পহেলা এপ্রিল সারা বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘এপ্রিল ফুলস ডে’। এই দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে নিজের আশেপাশের মানুষদের সাথে প্রাঙ্ক করা মানে বোকা বানানো। তবে বোকা বানানোর এই পশ্চিমা সংস্কৃতি নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের মাঝে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্প গুলো মোটেই সত্যি নয়।
সচরাচর এপ্রিল ফুল নিয়ে ঘুরেফিরে ৩ এটি গল্প শোনা যায়।
গল্প ১
৭১১ সাল থেকে স্পেনে মুসলিমদের দখলে যাওয়ার পর থেকেই স্পেন জ্ঞান- বিজ্ঞান ও সভ্যতায় ইউরোপের অন্য অঞ্চলে তুলনায় বহুগুণে এগিয়ে যায়। দীর্ঘ দিন মুসলিম শাসনের পর প্রায় ৮০০ বছর পর ১৫ শতকের শেষ দিকে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলার নেতৃত্বে স্পেনের বিভিন্ন শহর দখন করে নিতে থাকে সৈন্যরা। তবে প্রায় সব শহর হাতছাড়া হয়ে গেলে গ্রানাডা তখনো মুসলিমদের দখলেই ছিল।
দীর্ঘদিন শহরে অবরুদ্ধ থাকার পর ১৪৯২ সালে মুসলিম শাসকগণ সিদ্ধান্ত নেন তারা আত্মসমর্পণ করবেন। আত্মসমর্পণের সময় স্প্যানিশদের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেসকল মুসলিম মসজিদে আশ্রয় নেবে। তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। ফলে দলে দলে মুসলিম রা মসজিদে প্রবেশ করে। আর স্পেনিশরা মসজিদের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মসজিদে আগুন দিয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলিম পুড়িয়ে মারে। আর বাহিরে আনন্দে চিৎকার করতে থাকে বোকাদের দল! বোকাদের দল।
মুসলমানদের বোকা বানিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ইউরোপ থেকে মুসলিমদের বিতাড়িত করার দিন হিসেবে এখনো এপ্রিলের ১ তারিখকে বোকা বানাবার দিন হিসেবে পালন করে পশ্চিমারা।
গল্প ২
দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও যখন স্পেনিশরা গ্রানাডা দখল করতে পারছিলো না, তখন স্পেনিশরা ভারী চিন্তায় পড়ে যায়। তখন তারা শুরু করে এক ষড়যন্ত্রের। তারা নানান ছলচাতুরী করে শহরে ভেতর প্রচুর মদ ও সিগারেট শহরের ভেতর পাঠায়। এসব মদ সিগারেট পেয়ে মুসলিমরা নেশায় বুদ হয়ে যায়। একসময় আল্লাহর উপর ভয়ভীতি ও হারিয়ে ফেলে।
এরপর এপ্রিলের ১ তারিখ গ্রানাডার পতন হয়। মুসলমানদের পানীয় এবং সিগারেট দিয়ে বোকা বানিয়ে গ্রানাডা দখল করার দিবস হিসেবে পশ্চিমারা এখনো এই দিনটিকে ‘এপ্রিল ফুল’স ডে’ হিসেবে পালন করে।
গল্প ৩
১৪৯২ সালে রাজা ফার্ডিনান্দ ও রাণী ইসাবেলার বাহিনী গ্রানাডা প্রবেশের আগে মুসলিমদের সাথে চুক্তি করে যে তাদেরকে জাহাজে করে আরবে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পরে শহর দখল করে যখন জাহাজে করে সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল ভূমধ্যসাগর দিয়ে, তখন মাঝসাগরে এসে সবগুলো জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।
কোথাও কোথাও বলা হয় জাহাজেই স্প্যানিশরা সব মুসলিমকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়। দিনটি ছিল ১ এপ্রিল। এখনো পশ্চিমারা মুসলমানদের বোকা বানাবার দিনকে ‘এপ্রিল ফুলস ডে’ হিসেবে পালন করে।
