বেলি গানেজ নরওয়েজিয়ান বংশদ্ভূত মার্কিন মহিলা সিরিয়াল কিলার বেলি গানেসের পেশা ছিলো বিয়ে করা এবং তারপর তার স্বামীদের হত্যা করা। তৎকালীন মার্কিন সংবাদমাধ্যম তাকে লেডি ব্লুবার্ড উপাধি দিয়েছিলো। বেলি গানেস তার ১৫ জন স্বামী ও সন্তানসহ সর্বমোট ৪০ জনের অধিক মানুষ হত্যা করেছিলেন।
বেলি গানেসের জন্ম হয়েছিল নরওয়েতে। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি নিজের ভাগ্য ফেরাতে আমেরিকাতে অভিবাসী হন। বেলি গানেস ১৮৯৩ সালে তিনি প্রথম বিয়ে করেন ম্যাড সোরসান নামের এক ব্যক্তিকে।স্বামী স্ত্রী দুইজন মিলে তখন একটি কনফেকশনারি চালাতেন।ক্যারোলিন, এক্সেল, মার্টল আর লুসি নামে তাদের চার ছেলে মেয়ে ছিলো। সেই সাথে জেনি নামের একজন পালিত মেয়েও ছিলো।
হঠাৎ করেই একদিন তাদের দুই ছেলে মেয়ে মারা যায়। পেটের তীব্র ব্যাথায় তাদের মৃত্যু হয় বলে মনে হলেও আসলে এটাই ছিলো বেলি গানেসের প্রথম হত্যা। এই হত্যার মূল কারণ ছিলো যাতে তিনি নিজের সন্তানদের নামে করা লাইফ ইনসুরেন্সের টাকা তুলতে পারেন।
এরপর স্বামী স্ত্রী মিলে পরিকল্পনা করে একদিন নিজেদের কনফেকশনারি পুড়িয়ে দিলেন।দুজনের লক্ষ্যই ছিলো ইনস্যুরেনস এর টাকা হাতিয়ে নেওয়া। কিন্তু বেলি গানেসের উদ্দেশ্য ছিলো কিছুটা ভিন্ন রকমের।
যেদিন ম্যাড শোরসান ইনস্যুরেনস এর টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে আসেন, সেদিনই রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। ডাক্তাররা মৃতদেহে একটা রাসায়নিকের উপস্থিতি পেলেও সেটাকে ততটা গুরুত্ব দেননি। বরং মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট অ্যাটাককে দায়ী করেছিলেন।
ডাক্তার একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই বুঝতে পারতেন, শোরসান, এবং তার দুই সন্তানের শরীরেই আসলে স্ট্রিকনাইন নামের একটা রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছিলো। অত্যন্ত বিষাক্ত, বর্ণহীন এই বিষ দিয়েই বেলি গানেস তার স্বামী এবং সন্তানদের হত্যা করেছিলেন।
স্বামীকে হত্যার পর বেলি গানেস তার বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে। সেখানে তিনি ৪২ একরের বিশাল এক ফার্ম কিনে নেন। বেলি গানেস শান্তিতে বসবাস করার জন্য এই ফার্ম কিনেননি।
পরবর্তীকালে তার এই ফার্ম পরিচিতি পেয়েছিলো দ্য ডেথ গার্ডেন হিসেবে। এই ফার্ম হাউসেই তিনি তার বেশিরভাগ খুনগুলো করেছিলেন।
ফার্ম কেনার কিছুদিন পরেই তিনি তার ফার্মের একাংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন, এবং ইনস্যুরেনস থেকে আরো কিছু টাকা আদায় করেন।
১৯০২ এর পহেলা এপ্রিল তিনি পিটার গানেস নামক এক লোককে বিয়ে করেন। অবশ্য এটাকে বিয়ে বলাটা ভুল হবে। তিনি তারো আরো একটি শিকার জোগাড় করেন।
বেলি গানেসের নতুন স্বামীর দুটো মেয়ে ছিলো। বিয়ের কিছুদিন পরেই ছোট মেয়েটিরর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। বাবা পিটার গানেস সন্দেহ করেছিলেন যে কিছু একটা নিশ্চয়ই গড়বড় আছে। এই ঘটনার পর তিনি তার বড় মেয়ে সোয়ানহিল্ডকে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দেন। এই একমাত্র মেয়েটিই বেলি গানেসের খুনি হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
বেলি গানেসের দ্বিতীয় স্বামী মারা যান ১৯০৩ সালে। বলা হয়েছিলো রান্নাঘরের জাঁতাকল মাথায় পড়ে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু, বেলি গানেসের আগের পক্ষের মেয়ে জেনি খুনটা দেখে ফেলেছিলো। সে তার বান্ধবীকে বলেছিলো, আমার মা আমার সৎ বাবাকে জাঁতাকল দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।
