You are currently viewing আফ্রোদিতি: গ্রিক পুরাণের প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী

আফ্রোদিতি: গ্রিক পুরাণের প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী

প্রেমের দেবী আফ্রোদিতি দেবরাজ জিউসের কন্যা। গ্রীকভাষায় আফ্রোদিতি শব্দের অর্থ সমুদ্রোভূতা। রোমানদের কাছে আফ্রিদিতি পরিচিত ভেনাস নামে। গ্রীক মিথলজি অনুযায়ী আফ্রোদিতির বাড়ি ছিল বর্তমানে সাইপ্রাস আর সাইথেরা দ্বীপে।

আফ্রোদিতি কে গ্রীসের বাইরে সামান্য এক হীন কামকলার দেবী হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু গ্রীস দেশে এক স্বতন্ত্র মহিমায় অধিষ্ঠিত তিনি। গ্রীসে তাকে দেখানো হয়, ফুলে ফলে সুশোভিত এক রথের উপর তিনি আরূঢ়া, অদ্ভুত এক মিষ্টি সূক্ষ্মতা বিরাজ করছে তার দেহসৌন্দর্যের মধ্যে। তার রথটি বাহিত হয় কখনো কপোত, আর কখনো বা বনহংসের দ্বারা।

আফ্রোদিতির এক কটিবন্ধনী ছিল। সেই কটিবন্ধনীর এক অলৌকিক ক্ষমতা ছিল যা দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রেম জাগত যে কোন দেবতা বা মানবের মধ্যে। এই কটিবন্ধনী মাঝে মাঝে স্বর্গের অন্যান্য দেবীরা ধার নিতেন কাউকে নিজের প্রেমে বশে আনবার জন্য।

একবার হেরা (দেবতাদের রাণী) জিউসের সতত উড্ডীয়মান মনটাকে তার মধ্যে স্থিতবদ্ধ ও বিশ্বস্ত করে তোলার জন্য এই কটি বন্ধনী ধার নিয়েছিলেন।

হেরা credit : Wikipedia

আফ্রোদিতির প্রথম দিকে চিত্রকর বা ভাষ্করদের আঁকা চিত্র বা ভাষ্কর্যগুলো ছিলো অনেকটাই উত্তম পোশাকে সজ্জিত। কিন্তু পরবর্তীকালে গ্রীস ও অন্যান্য দেশের শিল্পীরা আফ্রোদিতির ছবি বা মূর্তি গড়ার ক্ষেত্রে নগ্নতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

আফ্রোদিতি credit: Wikipedia

ইংরেজ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কাব্যে দেখা যায় দেবী আফ্রিদিতি তার সুদর্শন প্রেমিক অ্যাডোনিসের প্রেমে উম্মাদ হয়ে আছেন। অ্যাডোনিসের প্রেমে তিনি এতোটাই মজেছিলেন যে স্বর্গলোক অলিম্পিয়াস ছেড়ে অ্যাডোনিসের সাথে পৃথিবীর বনজঙ্গলে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। সেখানে দেবী আফ্রোদিতি এ্যাডনিসকে শুধু বনের যত সব নির্দোষ ও নিরীহ জন্তুদের শিকার করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকেন। এ্যাডনিসের কিন্তু মোটেই ভাল লাগছিল না এসব। আফ্রোদিতির মত সে কিছুতেই মেতে উঠতে পারছিল না প্রণয়খেলায়।

আফ্রোদিতির প্রণয়ডোর হতে ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার জন্য সুযোগ খুঁজছিল সে। একদিন সে সুযোগ পেয়েও গেল। একদিন আফ্রোদিতি যখন তাকে আবেগভরে আলিঙ্গন করে বসেছিল গভীর বনপ্রদেশে তখন অদূরে একটা বন্য শূকর গোলমাল শুরু করায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুহূর্ত মধ্যে উঠে গেল এ্যাডনিস। শূকরটিকে হত্যা করার জন্য মেতে উঠল এক তীব্র সংগ্রামে।

এ্যাডনিস (copyright photo)

কিন্তু ভাগ্যদোষে সে সংগ্রামে জয়ী হতে পারল না এ্যাডনিস। শূকরটিকে মারতে গিয়ে নিজেই নিহত হলো সে। বুকভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আফ্রিদিতি। সব সান্ত্বনার সীমা ছাড়িয়ে তার বুকের মাঝে ফুলে ফুলে উঠতে লাগল তার শোকের আবেগ।

এ্যাডনিসের প্রতি আফ্রোদিতির এই শোকের তীব্রতা দেখে বিচলিত হয়ে উঠলেন মৃত্যুপুরীর রাণী। এদিকে তিনি নিজেও এ্যাডনিসের দেহসৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে উঠেছেন। তিনি এ্যাডনিসকে বিনা শর্তে ছেড়ে দিতে রাজী হলেন না। তিনি বললেন , তিনি শুধু একটা শর্তে ছেড়ে দিতে চান এ্যাডনিসকে। বললেন , এ্যাডনিস মাত্র ছ’মাস পৃথিবীপৃষ্ঠে থাকতে পারে ভেনাসের কাছে। বাকি ছ’মাস থাকতে হবে তার কাছে।

