ব্ল্যাক ডেথ ছিল ‘বিউবোনিক প্লেগের’ একটি বিধ্বংসী বৈশ্বিক মহামারী, যা ১৩শ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপ ও এশিয়ায় আঘাত হানে। ১৩৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ‘প্লেগ’ প্রথম ইউরোপে এসে পৌঁছায়। যখন সমুদ্রপথ থেকে ১২ টি জাহাজ মেসিনার সিসিলিয়ান বন্দেরে নোঙর ফেলে। জাহাজে অবস্থানরত লোকেদের তখন বিস্ময়ের সাথে দেখা হচ্ছিল। জাহাজের বেশিরভাগ নাবিকই মারা গিয়েছিল এবং যারা তখনও জীবিত ছিল তারা গুরুতর অসুস্থ ছিল। সেই সাথে তাদের পুরো শরীর কালো ফোঁড়ায় আবৃত ছিলো যা দিয়ে ক্রমাগত রক্ত এবং পুঁজ বের হচ্ছিল।
সিসিলিয়ান কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে বন্দর থেকে এই ‘মৃত্যুবাহী জাহাজ’ এর বহরের আদেশ দিয়েছিল, কিন্তু তা করতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। আর তার ফলাফল হিসেবে পরবর্তী ৫ বছরে, ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপে ২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। যা তখনকার ইউরোপ মহাদেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ!

প্লেগের শুরু কখন হয়েছিল?
সিসিলিয়ান বন্দরের সেই ‘মৃত্যুবাহী জাহাজ’ এর অনেক আগেই অনেক ইউরোপীয়রা ‘মহা মহামারী’ সম্পর্কে গুজব শুনেছিল। আর তাই নিকটবর্তী এবং দূর প্রাচ্যের বাণিজ্য রুট জুড়ে একটি মারাত্মক ভয় সংকীর্ণতা কাজ করছিল বণিকদের মধ্যে।
প্রকৃতপক্ষে ১৩৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে, এই রোগটি সর্বপ্রথম চীন, ভারত, পারস্য, সিরিয়া এবং মিশরে আঘাত হেনেছিল।
প্লেগের উৎপত্তি এশিয়ায় আজ থেকে ২০০০ বছর আগে হয়েছিল বলে মনে করা হয়। সম্ভবত এটি কোনো ব্যবসায়িক জাহাজের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, যে ব্ল্যাক ডেথের জন্য দায়ী ‘প্যাথোজেনটি’ ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকে ইউরোপেই বিদ্যমান থাকতে পারে।
প্লেগের লক্ষ্মণ
ব্ল্যাক এর ভয়াবহতা মোকাবেলা করতে তখন খুব কম ইউরোপীয়রাই সতর্ক সচেতন ছিলো।
ইতালিয়ান কবি ‘জিওভান্নি বোকাসিও লিখেছেন
পুরুষ ও মহিলা উভয়ই সমানভাবে সংক্রমিত হচ্ছে, অসুখের শুরুতে শরীরের কিছু ফুলে যায়, (বিশেষকরে কুঁচকিতে বা বগলের নীচে)
ফুলা অংশটি কারো কারো আপেল সাইজের, আবার কারো ক্ষেত্রে ডিম আকৃতির, কোনোটা বেশি আবার কোনোটা কম, আর এগুলোর নাম প্লেগ ফোঁড়া।

এই অদ্ভুত ধরনের ফোলাগুলি থেকে ক্রমাগত রক্ত এবং পুঁজ বের হতো, আর এর সঙ্গে যুক্ত হতো জ্বর, ঠাণ্ডা, বমি, ডায়রিয়া, ভয়ানক মাথা ব্যথা এবং সবশেষে হতো মৃত্যু।
বিউবোনিক প্লেগ ‘লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমকে’ আক্রমণ করে, যার ফলে ‘লিম্ফ নোডগুলি’ ফুলে যায়। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে এর সংক্রমণ খুব দ্রুত রক্ত বা ফুসফুসে ছড়িয়ে পরে।
প্লেগ কিভাবে ছড়িয়ে পড়লো?
