পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত বিপ্লবের একটি ফরাসি বিপ্লব। যে বিপ্লবের মূলনীতি ছিলো স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজা ছিলেন রাজা ষোড়শ লুই, তার শসানামলে এই তিনটি জিনিসই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। সাধারণ মানুষজন অভিজাতদের দ্বারা ভয়ানক নিপিড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলো। পুরো দেশের ৯৫ শতাংশ সম্পদের মালিক ছিলো মাত্র ৫ শতাংশ অভিজাত মানুষরা। আর বাকি ৯৫ শতাংশ শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষেরা অভিজাতদের তাদের হাতে সর্বদা নিপিড়ীত ও অত্যাচারিত হয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতেন।
কেনো দেশের মানুষ যখন আর ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না তখনই সেই দেশে বিপ্লব অভিসম্ভাপ্য হয়ে উঠে। ফলাফলস্বরূপ ফ্রান্সেও তখন বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। যে বিপ্লবের মূলনীতি ছিলো স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। যে বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলো কৃষক, শ্রমিক ও অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটানো ফ্রান্সের নিপীড়িত সাধারণ মানুষজন। বিপ্লবী জনতা ফ্রান্সের বাস্তিল দূর্গ ভেঙে ফেলে, মুক্তি পায় নিরপরাধ সাধারণ মানুষজন, যারা রাজার শাসনের অন্যায়ের সমালোচনা করে বন্দী হয়েছেন। এরপর একে একে শাস্তি দেওয়া হয় সকল অভিজাতদের। গিলেটিন নামক এক ভয়াবহ যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের মস্তক কর্তন করে মৃত্যু দেওয়া হতে থাকে।
ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স ফ্রান্সের এই ঐতিহাসিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে রচনা করেছে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ A tale of two cities’, ডিকেন্স উপন্যাসে বিপ্লব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়কার ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সমসাময়িক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেছেন।
চার্লস ডিকেন্স তার এই উপন্যাস শুরু করেছেন অসাধারণ এক দার্শনিক উক্তির মাধ্যমে। তিনি সময়টাকে ব্যাক্ত করেছেন এভাবে,
“It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of Light, it was the season of Darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair…”
সময়টা ১৭৭৫ সাল, ফ্রান্সের শাসক ছিলেন রাজা ষোড়শ লুই আর ইংল্যান্ডের শাসক রাজা তৃতীয় জর্জ। পুরো ইউরোপে তখন বিশৃঙ্খল অবস্থার বিরাজ করছে। ফ্রান্সের রাজতন্ত্র তখন অবক্ষয় হতে শুরু করেছে। ফ্রান্সের মতো একই চিত্র ইংল্যান্ডেও বিরাজমান। জার্ভিস লরি নামের এক ব্যাংকার ডোভারে ভ্রমণ করেন লুসি ম্যানেট নামক এক তরুণীর সাথে সাক্ষাৎ করতে। তিনি টেলসন ব্যাংকের ফ্রান্সের প্যারিস শাখা থেকে একটি গোপন বার্তা পান। যে বার্তায় বলা হয় ড. আলেকজান্ডার ম্যানেট বেঁচে আছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি লুসিকে জানাতে লরি লুসির সাথে দেখা করেন। লুসি জানতো সে একজন অনাথ, ছোটবেলাতেই তার বাবা-মা উভয়েই মারা গেছে। আর তাকে লালন পালন করতো তার নার্স ও অভিভাবক মিসেস প্রস।