যেভাবে স্পেন থেকে মুসলিমদের পতন ও গ্রানাডা দখল হয়েছিল
৭১১ সাল থেকে শুরু করে ১৫ শতক পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর স্পেন শাসন করেছে মুসলিমরা। তবে সময়ের সাথে সাথে সেই ক্ষমতা আর জৌলুশও হারাতে থাকে। ক্ষমতা হারানোর নেপথ্যে ছিলো রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইজাবেলার যৌথ শক্তি। ১৪৮২ সাল থেকে ফার্ডিনান্ড ও ইজাবেলা ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকে আর্থিক ও সৈন্য সাহায্য নিয়ে একে একে স্পেনের বিভিন্ন শহর দখল করতে থাকেন।
প্রায় সব শহর দখল করে ফেললেও গ্রানাডা দখল করতে পারছিল না। গ্রানাডা তখনো তৎকালীন মুসলিম শাসক দ্বাদশ মুহাম্মদের অধীনে ছিল।
১৪৯১ সালে গ্রানাডার বিভিন্ন জায়গা দখল করতে করতে তার শহরের প্রধান গেটের সম্মুখে চলে আসে। বেশ কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর দ্বাদশ মুহাম্মদ আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি ইসাবেলা এবং ফার্ডিনান্দ শহরে প্রবেশ করেন এবং দ্বাদশ মুহাম্মদের কাছ থেকে নগরের চাবি নেন।
এপ্রিল ফুল সত্য নাকি মিথ্যা?
পেগি লিসের লেখা ‘ইসাবেল দ্য কুইন’, জন এডওয়ার্ডের লেখা ‘ফার্ডিনান্দ এন্ড ইসাবেলা’ কিংবা আই.এল.প্লাঙ্কেটের লেখা ‘আ হিস্ট্রি অফ মেডিভাল স্পেন’ এসব বই থেকে জানা যায় যে, ২ জানুয়ারিতেই গ্রানাডা নগরীর পতন হয়। ঐদিন মসজিদে মানুষদের আটকিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়ার কোন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। এমনকি ঐদিন কোন গণহত্যা হয়েছে সেটাও কোন সমর্থিত সূত্র থেকে কখনো পাওয়া যায়নি।
মানব ইতিহাসের যখনি কোনো শহরে আক্রমণ হয়েছে তখনি রক্তপাত হয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বেশ কিছু সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমানদের একটা অংশকে স্পেন থেকে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। তবে অনেককে জোর করে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টাও চলেছে বেশ অনেক জায়গায়।
এপ্রিল ফুল নিয়ে যে জাহাজ ডুবি, মসজিদে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে হত্যা এসবের কোনো প্রমান নেই। এমনকি মদ সিগারেট দিয়ে মুসলিমদের পথভ্রষ্ট করার ঘটনাটিও মিথ্যা। মদ্যপানের সাথে বাকি পৃথিবীর মতো আরবরাও পরিচিত ছিল হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। আর সিগারেট তো সেদিনের আবিষ্কার।
এপ্রিল ফুল তাহলে কিভাবে এলো?
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে প্রাচীন রোমান উৎসব হিলারিয়া (যা উদযাপিত হত ২৫শে মার্চ) থেকেই এপ্রিল ফুল’স ডের উৎপত্তি।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে বছর শুরু হত ২৫ মার্চ। আর টানা ৮ দিনের উৎসবের শেষ দিন অর্থাৎ এপ্রিলের ১ তারিখ নববর্ষ উদযাপন হত। এরপর ষোল শতকে যখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু হয়, তখন নববর্ষ সরে যায় ১ জানুয়ারি। কোন কোন সূত্রমতে, ক্যালেন্ডার বদলাবার খবর অনেকেই না জানায় তারা ১ এপ্রিলেই নববর্ষ উদযাপন করতে যেয়ে বোকা বনে যায়। তখন থেকেই এই এপ্রিলের ১ তারিখে নিজেরা নিজেদের বোকা বানিয়ে মজা নেয়।