You are currently viewing এলিস কাইটেলার: ১৪ শতকের এক আইরিশ ডাইনী

এলিস কাইটেলার: ১৪ শতকের এক আইরিশ ডাইনী

এলিস কিটেলার ১৩ শতাব্দীর শেষ দিক ও ১৪ শতকের শুরুর দিকের একজন কুখ্যাত নারী। তার জন্মসাল সম্ভবত ১২৮০ সালে। এলিস কিটেলার ছিলেন তার সময়ে সবচেয়ে সুন্দরী, ধনী ও প্রভাবশালী নারীদের মধ্যে একজন।

বিভিন্ন পুরোনো দিনের নথির তথ্যমতে এলিস কিটেলার আয়ারল্যান্ডের কিলকেনি শহরে বসবাস করতেন। সেখানেই তিনি ৪ জন পুরুষকে বিয়ে করেছিলেন, তার মধ্যে ৩ জন কে হত্যা করেছিলেন,১৩২৪ সালে আরেকজনকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় রেখে পালিয়ে যান।

লেডি এলিসের প্রচুর ধনসম্পত্তি থাকায় তিনি প্রচুর অহংকারী হয়ে উঠেন। তার অহংকারী, উদ্ধত ও অবাধ্য আচরণের জন্য তার প্রতিবেশীরা তাকে পছন্দ করতো না।

সেসময়ে এলিস কাইটেলার সম্পর্কে প্রতিবেশীদের মধ্যে গুজব ও কানাগুশো ছিলো যে এলিস কাইটেলার জাদুবিদ্যা ও ডাকিনীবিদ্যার অনুশীলন করেন। তবে সেসময়ে এসবের কোনো প্রমান পাওয়া যায় নি।

এলিস কাইটেলারের প্রথম স্বামী ছিলেন উইলিয়াম আউটালাওয়ে। তিনি ছিলেন একজন ব্যাংকার এবং সেই সাথে নিজেও সুদের বিনিময়ে অর্থঋণ দিতেন মানুষদের। অস্বাভাবিকভাবে উইলিয়াম আউটালাওয়ে ১৩০২ সালের দিকে মারা যান।

এলিস কাইটেলার কে নিয়ে বানানো ভাষ্কর্য Image Credit: medium

প্রথম স্বামী উইলিয়াম আউটালাওয়ের মৃত্যুর পর এলিস কাইটেলার অ্যাডাম লে ব্লান্ড নামের আরেকজন ধনী ব্যাক্তিকে বিবাহ করেন, এই ব্যক্তি মারা যান ১৩১১ সালের মধ্যে।

এরপর এলিস কাইটেলার বিয়ে করেন রিচার্ড নামের আরেকজন লোক কে এবং তিনিও খুব শীঘ্রই মারা যান। এলিস কাইটেলার এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্বামীর এর আগেও বিয়ে হয়েছিল কিন্তু স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিল এবং তাদের সন্তান ও ছিলো। পরপর তিনটে মৃত্যুর পর সেইসব সন্তানেরা বিষয়টিকে কিছুটা সন্দেহজনক মনে করেছিলেন।

এরপর এলিস কাইটেলার তার চতুর্থ বিয়ে করেন এবং তার সর্বশেষ স্বামী জন লে পোয়ার ১৩২৪ সালে অদ্ভুত একটি রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। জন লে পোয়ারের হাত ও পায়ের নখ পড়ে যায় এমনকি মাথার চুলগুলো।

এলিস কাইটেলারের সন্তানেরা লক্ষ করে দেখেন যে তাদের আগের বাবা রা ও একই রকম অদ্ভুত অসুস্থতায় মারা গিয়েছিলেন।

জন লো পোয়ার তার স্ত্রী এলিস কাইটেলার কে খুব ভালোবাসতেন, তাই সন্তানেরা তাকে এই বিষয়ে বুঝাতে চাইলেও শুরুতে তিনি তা কানে তুলেন নি। কিন্তু যখন এলিস কাইটেলারের একজন দাসী তাকে এই ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত দিলেন, তখন জন বুঝলেন এই বিষয়টা উপেক্ষা করা বোকামি হবে।

