বিউলফ কাব্যটির সাথে ইংরেজি জাতি বা দেশের কোনো সম্পর্ক নেই। এই কাব্যের সব বিষয় ও চরিত্রগুলো জার্মান জাতির অন্তর্ভুক্ত। মূলত জার্মান জাতির পূর্বপুরুষের বীরত্বের কাহিনি বলা হয়েছে বিউলফ কাব্যে। তবে এই কাহিনি ইংল্যান্ডে এসে ইংল্যান্ডের মানুষের লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আরো পরিপুষ্ট হয়েছে। আর সেই ভিনদেশী চরিত্রই জাতীয় জীবনের জীবনকাব্য হয়ে উঠেছে
যেভাবে ইংল্যান্ডে বিউলফ কাব্যের কাহিনী এলো!
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রোমানরা ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। ছেড়ে যাওয়ার কারণ ছিলো বিশাল রোমান সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো, তার সাথে চলছিলো প্রাসাদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে কোন্দল।
আর এই সুযোগে ইংল্যান্ড আক্রমণ করে বসে জার্মান জলদস্যু অ্যাংলোস, স্যাকসন ও জুটসরা। এই জলদস্যুরা সুদক্ষ নাবিক ছিল। তাদের জাহাজে ছিল প্রশস্ত চিত্রিত পাল এবং সম্মুখটা ছিল দৈত্যদানব, নেকড়ে বাঘ বা কোনো হিংস্র জন্তুর মুখাবয়বের মতো।
প্রতিকূল বাতাসের বিরুদ্ধে লম্বা সারি সারি দাঁড় চালিয়ে তারা জাহাজ চালাত। যোদ্ধারা এইসব জাহাজে করে সমুদ্রে পাড়ি জমাত, সুদূর দেশে যাত্রা করত। সমুদ্রের প্রতি এদের ছিল গভীর ভালোবাসা মমত্ব ও প্রেম। দুঃসাহসিক অভিযান বলতে সামুদ্রিক অভিযানকে বোঝাত। এই সমুদ্র প্রীতি নিঃসন্দেহে ইংরেজ জাতির জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য ইংরেজ জাতির গর্ব থাকে। অবশ্য এই পর্ব ব্রিটেনদের চেয়ে অ্যাংলো-স্যাকসনদেরই বেশি প্রাপ্য। এই অ্যাংলো-স্যাকসন ও জুটসরা একসময় পুরোপুরি ব্রিটেনদের সাথে মিলেমিশে একপ্রাণ হয়ে যায়। কিন্তু তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের উপকথাগুলো হারিয়ে যায়নি প্রচলিত হতে থাকলো সাধারণ মানুষের মুখেমুখে।
কে রচনা করেছেন বিউলফ মহাকাব্য?
এই কাব্যটি যে জার্মানদের পূর্বপুরুষের তা তো আগেও বলছি এবং এটি একটি পৌরাণিক কাহিনী। গল্পটি মানুষের মুখে মুখো পরিচিত থাকলেও এই কাব্যটি কে রচনা করেছেন তা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায় নি। এবং এই কাব্য কখন রচনা হয়েছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে আনুমানিকভাবে ধারণা করা হয় কাব্যটি খ্রিস্টীয় ৮ম থেকে ১১শ শতাব্দীর গোড়ার মাঝামাঝি কোনো সময়ে রচিত।
বিখ্যাত ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক জে.আর. আর. টলকিন মতে, এই মহাকাব্য আংলো-স্যাক্সন প্যাগান ধর্মের একটি বিশ্বস্ত স্মৃতি। ৭০০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের খ্রিস্টীয়করণের কয়েক প্রজন্ম পরে এটি রচিত হয়। টলকেইনও কাব্যটিকে ৮ম শতাব্দীতে রচিত বলে মনে করেন। তার মত সমর্থন করেন টম শিপি ও অন্যান্যরা।
