পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা মিশরীয় সভ্যতা। আজ থেকে প্রায় ৫ হাজারের ও বেশি সময় পূর্বে নীলনদের তীরে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। খ্রীস্টপূর্ব ৩২৩ সালে গ্রীক মহাবীর আলেক্সান্ডার মিশর আক্রমণ করার আগ পর্যন্ত তা টিকে ছিল।
আদিম প্রস্তর যুগ থেকেই মিশরের নীল নদীর তীরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল স্থায়ী বসতি। সেসময়ের মিশর আজকের দিনের মিশরের মতো মরুভূমির দেশ ছিল না। পশু শিকার এবং চাষাবাসের জন্য আদর্শ স্থান ছিল নীল নদের দেশ মিশর।
স্বাভাবিকভাবেই সেসময়ের মিশরের মানুষদের মধ্যেও প্রশ্ন জেগেছিল, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের? সূর্য, বাতাস, আলো, বৃষ্টি, বন্যা কিভাবে হয়? মানুষের মৃত্যু হলে তারা কোথায় যায়? আর এই প্রশ্ন থেকেই মিশরে সৃষ্টি হয় ধর্মের। প্রথমদিকে মিশরীয়দের ধর্ম বিশ্বাস ছিল যাদুবিদ্যাকে কেন্দ্র করে।এরপর বিবর্তনের ধারায় তা আসে দেব দেবীতে।
প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে লিখে রেখেছেন পাথরের গায়ে , সমাধি ক্ষেত্রে, গড়ছিলেন দেব দেবতাদের মূর্তি, মন্দির ইত্যাদি।
প্রাচীন মিশরে প্রায় ২,০০০ এর বেশি দেব দেবীর পূজা করার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে একজন দেবতা এক জায়গায় খুব বেশি জনপ্রিয় থাকলেও আরেক জায়গার মানুষের কাছে ছিলেন একেবারেই অপরিচিত নাম। আবার অনেক সময় দেবতা ছিলেন স্বয়ং মিশরের ফারাও নিজেই!
আজ আপনাদের সামনে থাকছে প্রাচীন মিশরের ১০ জন দেব দেবী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
ওরিসিস
মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিলেন ওসিরিস। ওসিরিস ছিলেন পরকালের বিচারক , শস্য এবং পূনর্জন্মের দেবতা। তাকে দেখানো হয়ে থাকে একজন মমিকৃত রাজা হিসাবে।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ওসিরিস মিশরের রাজা ছিলেন। তিনি তার ভাই সেথের দ্বারা খুন হয়েছিলেন। তার স্ত্রী আইসিস তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তার মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম পালিত হত বাৎসরিক উৎসবের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন সার্বজনীন ভাবে পূজিত দেবতা। কারন সম্ভবত মিশরীয়রা ছিল পূনরজন্মে বিশ্বাসী এবং অনন্ত জীবন প্রত্যাশী।
আইসিস
দেবী আইসিসের উৎপত্তি অস্পষ্ট। অনেক দেবতার বিপরীতে, তাকে একটি নির্দিষ্ট শহরের সাথে আবদ্ধ করা যায় না এবং প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যেও তার কোন নির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। সময়ের সাথে সাথে তার গুরুত্ব বেড়েছে, যদিও, অবশেষে প্যান্থিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবী হয়ে উঠেছে।