জন সিদ্ধান্ত নিলেন এই ব্যাপারটা তিনি নিজে তদন্ত করে দেখবেন। তিনি তার স্ত্রী এলিস কাইটেলারের কাছে তার ঘরের চাবি চাইলেন। কিন্তু এলিস তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অনেক জোড়াজুড়ির পর জন এলিস থেকে চাবি ছিনিয়ে নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে প্রবেশ করে জন দেখতে পান ঘরে অনেকগুলো বাক্স রয়েছে। কিন্তু সবগুলো বাক্সই তালাবদ্ধ। জন সবগুলো বাক্স খুলে দেখতে পান এখানে তার স্ত্রীর সব অপকর্মের প্রমান রয়েছে। তার স্ত্রী তাকে প্রতিদিন অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে চলেছে এবং সে গভীরভাবে জাদুবিদ্যা ও ডাকিনীবিদ্যার সাথে জড়িত।

জন সেইসব বক্সে থাকা অদ্ভুত সব গুঁড়ো, শিশি, ঔষধ এবং শয়তানের নামে খোদাই করা পাউডারের যন্ত্রগুলো একত্রিত করে সেগুলো দুজন ব্যক্তির সুরক্ষায় চার্চের বিশপের কাছে পাঠান।

বিশপ এই ঘটনাকে তদন্ত করে দেখতে রিচার্ড ডি লেড্রেড নামের একজন তুখোড় তদন্তকারীকে নিয়োগ করেন। তিনি তদন্ত করে এলিস কাইটেলারের জাদুবিদ্যা ও বিষপ্রয়োগের প্রমাণ পান।

এলিস কাইটেলার দোষী সাব্যস্ত হলে তার সকল সম্পত্তি গির্জা বাজেয়াপ্ত করে। বিশপ এলিস কাইটেলার কে বিভিন্ন ধরনের জাদুবিদ্যায়’ জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন এবং তার নিজের ছেলে উইলিয়াম আউটলাওয়ে এবং তার ব্যক্তিগত দাসী পেট্রোনিলা ডি মিথ সহ এগারো জন সহযোগীসহ তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।

১৩ শতকের কিলকেনি ক্যাসেল Image credit : Ancient Origin

বিষপের তদন্তে এলিস কাইটেলারের বিরুদ্ধে সাতটির অধিক ভয়ংকর অভিযোগ করা হয়েছিল, যা আয়ারল্যান্ডের কিলকিনের বাসিন্দারা তা মুগ্ধ হয়ে আতঙ্কের সাথে শুনেছিল।

এলিস কাইটেলারের সাথে তার অনেকজন সহযোগী ছিলো যারা ডাকিনীবিদ্যা চর্চা করতো। এলিস কাইটেলার ও তার সহযোগীরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোকে উপহাস করতো এবং তারা ডাকিনীবিদ্যা অর্জনের জন্য ভয়ংকর কিছু আচার পালন করতো বলে অভিযোগ ও প্রণাম দেন বিশপ।

এলিস কাইটেলার ও তার সঙ্গীরা জীবন্ত প্রাণীকে শয়তানের নামে উৎসর্গ করে বলি দিতো এবং সেই প্রূণীর অঙ্গ শহরের রাস্তাগুলোতো বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতো।

এছাড়াও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া অপরাধীদের চুল, মৃত পুরুষের আঙ্গুলের নখ, পশুর অন্ত্র, কৃমি, বিষাক্ত ভেষজ এবং মারা যাওয়া শিশুদের মাংস সহ বিভিন্ন উপাদান ও তন্ত্র মন্ত্র করে এক ধরনের গলুই তৈরি করতো।

আর এই সমস্ত জিনিসগুলোকে কোনো এক ডাকাতের খুলিতে একসাথে রেখে ফুটাতো, এই ডাকাতের খুলি পেতো যে ডাকাত ধরা পড়ার পর তাকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে।

এলিস কাইটেলার কে নিয়ে আঁকা একটি আর্টওয়ার্ক Image source: Google

এছাড়াও এলিস কাইটেলারের এক সহযোগী ও তার দাসী তার জবানবন্দিতে বলেছে এলিস কাইটেলার কখনো কখনো বিশাল বিড়াল আকারের কোনো প্রাণীর সাথে যৌনসম্পর্ক করতো, শয়তান কে খুশি করার জন্য, তবে কি প্রাণী ছিলো তা সে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না।

বিশপ এলিস কাইটেলারের সকল কর্মকাণ্ডের প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকেন। তার ডাকিনীবিদ্যা চর্চা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকলেও এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিলো না যে এলিস কাইটেলার তার ৪ জন স্বামীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঔষধ ব্যবহার করে, যার মধ্যে ৩ জন মারা ও গেছে।

এলিস কাইটেলারের টাকার প্রতি অতৃপ্ত লোভ ছিল। তবে এলিস কাইটেলারের একমাত্র সত্যিকারের আনুগত্য ছিল তার প্রিয় পুত্র উইলিয়াম আউটলাওয়ের প্রতি, যিনি তার শয়তানী কর্মকাণ্ডের একজন শিষ্য।