মি. লরি লুসি ও মিসেস প্রসকে সাথে নিয়ে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন লুসির বাবার সাথে তার স্বাক্ষাৎ করাতে। লুসির বাবা ড. আলেকজান্ডার ম্যানেট দীর্ঘ ১৮ বছর ফ্রান্সের বাস্তিল দুর্গে বন্দী ছিলেন। ড. ম্যানেট এখন ফ্রান্সের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল সেইন্ট আন্তোয়ানে মঁসিয়ে ডেফার্জ এবং তার স্ত্রী থেরেসা ডেফার্জের কাছে আছেন। মঁসিয়ে ডেফার্জ একসময় ডক্টর ম্যানেটের চাকর ছিলেন, এখন তিনি ফরাসি বিপ্লবের প্রথম সারির নেতা। ডক্টর ম্যানেট কারাগার থেকে মুক্তি পেলে ডেফার্জ দম্পতি তাকে তাদের ওয়াইন শপের একটি ঘরে আশ্রয় দেয়।
লুসি তার নার্স ও অভিভাবক মিসেস প্রস ও ব্যাংকার মি. লরির সাথে করে মঁসিয়ে ডেফার্জের ওয়াইন শপের সামনে আসলে একটি ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাটি খুবই গভীরভাবে উপলব্ধি করবার বিষয়। ডক্টর ম্যানেটের সঙ্গে দেখা করার জন্য তারা এসে দেখতে পায়, মঁসিয়ে ডেফার্জের ওয়াইন শপের সামনে একটি মদের পিপে ফেটে গেছে। পিপেটি ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের দরিদ্র মানুষজন মদের জন্য ছুটে আসে। অনেকে রাস্তার ওপর পড়ে থাকা মদ মাটিতে হাঁটু গেড়ে হাতে কিংবা কাপড়ে মদ সংগ্রহ করতে থাকে। কেউ কেউ সেখানকার পরে যাওয়া মদ মাটি থেকেই চেটেচেটে খেতে শুরু করে দেয়। এই দৃশ্যের মাধ্যমে ডিকেন্স বিপ্লবের পূর্বাভাস দিয়েছেন। এখন ওরা মাটিতে পড়ে যাওয়া মদ চেটে খাচ্ছে, ভবিষ্যতে ওরা অভিজাতদের রক্ত চেটে খাবে।
লুসি তার বাবাকে দেখতে পায় একটি বদ্ধ ঘরে বসে জুতা সেলাই করছে। এটি তিনি কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শিখেছেন। এই কাজটি তাকে বন্দী থাকা অবস্থায় লড়াই করার জন্য মানসিক শক্তি যোগাতো। দীর্ঘ ১৮ বছর বন্দী থেকে ডক্টর ম্যানেট সবকিছুই ভুলে গেছেন এমনকি নিজের নামটুকুও তার মনে নেই। তিনি শুধু একটি সংখ্যার ব্যবহার করতেন, “One Hundred and Five, North Tower”, যা ছিলো বাস্তিল কারাগারে তার কক্ষের নাম।
লুসি তার বাবার কাছে এগিয়ে আসলে ডক্টর ম্যানেট লুসিকে চিনতে পারেন না। লুসি তার বাবাকে পরিচয় দেয় এবং বলে সে তার মেয়ে। ডক্টর ম্যানেট লুসির সোনালী চুল, মুখ ও কন্ঠস্বরের সাথে তার স্ত্রীর মিল পেয়ে লুসিকে চিনতে পারেন। তার স্মৃতি শক্তি ফিরে আসে। তিনি কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। তিনি বুঝতে পারেন তিনি এখন বন্দীদশা হতে মুক্ত। এরপর লুসি তার বাবাকে নিয়ে লন্ডনে ফিরে আসেন। ডক্টর ম্যানেন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। তিনি আবারো চিকিৎসা পেশায় নিজিের কাজ শুরু করেন। আর এভাবেই কেটে যায় আরো ৫ টি বছর।
সাল ১৭৮০, চার্লস ডারনে নামক এক ফরাসি যুবককে বিচার করার জন্য ইংল্যান্ডের আদালতে তুলা হয়। ইনিই হলেন এই উপন্যাসের নায়ক। তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ ছিলো। তিনি ফ্রান্সের রাজার কাছে ইংল্যান্ডের সামরিক কার্যক্রম, বিশেষ করে আমেরিকার বিপ্লবী যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথ্য পাচার করেছেন। আমেরিকার স্বাধীনতা চলাকালীন সময়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক উত্তেজনা ছিলো একেবারে তুঙ্গে।
