উমোজা আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার সাম্বুরু কাউন্টির একটি গ্রাম। রাজধানী নাইরোরি থেকে ৬ ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত এই গ্রাম। আফ্রিকার অন্যান্য ৮/১০ টি উপজাতিদের গ্রামের মতোই উমোজা গ্রামের পরিবেশ; গ্রামের আশেপাশে আছে তৃণভূমি, আর বসতবাড়িগুলো কুঁড়েঘরের আর গ্রামটি পরিচালিত হয় স্থানীয় সমপ্রদায়ের নিয়মানুযায়ী। তবে অন্যান্য আফ্রিকান গ্রাম গুলোর থেকে উমোজা গ্রামের ব্যতিক্রম দিক হচ্ছে ‘এই গ্রামে পুরুষ নিষিদ্ধ!’। এখানো কোনো পুরুষ বাস করতে পারে না। তবে এর মানে এই না যে সেখানে কোনো পুরুষই প্রবেশ করার অনুমতি নেই!
সোয়াহিলি ভাষায় উমোজা শব্দের অর্থ ঐক্য বা একতা। কাজেও ঠিক তাই এই গ্রামের সকল মানুষ এক হয়ে বসবাস করে। পুরো কেনিয়া জুড়ে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এই গ্রামের নাম শুনেন নি বা তাদের সম্পর্কে জানেন না।
এই গ্রামের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯০ সালে। রেবেকা লোলোসলি নামের এক নারী একদল পুরুষের হাতে ধর্ষন ও শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভর্তি ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও রেবেকা সেই অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন নি।
এই ঘটনার পর তার পরিবার ও সমাজ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আর তাই রেবেকা লোলোসলি সিদ্ধান্ত নেন এমন এক গ্রামের সৃষ্টি করবেন যেখানে শুধু সমাজে অবহেলিত ও নির্যাতিত নারী ও তাদের শিশু সন্তানেরা নিরাপদে বাস করবে।
শুরু দিকে রেবেকা লোলোসলি মাত্র ১৫ জন অসহায় নির্যাতিত নারীকে নিয়ে তার এই গ্রামের যাত্রা শুরু করেন। গ্রাম প্রতিষ্ঠা করার পর স্থানীয় অনেক পুরুষ নেতাই রেবেকা কে অনেক হুমকি ধমকি দিয়েছিলো কিন্তু তিনি তাদের ভয়ে পিছুপা হন নি। তার প্রতিষ্ঠিত এই গ্রামে ৫০ জন নারী ও ২০০ এর অধিক শিশু বাস করে।
এখানে আসা সকল নারীরাই সমাজ ও পরিবারের মানুষের অত্যাচারের শিকার হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউবা ধর্ষণের শিকার হয়ে সমাজ ও পরিবারের তিরস্কার পেয়ে উঠেছেন এখানে। সেই সঙ্গে তাদের সাথে থাকা শিশু সন্তানেরা। এই গ্রামের সকলেই নতুন আসা সদস্যকে ভালোবাসার সাথে নিজেদের আপন করে নেয়।
উমোজা গ্রামের নারীদের এমন অসাধারণ বৈচিত্র্যময় জীবন দেখতে অনেক পর্যটকই ঘুরতে আসেন এই গ্রামে। আর সেইসব পর্যটকদের উমোজার নারীরা ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের মাধ্যমে তাদের বরণ করেন।
যে কোনো পর্যটকই উমোজা নারীদের শরীরের রঙিন ঝলমলে পোশাক ও গয়নায় মুগ্ধ হয়ে যায় প্রথম দেখাতেই। পর্যটকেরা সেইসব পোশাক আর গয়নায় আকৃষ্ট হয়ে সেসব কিনে নিয়ে যায়। এইসব পোশাক আর গয়না বেঁচেই চলে উমোজা গ্রামের অর্থনিতী।
উমোজা গ্রাম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠেছে, তবে কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নয়। নারীর ভেতরকার সাহস যে কতকিছু করতে পারে। আর কিভাবে এমন একটি বিচিত্র সম্প্রদায় ঘরে তুলতে পারে এটিই উমোজা গ্রামের প্রধান দর্শনীয় বৈশিষ্ট্য।
উমোজা গ্রামেরা নারীরা এখনো কাপড় আর গহনা তৈরি করে নিজেদের অর্থের যোগান দিচ্ছেন। তাদের হাতের তৈরি অসাধারণ রঙ ঢঙে তৈরি হওয়া সব গয়না শুধু আফ্রিকার ঐতিহ্যকেই তুলে ধরছে না, সেইসব গয়নার সাথে জড়িয়ে আছে একদল নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প।
উমোজা গ্রামের শিশুদের শিক্ষার জন্য রয়েছে স্কুলের ব্যবস্থা। প্রচলিত স্কুল ব্যবস্থা থেকে উমোজা গ্রামের স্কুলের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানের স্কুলে শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয় সহিংস হওয়া যাবে না। যাতে ভবিষ্যতে সেইসব শিশুরা নারীদের উপর নির্যাতন না করে।
উমোজা গ্রামে পুরুষের বসবাস নিষিদ্ধ হলেও গ্রাম থেকে ১ কিলোমিটার দূরে পর্যটকদের জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এসে এই গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
উমোজা গ্রামটি ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এই গ্রামটি বিশ্বব্যাপি পরিচিত পেতে শুরু করে ২০০৪/২০০৫ সালের দিকে। বিশেষত সেসব নারীদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও গ্রামের বৈচিত্র্যময়তার জন্য। আর এর পর থেকেই সারা বিশ্ব থেকে বহু পর্যটক ছুটে আসতে থাকেন উমেজা গ্রাম ও সেই গ্রামের মানুষের জীবনযাপন দেখার জন্য।
Featured Image Credit: The Guardian