পোস্ট মর্টেমের সময় আবারও মৃতের শরীরে স্ট্রিকনাইনের সন্ধান পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, প্রথমে বিষ প্রয়োগ করে পরে দুর্ঘটনার ঘটনা সাজানো হয়েছিলো। কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যও বিষ প্রয়োগ করা হয়ে থাকতে পারে।
অবশ্য স্বামীর মৃত্যুর পর বেলি গানেস হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করেন। এবং তার এ আহাজারি দেখে তখন কেউই সন্দেহ করতে পারেনি যে পিটারের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলো না। স্বামীর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই বেলি ইনস্যুরেনস এর টাকা তুলে ফেলেন। স্বামীর মৃত্যুর ছয়মস পরেই তিনি এক পুত্র সন্তানের মা হন। ছেলেটির নাম রাখেন ফিলিপ গানেস।
এরপর বেলি গানেস আর বিয়ে করেননি। তিনি শুরু করলেন তার নতুন “ব্যবসা”। তিনি পত্রিকায় বিয়ের বিজ্ঞাপন দিতেন। বিজ্ঞাপনে শর্ত থাকতো, বিয়েতে আগ্রহী পুরুষকে অবশ্যই তার সেভিংস এর টাকা নগদ নিয়ে কনে দেখতে কনের “বাড়িতে” আসতে হবে।
এই বিজ্ঞাপন দেখে অনেক পুরুষই টাকাপয়সা নিয়ে বেলি গানেসের ফার্ম হাউসে যেতেন,কিন্তু আর কখনও ফিরে আসতেন না। আকৃতিতে বেলি গানেস ছিলে দীর্ঘ দেহী সেই সাথে ২০০ পাউন্ডের বিশাল শরীর। খুব সহজেই তিনি যে কোনো সাধারণ গোছের পুরুষকে ধরাশায়ী করে ফেলতে পারতেন। জন মু, হেনরি গারহোল্ট, ওলফ সেভেনহার্ড, ওল বি বাডসবার্গ, ওলাফ লাইন্ডব্লুম, আন্দ্রে হেগেলিন সবাই ছিলেন সেই শিকারের তালিকায়। আরো অনেক মানুষই বেলির হাতে খুন হয়েছিলেন, যাদের সঠিক পরিচয় জানা যায় নি।
তবে এদের মধ্যে থেকে আন্দ্রে হেগেলিন এর ভাই তার ভাইয়ের খোঁজ নিতে শুরু করেন এবং আন্দ্রে হেগেলিন এর অন্তর্ধান নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এরপর থেকেই বেলি গানেসের বিপদের দিন ঘনিয়ে আসতে শুরু করে।
ফেব্রুয়ারি ১৯০৮
বেলি গানেসের ফার্মহাউজে আবারও আগুন জ্বলে উঠলো। ফার্মহাউজ পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। উদ্ধারকারীরা গানেসের বাকি তিন সন্তানের লাশ পেলেন। তাদের খুন করা হয়েছিলো। পাশে আরেকটা মাথাবিহীন লাশ পড়ে ছিলো। তবে ওটা গানেসের লাশ ছিলো না। বেলি গানেস দীর্ঘদেহী ছিলেন, অন্যদিকে গলাকাটা লাশটা ছিলো ক্ষীন দেহের।
তবুও উদ্ধারকারীরা নিশ্চিত হতে চাইলেন। শুরু হলো মাথার খোঁজে বাগানবাড়ি খোঁড়া। না, মাথা পাওয়া যায়নি। তবে, একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করলো একের পর এক কঙ্কাল। শুধু সেই বাগানবাড়ি থেকেই বারোজনের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়, যারা পুলিশের খাতায় এতদিন নিখোঁজ ছিলেন। কঙ্কালগুলোর মধ্যে কিছু শিশুর কঙ্কালও ছিলো।
বেলি গানেসের আসলে কী হয়েছিলো, সেটা এখনও অমীমাংসিতই থেকে গেছে। তবে, তার বাড়িতে আগুন দেওয়ার অপরাধে রে ল্যাম্ফার নামের এক প্রতিবেশীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধারণা করা হয় রে ল্যাম্ফারকে স্বয়ং বেলি গানেসই ভাড়া করেছিলেন, তার ফার্ম হাউজে আগুন দেওয়ার জন্য। শুধুমাত্র আগুন দেওয়ার অপরাধটা ল্যাম্ফার স্বীকার করেছিলেন; কিন্তু তার দাবি ছিলো খুনের কোনো ঘটনার কথাই তিনি জানতেন না। ল্যাম্ফার কখনওই বেলি গানেসের মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করেননি। বেলি গানেসের ফার্মহাউজে আগুন লাগার কিছুদিন আগেই বেলি গানেস তার বেশিরভাগই টাকা পয়সা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছিলেন।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হলো, বেলি গানেস কি আসলেই সব টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন? নাকি ঐ মুন্ডুহীন লাশটা বেলি গানেসেরই ছিলো?