আদালতে চার্লসের উকিল ছিলেন মিঃ স্ট্রাইভার। মিঃ স্ট্রাইভারের একজন সহকারী ছিলেন তার নাম ছিলো সিডনি কার্টন। এই সিডনি কার্টন মদ্যপ ও খামখেয়ালি ধরনের মানুষ কিন্তু খুবই বুদ্ধিমান। তিনি এক অসাধারণ যুক্তির মাধ্যমে চার্লসের বিরুদ্ধে আনা মামলাকে দূর্বল করে দেন। সিডনি যুক্তি দেন চার্লসের চেহারা ও শারিরীক গঠনের সাথে তারও মিল রয়েছে। এই কথা শুনে আদালতের বিচারকরদের মনেও সন্দেহ শুরু হয়। সিডনি কার্টন বিচারকদের বুঝাতে সক্ষম হন যে চার্লসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সে ঐ অভিযুক্ত ব্যক্তি নাও হতে পারেন। আর তাই সন্দেহের বসে একজন মানুষকে শাস্তি দেওয়া যায় না। বিচারকরা চার্লসকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে মুক্তি দেয়।
এই আদালতের বিচারকার্যের সময় লুসি ও তার বাবা দুজনেই বিচারকার্য ও পুরো ঘটনা দেখছিলেন। বিচারের পর লুসি চার্লসের সাথে দেখা করেন। পূর্বেও তাদের দুজনের জাহাজে ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড আসার সময় দেখা হয়েছিলো। লুসি চার্লস ডার্নের প্রতি তার বিনয়ের কারণে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আর এদিকে চার্লস ডারনেও লুসির কোমলতা ও স্নেহময় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন। ডার্নে ধীরে ধীরে লুসির প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করেন। ওদিকে সিডনি কার্টন ও লুসিকে ভালোবেসে ফেলেন। কার্টন ছিলেন একজন এতিম তিনি অনাথ। জীবনে তিনি অনেক ভুল করেছেন, সেসকল ভুল নিয়ে তিনি আফসোস করেন। লুসি সেসব কথা শুনে সিডনি কার্টন কে স্বান্তনা দেন। লুসি বুঝতে পারেন সিডনি তাকে ভালোবাসে কিন্তু লুসি ততোদিনে মন দিয়ে দিয়েছে চার্লসকে। এই পুরো ব্যাপারটাকে সিডনি বেশ ভালো মনেই গ্রহণ করেন।
আর তাইতে সিডনি কার্টন লুসিকে বলেন,
“I would embrace any sacrifice for you and for those dear to you.”
বেশ কয়েক বছর সুন্দরভাবে কেটে যায়। চার্লস ডারনে লুসি ম্যানেটের বাবা ডক্টর ম্যানেটের সাথে তার লুসিকে ভালো লাগা ও উভয়ের ভালোবাসার কথা বলেন। ডক্টর ম্যানেট তাদের বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেয়, তার কাছে কন্যা লুসির সুখে থাকাই ছিলো তার একমাত্র চাওয়া। আর তাই তিনি চার্লস ডার্নের পরিবার ও ব্যক্তিগত কোনো তথ্যই তিনি জানতে চাননি। চার্লস ডারনে এতোদিন তার পরিবার সম্পর্কে কোনো তথ্য জানায়নি। সে তাদের কাউকেই জানায় নি সে একজন ফরাসি অভিজাত ও নিষ্ঠুর এভরেমন্ড পরিবারের সন্তান। বিয়ের আগে চার্লসের মনে হলো তার নৈতিক দায়িত্ব বিয়ের আগে তার পরিবার সম্পর্কে জানানো। আর তাই চার্লস ডক্টর ম্যানেটকে জানায় সে ফরাসি অভিজাত ও নিষ্ঠুর এভরেমন্ড পরিবারের ছেলে। একথা শুনে ডক্টর ম্যানেটে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, কারন চার্লসের বাবা ও চাচা শত্রুতা করেই তাকে দীর্ঘ ১৮ বছর বাস্তিল দুর্গে আটকে রেখেছিলো। কিন্তু ডক্টর ম্যানেট নিজের মেয়ের সুখের কথা ভেবে এই বিয়ের কার্য পুরোপুরি সম্পন্ন করেন।