বিউবোনিক প্লেগ ভয়ঙ্কররকম সংক্রমক ছিলো।
জিওভান্নি বোকাসিও লিখেছেন,
মনে হচ্ছে কোনো সুস্থ মানুষ কোনো প্লেগ আক্রান্তের জামা কাপড় ছুলে সেও সংক্রমিত হয়ে যায়। এমনও দেখেছি কোনো সংক্রমিত ব্যাক্তি রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বেশ সুস্থ ছিল কিন্তু ভোর বেলায় জানা গেলো সে আর বেঁচে নেই!
আজ, বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে ‘ব্ল্যাক ডেথ’, যা এখন প্লেগ নামে পরিচিত,তা মূলত ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামক ব্যাসিলাস দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে। (ফরাসি জীববিজ্ঞানী ‘আলেকজান্ডার ইয়ারসিন’ ১৯ শতকের শেষের দিকে এই জীবাণুটি আবিষ্কার করেছিলেন)
বিউবনিক প্লেগ হল Xenopsylla cheopis নামক সংক্রমিত ফ্লির কামড়ের ফলে সৃষ্ট লসিকাতন্ত্রের একটি সংক্রমণ। খুব বিরল কিছু ক্ষেত্রে যেমন সেপটিসেমিক প্লেগ, সরাসরি সংক্রমিত টিস্যু বা আরেকজন সংক্রমিত ব্যক্তির কফের সংস্পর্শে আসলে রোগটি ছড়াতে পারে। মক্ষিকাটি গৃহ ও ক্ষেতের ইঁদুরের দেহে পরজীবী হিসেবে বাস করে এবং তার পোষকটি মারা গেলে আরেকটি শিকারের সন্ধান করে। ব্যাক্টেরিয়াটি মক্ষিকার কোনো ক্ষতি করে না যা এক পোষক থেকে আরেক পোষকে জীবাণুর বিস্তারে সহায়তা করে।
ব্যাসিলাস বাতাসের মাধ্যমে এমনকি সংক্রামিত মাছি এবং ইঁদুরের কামড়ের মাধ্যমে একজন থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এই উভয় ধরনের কীটপতঙ্গ মধ্যযুগীয় ইউরোপের প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যেত। তবে এরা বিশেষত সব ধরণের জাহাজে বাড়িতেই ছিল। ফলে এই প্লেগ গুলো শুরতে বন্দর শহরগুলো থেকেই ছড়াতে আরম্ভ করে।
মেসিনাতে প্রথম সংক্রমণ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই ‘ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ’ ফ্রান্সের মার্সেই বন্দর এবং উত্তর আফ্রিকার তিউনিস বন্দরে ও ছড়িয়ে পড়ে। তারপর এটি রোম এবং ফ্লোরেন্সে পৌঁছেছে,যা ছিলো বাণিজ্য রুটের একটি বিস্তৃত ওয়েবের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত দুটি শহর। ১৩৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে, ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ প্যারিস, বোর্দো, লিয়ন এবং লন্ডনেও সংক্রমণ হয়েছিল।
আজকের এই সময়ে প্রযুক্তির এতো উন্নয়নের পরও আমরা করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করতে কতোটা বেগ পেতে হচ্ছে। একবার ভাবুন ৬০০ বছর আগে সেসময়কার অবস্থা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল!
ব্ল্যাক ডেথ কীভাবে একজন রোগী থেকে অন্য রোগীতে সংক্রমিত হযচ্ছিল তা কেউই জানত না এবং কীভাবে এটি প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা যায় তাও কেউ জানত না।
সেসময়কার একজন ডাক্তারের দেওয়া একটি বক্তব্য শুনুন,
মাত্রই মৃত্যু হওয়া ব্যাক্তির দিকে তাকালে মনে হতো সেই অসুস্থ ব্যাক্তিরই আত্মা তার পাশে থাকা সুস্থ মানুষটির শরীরের ঢুকে যাচ্ছে আর সুস্থ মানুষটিও প্লেগে সংক্রমিত হয়ে যাচ্ছে।
কিভাবে প্লেগের চিকিৎসা করতো?