বিউলফ কাব্যের কাহিনী
প্রথম যুদ্ধ: গ্রেন্ডেল
বেউলফ মহাকাব্য শুরু হয়েছে রাজা হ্রথগারের কাহিনি দিয়ে। তিনি তার স্বজাতীয়দের জন্য হেওরট নামে এক বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। এই প্রাসাদে তিনি, তার স্ত্রী ওলেথথিউ ও তার যোদ্ধারা গান গেয়ে ও আনন্দ করে সময় কাটাতেন। এই আওয়াজে গ্রেন্ডেল নামে এক ট্রোল-আকৃতির দৈত্য বিরক্ত হলো। সে ছিল বাইবেলেরই চরিত্র কেইনের বংশধর। সে প্রাসাদটিকে আক্রমণ করে হ্রথগারের ঘুমন্ত যোদ্ধাদের অনেককে হত্যা করে খেয়ে ফেলল। হ্রথগার ও তার অবশিষ্ট যোদ্ধারা গ্রেন্ডেলকে পরাজিত করতে না পেরে হতাশ হয়ে হেওরট ছেড়ে চলে গেলেন।
গেটল্যান্ডের তরুণ যোদ্ধা বেউলফ হ্রথগারের সমস্যার কথা শুনে তার নিজের রাজার অনুমতি নিয়ে হ্রথগারকে সাহায্য করতে এলেন।
বেউলফ ও তার লোকেরা রাতে হেওরটে রইলেন। বেউলফ নিজেকে গ্রেন্ডেলের সমকক্ষ মনে করতেন, তাই তিনি কোনোরকম অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে রাজি হলেন না। বেউলফ ঘুমের ভান করে গ্রেন্ডেলকে আকর্ষিত করল। গ্রেন্ডেল তার কাছে এলেই সে খপ করে তাকে ধরে বসল। দুজনের মধ্যে এমন যুদ্ধ হল যে মনে হচ্ছিল প্রাসাদটা ভেঙেই পড়বে। বেউলফের সঙ্গীরা তরবারি উঁচিয়ে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। কিন্তু তাদের তরবারি গ্রেন্ডেলের শরীর খণ্ডিত করতেই পারল না। শেষে বেউলফ গ্রেন্ডেলের হাতটা কাঁধের কাছ থেকে ছিঁড়ে নিলেন। গ্রেন্ডেল জলায় নিজের ডেরার দিকে দৌড় দিল এবং আস্তে আস্তে মরে গেল।
দ্বিতীয় যুদ্ধ: গ্রেন্ডেলের মা
পরদিন রাতে গ্রেন্ডেলের পরাজয় উপলক্ষে উৎসব উদযাপিত হওয়ার পর হ্রথগার ও তার যোদ্ধারা হেওরটে ঘুমিয়ে পড়লেন। ছেলের শাস্তিতে ক্রুদ্ধ হয়ে গ্রেন্ডেলের মা সেই রাতে প্রাসাদে হানা দিল। গ্রেন্ডেলের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সে হ্রথগারের সবচেয়ে বিশ্বস্ত যোদ্ধা ইসচেরকে হত্যা করল।
হ্রথগার, বেউলফ ও তাদের লোকজন একটি হ্রদে গ্রেন্ডেলের মায়ের আস্তানার সন্ধান পেল। বেউলফ যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করল। আনফার্থ নামে এক যোদ্ধা বেউলফের সাফল্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে তাকে হ্রান্টিং নামে একটি তরবারি উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। হ্রথগার তার মৃত্যু হলে কি হবে তা নিয়ে কয়েকটি নির্দেশ দিলেন। এর মধ্যে ছিল তার আত্মীয়দের ব্যবস্থা এবং বেউলফের এস্টেটের উত্তরাধিকার আনফার্থকে দান। এরপর বেউলফ হ্রদের জলে ঝাঁপ দিলেন। বেউলফ সহজেই গ্রেন্ডেলের মায়ের সন্ধান পেলেন। বেউলফের গায়ে শক্ত বর্ম থাকায় গ্রেন্ডেলের মা তার কোনো ক্ষতি করতে পারল না। সে বেউলফে টেনে নিয়ে গেল হ্রদের একেবারে তলায়। একটি গুহায় গ্রেন্ডেলের দেহটা রাখা ছিল। সেই সঙ্গে তার হত্যা করা দুজনের দেহও ছিল। গ্রেন্ডেলের মা ও বেউলফের মধ্যে ঘোরোতর যুদ্ধ শুরু হল।