চার্লসের বাবা ও চাচা ছিলেন ভয়ানক নিষ্ঠুর মানুষ। তারা গ্রামের কৃষকদের থেকে অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের জন্য অমানবিক অত্যাচার চালাতো।চার্লস তার বাবা চাচাদের পথ অনুসরণ করতে চায়নি। সে অভিজাতদের তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য ঘৃণা করতো। আর তাই সে ফ্রান্স ছেড়ে চলে আসে ইংল্যান্ডে। নিজের অভিজাত পরিবারের এভরেমন্ড পদবি ছুঁড়ে ফেলে নামের শেষে যোগ করে ডারনে নাম। ইংল্যান্ডে এসে চার্লস পেশা হিসবে গ্রহণ করে শিক্ষকতা। চার্লসের পরিবার কতোটা অমানবিক ও নিষ্ঠুর ছিলো তা বুঝাতে উপন্যাসের একটি ঘটনার কথা বলতেই হয়। চার্লসের চাচা মার্কুইস এভরেমন্ড রাজা ষোড়শ লুইের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাজা ষোড়শ লুইয়ের সাক্ষাৎ না পেয়ে তিনি রেগে ঘোড়ার গাড়িতে করে ফিরে চলে আসেন। আসার পথে তার গাড়ির চাকার নিচে পড়ে একটি ছোট্ট শিশু মারা যায়। ছোট্ট শিশুর মৃত্যু মার্কুইসের হৃদয়কে স্পর্শ করে না। বরং তিনি উপহাস করে শিশুটিট বাবাকে বলেন, It’s nothing, এরপর একটি স্বর্ণের মুদ্রা শিশুটির বাবার দিকে ছুঁড়ে দেন।
এবার মূল ঘটনায় ফিরে আসা যাক। বিয়ের পর চার্লস ও লুসির সময় খুব সুখেই কেটে যেতে থাকে। তবে লুসির তার এই বৈবাহিক জীবন নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। যেহেতু চার্লসের পরিবার একটি ফরাসি অভিজাত এবং তারা খুবই নিষ্ঠুর। আর যেহেতু ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নয়, ভবিষ্যতে এই খারাপ প্রভাব হয়তো চার্লসের উপরেও পড়তে পারে।
সময়টা ১৮৮৯, চার্লস ও লুসির বিয়ের বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। ফ্রান্সের রাজা তখন ষোড়শ লুই। ফ্রান্সের গরীব কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষেরা রাজতন্ত্র ও ফরাসি অভিজাতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন, শুরু হয় ফরাসি বিপ্লবের। বিপ্লবীদের হাতে ফ্রান্সের কুখ্যাত সেই বাস্তিল দুর্গের পতন হয়। সেখানের সব বন্দী মানুষের মুক্তি দেওয়া হয়। যাদেরকে রাজা ও ক্ষমতাশালীদের অন্যায় ও শোষণের সমালোচনা করায় বিনা অপরাধে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বিপ্লবীরা একে একে অভিজাত ও শোষণকারীদের ধরে ধরে গিলেটিন নামক এক ভয়ানক যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের মুন্ডুপাত করতে থাকেন।
সেই বিপ্লবের মাধ্যমে চার্লস ডারনের চাচা মার্কুইস এভরেমন্ডের নির্মম মৃত্যু হয়েছিলো। যে শিশুটিকে মার্কুইস গাড়ি চাপা দিয়ে মেরেছিলো। সেই শিশুটির বাবা গ্যাসপার্ড তার স্ত্রী ও অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রামবাসীদের সাথে মার্কিসের প্রাসাদে পৌঁছায় এবং সেখানেই নিজের শিশু হত্যার প্রতিশোধ হিসবে গ্যাসপার্ডি মার্কুইস কি নির্মমভাবে হত্যা করে।