জেলে মৃত্যুবরণ করার ঠিক আগে রে ল্যাম্ফার এই সত্যটা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পুরোটাই ছিলো বেলি গানেসের প্ল্যান। মুন্ডুহীন লাশ রেখে তিনি আসলে নিজের মিথ্যা মৃত্যু সাজাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃতদেহের সাথে তার দৈত্যাকার দেহের কোনো মিল ছিলো না।
কিন্তু এই সত্যটা আসলে কোন কাজেই আসেনি। বেলি গানেসের আর কোনো সন্ধান কখনওই পাওয়া যায়নি। এমনকী তার মৃত্যু সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
তবে ১৯৩১ সালে এস্টার কার্লসন নামের এক মহিলা লস অ্যাঞ্জেলসে বিচারাধীন অবস্থায় মারা যায়। তার বিরুদ্ধে এক লোককে বিষ দিয়ে হত্যার অভিযোগ ছিলো। কার্লসনের চেহারা এবং শারীরিক গঠনের সাথে বেলি গানেসের একটা মিল পাওয়া যায়। তারা প্রায় একই বয়সেরই ছিলেন। আবার কার্লসনের একটা ছবি পাওয়া যায় তার তিনটা সন্তানের সাথে। এটাও বেলি গানেসের সাথে মিলে যায়। তবে এরপরও এটা অনিশ্চিত। এবং নিশ্চিত করে আসলে কিছুই বলা যায় না।
সেই বাগানবাড়িতে পাওয়া লাশের ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছিলো ২০০৮ সালে। কিন্তু স্যাম্পলটা ব্যবহার উপযোগী ছিলো না। কাজেই, শেষ পর্যন্ত বেলি গানেসের এই রহস্যটা অমীমাংসিতই থেকে গেলো। যার সমাধান আজও হয়নি।
এখন প্রশ্ন হলো, বেলি গানেস কেন এমন হয়েছিলেন? কোনো মানুষই আসলে অপরাধী হয়ে জন্মান না। এই অপরাধের পেছনের মনস্তত্ত্ব কী? একটা আইরিশ টিভি ডকুমেন্টারিতে বর্ণনা পাওয়া যায় এমন,নিজ দেশে থাকার সময় বেলি গানেস উনিশ বছর বয়সে প্রেগনেন্ট অবস্থায় বারে নাচতে গিয়েছিলেন। সেখানে একজন বড়লোকের ছেলে তার পেটে লাথি মারেন, এবং এতে তার গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিলো। এর কিছুদিন পরেই ঐ বড়লোকপুত্রের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এবং ঐ সময় থেকেই বেলি গানেসের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে আমেরিকায় এসে তিনি পরিণত হন ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত এবং নিষ্ঠুর সিরিয়াল কিলারে।
অর্থের প্রতি অন্তহীন লোভ যে একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে,তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বেলি গানেস। যার কাছে নিজের সন্তানদের হত্যা করে ইনস্যুরেনস বাগিয়ে নেওয়াটা তার কাছে ছিলো শুধুই একটা খেলা। এই ভয়ঙ্কর খেলার গল্প পড়ে মানুষ আজও শিহরিত হয়।