প্রথম দিকে গ্রেন্ডেলের মায়েরই জয় হচ্ছিল। বেউলফ দেখলেন হ্রান্টিং দিয়ে শত্রুকে বধ করা যাচ্ছে না। তিনি রেগে গেলেন। আবারও বেউলফের বর্ম তাকে রক্ষা করল। গ্রেন্ডেলের মায়ের ধনসম্পদের মধ্যে থেকে বেউলফ একটি জাদু তরবারি টেনে নিলেন এবং সেটি দিয়ে তার মাথা কেটে ফেললেন। আস্তানার আরও গভীরে গিয়ে বেউলফ দেখলেন গ্রেন্ডেলের দেহে তখনও প্রাণ আছে। তিনি গ্রেন্ডেলেরও মাথা কেটে ফেললেন। গ্রেন্ডেলের বিষাক্ত রক্তের স্পর্শ লাগতেই জাদু তরবারিটি বরফের মতো গলে গেল। শুধু হাতলটি অবশিষ্ট রইল। বেউলফ সেই হাতল আর গ্রেন্ডেলের মাথা নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এসে হেওরটে ফিরে সেগুলি হ্রথগারকে উপহার দিলেন। হ্রদের উপরে যখন বেউলফ উঠলেন তখন সময় ‘নবম ঘণ্টা’ (বিকেল ৩টে প্রায়)। হেওরটে হ্রথগার বেউলফকে অনেক উপহার দিলেন। তার মধ্যে ছিল (সম্ভবত) তার বংশগত উত্তরাধিকার নিগলিং তরবারি। যে হাতলটি বেউলফ এনেছিলেন সেটি দেখে রাজা দীর্ঘ ভাষণ দেন। এটিকে কখনও কখনও ‘হ্রথগারের উপদেশ’ বলা হয়। এই ভাষণে তিনি বেউলফকে নিজের গর্ব সম্পর্কে সাবধানী হতে বলেন এবং তার থেনদের পুরস্কার দিতে বলেন।
তৃতীয় যুদ্ধ: ড্রাগন
বেউলফ দেশে ফিরে এল এবং পরবর্তীকালে সে স্বজাতির রাজা হল। গ্রেন্ডেল ও তার মাকে হত্যা করার ৫০ বছর পরে একদিন এক ক্রীতদাস আর্নানেসে এক অনামা ড্রাগনের আস্তানা থেকে একতা সোনার পাত্র চুরি করে। ড্রাগন যখন দেখল যে তার পাত্র চুরি গেছে, সে রেগে যুদ্ধ করতে বের হল।
বেউলফ তার লোকজনকে বললেন যে তিনি একাই ড্রাগনটির সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন। তারা যেন টিলায় তার জন্য অপেক্ষা করে। বেউলফ ড্রাগনটির সঙ্গে যুদ্ধ করতে নামলেন। কিন্তু দেখলেন ড্রাগন তার থেকে অনেক শক্তিশালী। এই দেখে বেউলফের লোকজন প্রাণভয়ে ভীত হয়ে বনের মধ্যে পালিয়ে গেল। কিন্তু সিগলাফ নামে তাদের একজন বেউলফের সমস্যা দেখে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। দুজনে মিলে ড্রাগনটিকে হত্যা করলেন বটে। কিন্তু যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে বেউলফ মারা গেলেন।
বেউলফের মৃত্যুর পর, গেটল্যান্ডে একটি বিশাল চিতায় তাকে দাহ করা হল। তার লোকজনেরা তার জন্য শোকপালন করল। তারপর সমুদ্র থেকে দৃষ্ট একটি টিলায় বেউলফের দেহাবশেষের উপর তার সমাধিসৌধ নির্মিত হল। (বেউলফ, চরণ ২৭১২-৩১৮২)।