ফরাসি বিপ্লব চলাকালীন সময়ে চার্লস ফ্রান্স থেকে একটি চিঠি পায়। চিঠিটি লিখেছে তাদের পরিবারের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণকারী গ্যাবেল। সে জানায় তাকে বিপ্লবীরা প্রায় ৩ বছর ধরে বন্দী করে রেখেছে। চার্লস যেনো এসে তাকে অভিসম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। চার্লসের এই মুহূর্তে ফ্রান্সে যাওয়া ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেই ভয়নবক ঝুঁকিটাই তিনি নিলেন। ফ্রান্সে গিয়ে তিনি একজন ইমিগ্রেন্ট ও অভিজাত ফরাসি হিসেবে বিপ্লবীদের হাতে বন্দী হয়ে যান।
চার্লস ডার্নের গ্রেফতারের খবর শুনে লুসি ও তার বাবা ডক্টর আলেকজান্ডার ম্যানেট ফ্রান্সে চলে আসেন। সেখানে তারা বিভিন্ন বিপ্লবীদের সাহায্য নিয়ে চার্সের মুক্তির চেষ্টা করেন। কারণ ডক্টর ম্যানেট নিজেও একজন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী থাকা মানুষ। তাদের কাছে তিনি ছিলেন সম্মানিত। প্রায় ১ বছর ৩ মাস কারাগারে থাকার পর চার্লসের বিচার শুরু হয়। বিপ্লবীদের সহায়তায়ন ও সিডনি কার্টনের কৌশলের মাধ্যমে তারা চার্লসকে মুক্ত করতে সক্ষম হন।
যেদিন চার্লস খালাস পান সেদিন রাত্রেই তাকে আবারো গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মঁসিয়ে ডেফার্জে ও তার স্ত্রী মাদাম ডেফার্জে একটি চিঠি জমা দেন। চিঠিটি ডক্টর ম্যানেট বাস্তিল দুর্গে বন্দী থাকা অবস্থায় লিখেছিলেন। আর সেটি মঁসিয়ে ডেফার্জে ডক্টর ম্যানেটের সেই বন্দী হওয়া কক্ষে খুঁজে পান। সেই চিঠিতে লেখা ছিলো, চার্লসের বাবা ও চাচার নিষ্ঠুরতার কথা। চার্লসের চাচা মার্কুইস এভমেরন্ড তার গ্রামের একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে। মেয়েটির ভাই এই অন্যায় প্রতিবাদ জানালে মার্কুইস তার দলের লোকেরা পিটিয়ে ও ছুড়ি দিয়ে আঘাত করলে ভাইটির মৃত্যু হয়। ধর্ষিতা মেয়েটির শারিরীক অবস্থাও গুরুতর হয়ে পড়ে। তাই মেয়েটির চিকিৎসা করতে চার্লসের বাবা ও চাচা ডক্টর ম্যানেটকে খবর দিয়ে আনেন। অনেক চেষ্টা করেও ডক্টর ম্যানেট তাকে বাঁচাতে পারে না। এই ঘটনা ডক্টর ম্যানেট সহজে মেনে নিতে পারেনি। তিনি ফ্রান্সের উর্ধতন কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে চিঠি লিখলে সেই চিঠির খবর চার্লসের বাবা ও চাচা জেনে যায়। তারা পরিকল্পনা করে ডক্টর ম্যানেটকে বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে ফেলেন। আর এই ধর্ষিতা মেয়েটির বোন হলো আমাদের মঁসিয়ে ডেফার্জের স্ত্রী মাদাম ডেফার্জে। তার বোনের মৃত্যুর পর এই ঘটনা সহ্য না করতে পেরে তার বাবা-মা দুজনেই মারা যায়। পুরো পরিবারটি একেবারে শেষ হয়ে যায়। মাদাম ডেফার্জে এই ঘটনার পর অভিজাতদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেন। তিনি লিস্ট করে রাখতেন কাদের কাদের শাস্তি দিতে হবে।
চার্লস আবার গ্রেফতার হলে, তার পরিবারের অপকর্মের জন্য তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। সিডনি কার্টন আবারো এখানে ত্রাণকর্তা হয়ে উঠেন। সিডনি লুসিকে খুব ভালোবাসতেন, তিনি চানটি লুসি তার বাকি জীবন কষ্টে কাটাক। আর এজন্য চার্লসের মুক্তির জন্য তার নিজের আত্মত্যাগ করতে হবে। চার্লস ডারনে ও সিডনি কার্টনের চেহারা প্রায় একইরকম। সেই সুযোগের ব্যবহারই তিনি করেছেন। চার্লসের জায়গায় নিজে মৃত্যুদন্ড গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