নরকের রাণী ‘পার্সিফোনে’ এ্যাডনিসকে এমনই ভালবেসে ফেলেছেন যে তিনি কোনমতেই চিরদিনের মত ছেড়ে দেবেন না তাকে। অবশেষে দেবরাজ জিউস মধ্যস্থতা করে দিলেন। তিনি ঠিক করে দিলেন চারমাস এডনিস থাকবে মৃত্যুপুরীতে রাণী পার্সিফোনের কাছে, চারমাস থাকবে মর্ত্যভূমিতে আফ্রোদিতির কাছে আর চারমাস নিজের ইচ্ছামত যেখানে খুশি থাকবে।

পার্সিফোনে

গ্রীসদেশের কিউপিড বা কামদেবতা আফ্রোদিতিরই সন্তান। অনেকের মতে আফ্রোদিতির বয়স একটু বেশী হলে কিউপিডের জন্ম হয়। কিউপিডের অন্য নাম হলো ইরস। ইরস বা কিউপিড যেমন কামের দেবতা, তেমনি লাভ হচ্ছে প্রেমের দেবতা। এ দেবতা সবচেয়ে প্রাচীন হয়েও একাধারে সবচেয়ে নবীন।

কিউপিডের ঠিক কিভাবে উদ্ভব হয় তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। তবে খেয়ালী কামদেবতা কিউপিডের চেহারাটিকে বড় অদ্ভূত করে দেখানো হয়েছে। তার দেহটি সম্পূর্ণ নগ্ন ; দুধারে দুটি পাখা আছে। তার চোখদুটি চিরমুদ্রিত। তাই তাকে বলা হয় চির অন্ধ অর্থাৎ মানুষের কামচেতনা চির দিনই যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিহীন। তার হাতে একটি মশাল আছে। এই মশালের আলোর তীব্রতা দিয়ে মানুষের অন্তরের দ্বীপকে প্রজ্জ্বলিত করতে চান।

তার তূণে কতকগুলি তীর আছে। তীরগুলির মধ্যে কিছু সোনার আর কিছু সীসের। সোনার তীর দিয়ে তিনি মানুষের অন্তরে প্রেমবোধকে ত্বরান্বিত করেন আর সীসের তীর দিয়ে মানুষের প্রেমচেতনাকে শ্লথ ও মন্দগতি করে দেন। আসলে কোন কিছু বিবেচনা না করেই নিজের খেয়াল খুশিমত ফুলশর নিক্ষেপ করেন কিউপিড। শোনা যায় কামের দেবতা কিউপিড আর মনের দেবতা সাইক একই সঙ্গে প্রথম আবির্ভূত হন খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দে। কিন্তু, প্রাচীন পুরাণে দেখা যায়, কিউপিডের বয়স হোমারের থেকে বেশী অর্থাৎ হোমারের আবির্ভাবের আগে থেকেই কিউপিডের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।

কামদেবতা ঈরসের এক ভাই আছে। তার নাম এ্যান্টিরস। একথা অনেকেই জানেন না। এ্যান্টিরস প্রেমগত প্রতিহিংসার দেবতা। কেউ কখনো কারো প্রেম অকারণে প্রত্যাখ্যান বা তুচ্ছজ্ঞান করলে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিশোধ নেন এ্যান্টিরস। দেবী এ্যাফ্রোদিতের অন্যতম সহচরী হচ্ছে হাইমেন। হাইমেনের হাতে মশাল আছে। মশাল হাতে হাইমেন কোন বিয়ের সময় কোরাস দলের নেতৃত্ব করে। ইউফ্রোসিনে , আগলাইয়া ও থেলিয়া — এই তিন জিয়াস কন্যা ছিল আফ্রোদিতির অবিরাম সহচরী। এরা সকলেই ছিল নগ্ন। এরা ছিল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দানুভূতির প্রতীক।

শোনা যায় দেবী আফ্রোদিতি স্বর্গের অন্যান্য দেবতাদের মধ্যে অগ্নিদেবতা হিফাস্টাসকে ৰেছে নেন স্বামী হিসাবে। কেন তা কেউ ঠিক বলতে পারে না। রোমে ভেনাসের (রোমান পুরাণে আফ্রোদিতির নাম ভেনাস) রোমান যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তিনি ট্রয়বীর ঈনিসের মাতা। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর মতে গ্রীস দেশে যে ভেনাসের উপাসনা করা হয় তাতে দেখা যায় দুটি মত প্রচলিত আছে। একটি মতের নাম ইউরানিয়াম আর একটি হলো প্যাণ্ডিমিয়ান। ইউরানিয়াম প্রেমের বিশুদ্ধ আত্মিক দিকটি তুলে ধরে। আর প্যাণ্ডিমিয়ান মতবাদ তুলে ধরে তার দেহগত ইন্দ্রিয় লালসার দিকটি।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ব্রিটনিকা এনসাক্লোপিডিয়া, গ্রীক পুরাণকথা

Leave a Reply