এলিস কাইটেলার একটি আচার পালন করতেন যার উদ্দেশ্য ছিলো ছেলে উইলিয়াম আউটালাওয়ের কে ধনী করা। আর এজন্য তিনি সূর্যাস্তের সময় কিলকেনি শহরের রাস্তায় একটি ঝাড়ু নিয়ে যেতেন এবং সমস্ত ময়লা ও ধূলিকণা নিজের ছেলের বাড়ির দিকে ঝাড়ু দিতেন এবং বলতেন:-

আমার ছেলে উইলিয়ামের বাড়িতে কিলকেনি শহরের সমস্ত সম্পদ হেঁটে হেঁটে আসুক।

সেসময় এলিস কাইটেলার কে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া বিশপের পক্ষে ছিল এক জিনিস,আর তাকে হেফাজতে নেওয়া ছিল অন্য জিনিস। বিশপ চারপাশ থেকে বাধাগ্রস্ত হতে থাকেন। কারণ সেসময় পর্যন্ত আয়ারল্যান্ডে জাদুবিদ্যা বা ডাকিনীবিদ্যা চর্চা একটি ধর্মনিরপেক্ষ অপরাধ ছিল,যা চার্চের এখতিয়ারের অধীনে ছিল না। তাই বিশপক আয়ারল্যান্ডের লর্ড চ্যান্সেলরকে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের জন্য একটি রিট জারি করতে বলা হয়েছিল।

কিন্তু এই চ্যালেন্সার ছিলেন এলিস কাইটেলারের প্রথম স্মামীর আত্মীয় এবং তিনি ছিলেন এলিস কাইটেলারের সমর্থক।

তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে সকল আইন নিজের হাতে তুলে নেন বিশপ। তিনি চার্চের আদালতে এলিস কাইটেলার কে নিয়ে আসার জন্য দুজন প্রতিনিধি পাঠান। এলিস কাইটেলার বিপশের এখতিয়ার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি বলেন ধর্মীয় আদালতের এই ধরনের মামলার বিচার করার ক্ষমতা পায়নি। এতোকিছুর পরেও চার্চের আদালতে বিচার বসেছিল বিচারে বিশপ তাকে দোষী সাব্যস্থ করেন।

এই ঘটনার পর এলিস কাইটেলারের সমর্থকরা বিশপকে ১৮ দিনের জন্য কিলকেনি ক্যাসেলে বন্দী করে রাখে। এবং এলিস কাইটেলার মানহানীর অভিযোগে একটি সেক্যুলার আদালতে অভিযোগ করেন।

বিশপ তার প্রতিজ্ঞায় সংকল্প থাকেন এবং এলিস কাইটেলারকে তার অপকর্মের জন্য দোষী সাবস্ত করার ব্যাপারে অটল থাকেন। শেষ পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ আদালত বিশপকেই আবার দায়িত্ব দেন এই মামলার বিচার করার জন্য। কিন্তু ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে এলিস কাইটেলার তার অভিজাত সহকর্মীদের সাহায্যে তার দামী গহনা ও অর্থসম্পদ নিয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান এবং বাকি জীবন তিনি সেখানেই কাটান।

এলিস কাইটেলার পালিয়ে গেলেও তার সহযোগীরা পালাতে পারে নি। এলিস কাইটেলারের সকল সহযোগীকেই চার্চের আদালতে শাস্তি দেওয়া হয়। তবে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল এলিস কাইটেলারের দাসী পেট্রোনিলা ডি মিথকে। তিনি ছিলেন আয়ারল্যান্ডে পোড়ানো প্রথম ডাইনি।মৃত্যুর আগে তিনি বলছিলেন ডাকিনীবিদ্যায় এলিস কাইটেলারের কাছে তিনি শিশু মাত্র। সে এটাও বিশ্বাস করতো পৃথিবীতে এলিস কাইটেলারের চেয়ে শক্তিশালী যাদুকর নেই।

Image credit : Google

১৩২৪ সালের ৩ নভেম্বর এলিস কাইটেলারের দাসী ও সহযোগী পেট্রোনিলা ডি মিথকে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। বিচারের রায়ে এলিস কাইটেলার কে ও মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, কিন্তু ততোদিনে তিনি আয়ারল্যান্ড থেকে অনেক দূরে ইংল্যান্ডের কোথায় তিনি অবস্থান করছেন তা কেউ জানে না।

তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি.কম, উইকিপিডিয়া, ব্রিটনিকা এনসাক্লোপিডিয়া

Leave a Reply