দেবী আইসিস স্ত্রী হিসেবে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তার স্বামী ওরিসিস কে তার ভাই সেথ হত্যা করলে তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এছাড়াও নিজের সন্তান হোরাসকেও দায়িত্বের সাথে লালন পালন করে বড় করে তুলেছিলেন; যা একজন মিশরীয় নারীর গুণাবলী কে তুলে ধরে।
তার সম্মোহন শক্তি এবং পতিভক্তির জন্য সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। আইসিস এবং ভগ্নি নেফথিস ছিলেন মৃতদের রক্ষাকারী। নেইথ এবং সেলকেত দেবীদের সাথে মৃতদের কফিন এবং অংগ প্রত্যঙ্গের পাত্র রক্ষা করতেন আইসিস। মিশরে মৃতদেহ থেকে লিভার এবং অনান্য প্রত্যংগ বার করে রাখা হত ঢাকনা দেওয়া জার বা পাত্রে এবং মৃতদেহকে মমী করে রাখা হত। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত মৃতরা এক সময় পূনর্জন্ম লাভ করবে। সে জন্য দেহ কে মমী করে সংরক্ষন করত।
আইসিস ছিলেন প্রাচীন মিশরীয় দেবতাদের মধ্যে একজন যাকে এখনও পূজা করা হয়। গ্রিকো-রোমান যুগে তাকে গ্রীক দেবী আফ্রোদিতির সাথে তুলনা করা হতো। দেবী আইসিস এর পরিচিতি ব্রিটেন থেকে আফগানিস্তান অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
অনেকে বিশ্বাস করেন যে দেবী আইসিস এর সাথে তার শিয়ু সন্তান হোরাস এর চিত্রগুলো যীশু খ্রিষ্টের সাথে মেরীর চিত্রকে প্রভাবিত করেছে।
হোরাস
হোরাস ছিলেন যুদ্ধ, শিকার ও আকাশের দেবতা। তিনি ছিলেন ওসিরিস এবং আইসিসের পূত্র। দেবতা সেথের হাতে ওসিরিস খুন হওয়ার পর তার জন্ম। মা আইসিস তাকে বড় করেন এবং ৮০ বছর ধরে যুদ্ধ করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন। বেশ কিছু পৌরাণিক তথ্য বলা হয়েছে সেথের সাথে লড়াই করতে গিয়ে সে নিজের বা চেখ হারিয়েছিলে। তবে দেবতা থথ জাদুকরী শক্তি দিয়ে সেই চোখের নিরাময় করেন।
লড়াইয়ে জিতে তিনি মিশরের শাসনকর্তা হিসেবে অভিসিক্ত হন। তিনি হলেন রাজাদের রক্ষাকারী পৃষ্ঠপোষক দেবতা। তিনি গ্রেট ইনিয়াড ৯ জন দেবতাদের একজন। ফ্যালকন বা ঈগল পাখির মাথাওয়ালা পুরুষ দেবতা হোরাস হলেন রাজাদের দেবতা।
সেথ
দেবতা সেথ ছিলেন ছিলেন বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, মরুভূমি এবং ঝড়ের দেবতা। পৌরাণিক কাহিনীতে, তিনি ছিলেন দেবতা ওসিরিসের হত্যাকারী (মিথের কিছু সংস্করণে, তিনি ওসিরিসকে একটি কফিনে শুইয়ে দেওয়ার জন্য কৌশল করেন এবং তারপরে এটি বন্ধ করে দেন এবং ওরিসিসের মৃত্যু হয়।)
সেথের চেহারা কেমন ছিল তা মিশরের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা গবেষকদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তাকে প্রায়শই বেশিরভাগ স্থানে একটি প্রাণী বা পশুর মাথা দিয়ে মানুষ হিসাবে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না সে কোন প্রাণী হবে। তার সাধারণত লম্বা থুতু এবং লম্বা কান থাকে যেগুলো ডগায় বর্গাকার। তার সম্পূর্ণ পশুর আকারে, তার একটি পাতলা কুকুরের মতো শরীর এবং একটি সোজা লেজ রয়েছে যার প্রান্তে একটি টুফ্ট রয়েছে। অনেক পণ্ডিত এখন বিশ্বাস করেন যে এই ধরনের কোন প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না এবং সেথ প্রাণীটি এক ধরণের পৌরাণিক সংমিশ্রণ।