এই কাজের জন্য সিডনি জন বার্সাদ কে ব্ল্যাক মেইল করেন। কারন তিনি পূর্বে অনেক অপকর্ম করেছেন এবং সে বর্তমানে বিপ্লবীদের সাথে থাকলে তিনি আসলে গুপ্তচর। সে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স দুদেশেই তথ্য পাচার করে। তার আরেকটি পরিচয় হলো সে লুসির অভিভাবক ও নার্স মিস প্রসের হারিয়ে যাওয়া ভাই। সিডনি কার্টন জন বার্সাদ কে সাথে নিয়ে কারাগারের প্রহরীদের কিছু ঘুস দিয়ে চার্লসের কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি চার্লসকে অজ্ঞান করে নিজের পোশাক চার্লসকে ও চার্লসের পোশাক নিজে পড়ে নেন। এরপর অজ্ঞান হওয়া চার্লসের দেহ নিয়ে জন বার্সাদ কারাগার থেকে চলে যায়। যেহেতু সিডনি ও চার্লসের চেহারা প্রায় একইরকম প্রহরীরা তা বুঝতেই পারে নি।
চার্লস ডারনে, লুসি, ডক্টর ম্যানেট ও লুসির সন্তানকে ফ্রান্স থেকে বিপ্লবীদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন টেলসন ব্যাংকের কর্মকর্তা ও ডক্টর ম্যানেটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জার্ভিস লরি। তিনি তাদের প্যারিস থেকে লন্ডনে নিরাপদে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেন। ওদিকে চার্লসের মৃত্যু কার্যকর হবে সেই খুশিতে মাদাম ডেফার্জে দেখা করতে যান লুসির সাথে। লুসি কতোটা কষ্টে আছে তা নিজ চোখে দেখার জন্য। তার উদ্দেশ্য ছিলো লুসির সন্তানকেও হত্যা করা, কারন সেই শিশুর গায়েও অত্যাচারি এভমেরন্ড পরিবারের রক্ত বইছে। সেখানে গিয়ে দেখেন লুসি ও তার পরিবারের কেউ নেই। শুধু একমাত্র মিসেস প্রস আছেন। তার কাছে লুসির খবর জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে অস্বীকার করেন। তখন মাদাম ডেফার্জে প্রসের দিকে পিস্তল তাক করেন। তখন তাদের দু’জনের মধ্যকার ধস্তাধস্তিতে নিজের পিস্তলের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।
ওদিকে সিডনি কার্টনকে ফাঁসির কাষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় তিনি ছিলেন খুবই স্বাভাবিক। তিনি মনে করেন তার এই মৃত্যুর উদ্দেশ্য মহৎ তার এই মৃত্যুর মাধ্যমে লুসি,চার্লস ও ডক্টর ম্যানেট ও লুসির সন্তানেরা সুখে থাকবে। সেই সন্তানের নাম রাখা হয় সিডনিরই নামে ‘সিডনি ডারনে’ এছাড়াও তিনি আরো একটি দৃশ্য কল্পনা করতে থাকেন, যে এই বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন এক ফ্রান্সের জন্ম হচ্ছে ।
মৃত্যুর সময় সিডনি কার্টনের বিখ্যাত উক্তিটি ছিলো,
“It is a far, far better thing that I do, than I have ever done; it is a far, far better rest that I go to than I have ever known.”
বলা হয়ে থাকে চার্লস ডিকেন্স তার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা ও এই উপন্যাসে সংযুক্ত করেছেন। তখনকার ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষদের জীবনও অভিজাত ও পুঁজিবাদীদের কারনে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। যে কোনো সময় ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষেরাও ফ্রান্সের সাধারণ মানুষদের মতো ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারেন! এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি এমনই ধরনের কোনো বার্তা হয়তো ইংল্যান্ডের ধনী ও অভিজাতদের দিতে চেয়েছেন।