কারা এই চিঠিটি পাঠিয়েছে, কখনোই তা জানা যায়নি। চিঠিতে লেখা ছিল মনিয়ের পরিবার বহু বছর ধরে এক ব্যক্তিকে তাদের বাড়িতে আটকে রেখেছে। মনিয়ের পরিবারের সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে প্রথমে না চাইলেও পরে তদন্ত চালাতে নির্দেশ দেন এটর্নি জেনারেল।
বাড়িতে তল্লাসি চালিয়ে কিছুই খুঁজে না পেয়ে যখন ফিরে যাবে সৈন্যরা, তখনই একজন সেনার নাকে আসে বোটকা এক পঁচা গন্ধ। সেই গন্ধ অনুসরণ করে চিলেকোঠায় পৌছালে সেখানে একটি অন্ধকার তালাবদ্ধ রুম দেখতে পায় তারা। রুমটিতে কেবলমাত্র একটি বন্ধ ছোট জানালা ছিল, তাও মোটা পর্দা দেওয়া। কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না বাইরে থেকে। সন্দেহ হওয়ায় জানালার কাচ ভেঙে ফেলে এক পুলিশ সদস্য। ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে তারা দেখতে পায় চিলেকেঠার এক কোনায় শেকলাবদ্ধ এক নারী! তাকে দেখে সেনারা দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখতে পায় বিভৎস এক দৃশ্য।
ছোট একটি বিছানায় পঁচা খাবার আর কোটি কোটি কীটের মধ্যে শুয়ে আছে ‘মনিয়ের ব্ল্যাঞ্চ’ এই ২৫ বছরে বাইরের আলো-বাতাস থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিল সে। চেহারাও বিদঘুটে হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সে সময় তার ওজন ছিল মাত্র ২২ কেজি! কিন্তু বিগত ২৫বছরের ভয়াবহ স্মৃতি মাথা থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেনি মনিয়ের ব্ল্যাঞ্চ। ফলে, গুরুতর মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তার। তাকে ভর্তি করা হয় ফ্রান্সের এক সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে। ১৯১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, জীবনের বাকিটা সময় এখানেই কাটায় সে। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে চাওয়ার ‘অপরাধে’ এই শাস্তি পেতে হলো তাকে।
ব্ল্যাঞ্চের মা ও ভাইয়ের পরিণাম
ব্ল্যাঞ্চকে উদ্ধারের পর এরেস্ট করা হয় তার মা ও ভাইকে। মা অসুস্থ হয়ে গেলে জামিন পেয়ে বাসায় যায়। কিন্তু ততদিনে সবাই এই বিভৎস ঘটনা জেনে গেছে। ব্ল্যাঞ্চ উদ্ধার হওয়ার ১৫দিনের মাথায় বিক্ষুব্ধ জনতা ভিড় করে তাদের বাসার সামনে। আতঙ্কিত হয়ে হার্ট এটাক করে সেদিনই মারা যায় মাদাম মনিয়ের।
আর ভাই মারসেল মনিয়েরকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় এবং তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। তাকে ১৫ মাসের জেল দেওয়া হয়। তবে তিনি প্রভাব খাটিয়ে জামিনে বেরিয়ে আসেনন। যদিও আদালত বলেছিলেন তৎকালীন ফরাসি পেনাল কোড অনুযায়ী তিনি অপরাধী নন!
ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের এর জীবনের শেষ সময়
মানসিক হাসপাতালে ব্ল্যাঞ্চ মনিয়ের এর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তিনি আর কখনোও স্বাভাবিক জীবণে ফিরতে পারেন নি। জীবণের শেষ ১২ টি বছর ফ্রান্সের সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালেই অতিবাহিত করে ১৩ অক্টোবর ১৯১৩ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
Source: Wikipedia, all that’s interesting, infobae.com