তবে প্রাচীন মিশরীয়রা তাকে খুব ভয় এবং ভক্তি করত। গ্রীকরা তাকে দানব টাইফন এর সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
তাহ
তাহ ছিলেন মেমফিসের (কায়রোর নিকটবর্তী স্থান) উপাসিত প্রধান ৩ দেবতাদের একজন। তিনি ছিলেন এই ৩ দেবতার প্রধান। তার দলের বাকি ২ জন হলেন তার স্ত্রী সেখমেথ, সে ছিলো সিংহ মাথার দেবী। আরেকজন দেবতা হলেন নেফারটেম। মনে করা হয় সে তাহ ও সেখমেথ এর সন্তান।
দেবী সেখমেথ ছিলেন সূর্যদেবতার শত্রুদের ধ্বংসকারী আর নেফারটেম ছিলেন পদ্ম দেবতা
তাহ’র প্রতিকৃতি হল দেবতার পীঠস্থানে হাতে লাঠিওয়ালা মমিকৃত পুরুষ হিসেবে। তিনি ছিলেন সৃস্টিকর্তা দেবতা । তিনি তার চিন্তাশক্তি এবং নির্মান ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবী সৃস্টি করেন।
মেমফিসের বিশ্বাসমতে দেবতা সোকারের সাথে তিনি ছিলেন সমাধিক্ষেত্র রক্ষাকারী মৃতদের দেবতা।গ্রীক পন্ডিতদের মতে তাহ ছিলেন ধাতুকর্মের দেবতা হেফেস্টাস।
রে
রে ছিলেন প্রাচীন মিশরের সূর্য্য দেবতা। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত সূর্য্য হল জীবনের প্রতিচ্ছবি। সূর্য্যোদয়, সূর্য্যাস্ত, পূনরায় উদয় হওয়ার মতই জন্ম, মৃত্যু এবং পূনর্জন্ম।
রে দেবতা কে সূর্য চাকতি বা মাথায় সূর্য্য চাকতি বয়ে নিয়ে বেড়ানো ঈগল পাখির মাথা ওয়ালা একজন পুরুষ হিসেবে। তার প্রধান উপাসনা স্থল ছিল ইউনু বা হেলিওপোলিস( সূর্য্য নগরী) রে দেবতার বিভিন্ন রুপে আবির্ভূত হতেন, সকালে খেপরী( গুবরে পোকা ),বিকালে আটুম , এবং হোরাক্তি। গিজার স্ফিংসের মুর্তি হল হোরাক্তির প্রতিফলন।
রে ছিলেন ৯ জন দেবতা বা গ্রেট ইনিয়াড( Great Ennead) প্রধান। তিনি ছিলেন পরকালের সর্বোচ্চ বিচারক। মিশরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে বিবেচিত রে-পুত্র ছিলেন একজন মিশরীয় ফারাও।
মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন দেবতা রে প্রতিদিন একটি নৌকায় করে পুরো আকাশ জুড়ে ভ্রমণ করেন এবং প্রতি রাতে পাতাল দিয়ে একটি পথ তৈরি করেন, এই সময়ে তাকে আবার উঠতে সাপের দেবতা অ্যাপোপিসকে পরাজিত করতে হয়।
হাথর
হাথর হলেন মিশরীয়দের প্রেমের দেবী। তার প্রতিকৃতি হল গরু বা গরুর মাথা কিংবা শিং এবং কানওয়ালা মানবী। দেবী হাথর সঙ্গীত এবং মদিরার দেবী।
এছাড়াও তিনি মাতৃত্ব , সৃস্টির দেবী। অবিবাহিত মেয়েদের রক্ষাকারী এবং রাজাদের অন্নদাতা। দেবতা বেস এর সাথে তিনি মহিলাদের সন্তান জন্মের সময় রক্ষা করতেন।