তখন চিকিৎসকরা অশোধিত এবং অপ্রত্যাশিত কৌশলগুলির উপর নির্ভর করতেন যেমন রক্তপাত এবং ফোঁড়াগুলো কে সুচ বা কাপড় দিয়ে গেলে ফেলতো (এই অভ্যাসগুলি বিপজ্জনক এবং অস্বাস্থ্যকর ছিল)। এছাড়াও কুসংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড ও প্রচলওত ছিলো, যেমনঃ- সুগন্ধযুক্ত ভেষজ পোড়ানো এবং গোলাপজল বা ভিনেগারে গোসল করা।

এদিকে এই আতঙ্কের মধ্যে, সুস্থ লোকেরা অসুস্থদের এড়াতে তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। ডাক্তাররা রোগী দেখতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল; পুরোহিতরা মৃতের শেষকৃত্য পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি করেছিলেন; এবং দোকানিরা তাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল, অনেকে বাঁচতে নিজের রক্তের মানুষদেরও ত্যাগ করেছিল।
অনেক লোক শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে পালিয়েছিল, কিন্তু সেখানেও তারা এই রোগ থেকে বাঁচতে পারেনি। শুধু মানুষ নয়! গরু, ভেড়া, ছাগল, শুকর এবং মুরগিরাও সংক্রমিত হয়েছিল। সেসময় এতো ভেড়া সংক্রমিত হয়েছিলো যে পুরো ইউরোপ জুড়ে উলের সংকট তৈরি হয়েছিল।
ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ কি স্রষ্টার শাস্তি?
সেসময়ের মানুষজন বায়োলজি সম্পর্কে জ্ঞান ছিলো না। অনেক লোক বিশ্বাস করেছিল যে ‘ব্ল্যাক ডেথ বা কালো মৃত্যু’ হল এক ধরনের ঐশ্বরিক শাস্তি। লোভ, পরনিন্দা, ধর্মদ্রোহিতা, ব্যভিচার এর মতো পাপ বেড়ে যাওয়ায় স্রষ্টা এই শাস্তি দিয়েছে।
এই যুক্তি দ্বারা, প্লেগ কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় ছিল ঈশ্বরের ক্ষমা লাভ করা। কিছু লোক বিশ্বাস করত যে এটি করার উপায় হল তাদের সম্প্রদায়কে বিধর্মী এবং অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টিকারীদের থেকে মুক্ত করা। ফলে তারা ১৩৪৮-১৩৪৯ সালে হাজার হাজার ইহুদিকে গণহত্যা করা হয়েছিল।
ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ এর শেষ কিভাবে হয়েছিল?
প্লেগ সত্যিই শেষ হয় নি এবং এটি কিছু বছর পর পরই ফিরে আসে। তবে বন্দর নগরী কর্মকর্তারা আগত নাবিকদের কিছুদিন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে এর বিস্তারকে ধীর করতে সক্ষম হয়েছিলেন যতক্ষণ না এটি স্পষ্ট হয় যে তারা রোগটি বহন করছে না।
নাবিকদের প্রাথমিকভাবে তাদের জাহাজে ৩০ দিন ধরে রাখা হয়েছিল (একটি ট্রেন্টিনো),একসময় সময়কাল ৪০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। এই ৪০ কে ইতালিয়ান ভাষায় বলা হয় ‘কোয়ারিন্টিন’ আর কোয়ারেন্টাইন শব্দটি এখান থেকেই এসেছে। যা আজও ব্যবহৃত হয়।
প্লেগ কি এখনও আছে?
ব্ল্যাক ডেথ মহামারীটি ১৩৫০ এর দশকের গোড়ার দিকেও তার তান্ডব চালিয়েছিল। ১৩৫০ এর পর এর ভয়াবহতা কমে গেলেও এর পরবর্তী কয়েক শতাব্দী প্লেগ পুনরায় আবির্ভূত হয়েছিল। আধুনিক স্যানিটেশন এবং জনস্বাস্থ্য অনুশীলনগুলি এই রোগের সংক্রমণ কে ব্যাপকভাবে প্রশমিত করেছে কিন্তু এটি পুরোপুরি নির্মূল হয়নি।।
অবশ্য এখন ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগের চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এখনও প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ১০০০ থেকে ৩০০০ টি প্লেগ রোগের ঘটনা পাওয়া যায়।
Reference: Wikipedia,History