তিনি মিশরের সিনাই এলাকার খনি রক্ষাকারী দেবী, হোরাসের পত্নী এবং হোর-মা তাওয়ী’র মা। দেবী হাথর গ্রীক পৌরানিক প্রেম ভালবাসার দেবী আফ্রোদিতি’র সমকক্ষ।
আনুবিস
আনুবিস হলেন শেয়াল দেবতা। সমাধিক্ষেত্রে শেয়ালের আনাগোনা থাকতো, সেই থেকে তাকে মিশরীয়রা মৃতদেহের দেবতা হিসেবে পূজা করতে থাকে।
দেবতা আনুবিস ছিল শেয়ালের বা বন্য কুকুরের দেহ অথবা শেয়ালের মাথা ওয়ালা দেবতা আনুবিস। ওসিরিসের আগে আনুবিসকে পূজা করা হত মৃতদেহ সৎকারের দেবতা এবং সমাধিক্ষেত্রের রক্ষক হিসেবে। আনুবিসের কাছেই মিশরীয়রা মৃতদের জন্য প্রার্থনা করতেন।
তিনি ওসিরিসের মৃতদেহকে সর্বপ্রথম মমীতে রুপান্তরিত করেন এবং সেই থেকে মমী প্রস্তুতের দেবতা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। মৃত্যুর পর তিনি মৃতব্যাক্তিদের পথ দেখিয়ে থাকেন।
থথ
থথ ছিলেন প্রাচীন মিশরের চন্দ্র দেবতা। তার প্রতিকৃতি হল সারস শ্রেনীর পাখি আইবিসের মাথাওয়ালা একজন পুরুষ। থথের কাছে আইবিস পাখি এবং শুকর হল পবিত্র।
এছাড়াও লেখন পদ্ধতির আবিস্কারক দেবতা থথ। মৃত্যুর পর বিচারের রায় তিনি লিখে রাখতেন মিমুসপ গাছে। থথের কাছে থাকা বইতে পৃথিবীর সমস্ত তথ্য থাকত।
গ্রীক পুরানের দেবতাদের দুত হারমিস এর সমকক্ষ ধরা হয় থথকে।
বাস্টেট
বাস্টেট ছিলেন প্রাচীন মিশরের বিড়ালের দেবী। বাস্টেট এর প্রতিকৃতি একজন বিড়াল বা সিংহের মাথাযুক্ত একজন নারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বাস্তেত কে প্রায়শই একটি রাজকীয় চেহারার উপবিষ্ট বিড়াল হিসাবে উপস্থাপন করা হয়, কখনও কখনও তার কানে বা নাকে আংটি পরতে থাকতে দেখা যায়।
বাস্তেত ছিলেন কুমারী তা সত্বেও তার একপুত্র ছিলো, নাম মিহোস। গ্রীক পোরানিক শিকারের দেবী আর্টেমিসকে বাস্তেতের সমক বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
আমুন
আমুন শব্দের অর্থ অদৃশ্যমান। তার প্রতিকৃতি হল মাথায় লম্বা দুই পালক সমৃদ্ধ টুপি এবং হাতে দন্ড নেওয়া একজন পুরুষের। তার প্রিয় হল ভেড়া এবং রাজহাস যারা পুরুষত্বের চিহ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩৯ থেকে ১২৯২ সাল পর্যন্ত আমুন স্থায়ীভাবে থিবিস শহরের একচ্ছত্রভাবে পূজিত হতেন। আমুন এর প্রতিক ছিল মেষ ও হংস।
মিশরের মধ্যম রাজবংশের যুগে তাকে “রা” এর সাথে একসাথে “আমুন-রা” হিসেবে পূজা করা হত। অস্টাদশ রাজবংশের যুগে আমুন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে পুজিত হন।
থিবসের শাসকরা হাইকসোস নামে পরিচিত বিদেশী শাসকদের একটি রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরে এবং মিশর জুড়ে স্থানীয় মিশরীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর, আমন তাদের বিজয়ের জন্য কৃতিত্ব পান।
দেবতাদের রাজা হিসেবে পূজনীয় আমুনের সুবিশাল মন্দিরের অস্তিত্ব আজো মিশরের কারনক এ দাড়িয়ে আছে।
Reference: Wikipedia, Britanica Encyclopedia & Ancient Egypt, Mythology