নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের বিখ্যাত নাটক এ ডল’স হাউস। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৭৯ সালে। এই নাটকের মাধ্যমে হেনরিক ইবসেন সে সময়কার সমাজে নারীর অবস্থান, নারীর স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। কারণ ১৯ শতকের ইউরোপীয় সমাজে তখন নারীদের প্রধানত গৃহিণী ও শিশুর মতো দুর্বল হিসেবে দেখা হতো। তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ কিংবা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল সীমিত। ইবসেন এই ধারণাকে এই নাটকের মাধ্যমে সমাজের মানুষের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন।
হেনরিক ইবসেন এই নাটকটি লরা কিলার নামের এক নারীর জীবনের সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেছিলেন। লরা ছিলেন হেনরিক ইবসেনের এক বন্ধু। লরা তার স্বামীর জন্য অর্থ ঋন করেছিলেন। কিন্তু যখন এই বিষয়টি প্রকাশ পায়, তখন তার স্বামী তাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনাটি তাকে এই নাটকের প্রধান চরিত্র নোরা হেলমার সৃষ্টি করতে ভূমিকা রেখেছে।

হেনরিক ইবসেনের এই নাটকটির পুরোটা অংশই দেখানো হয় নরওয়ের একটি শহরের অ্যপার্টমেন্টে। নাটকে নির্দিষ্ট করে কোনো শহরের নাম উল্লেখ করা না হলেও, মনে করা হয় সেটি নরওয়ের রাজধানী অসলো (তৎকালীন ক্রিস্টিয়ানিয়া) শহর।
নাটকের শুরু হয় ক্রিসমাসের আগেরদিন। নোরা হেলমার নামের এক নারী তার সুসজ্জিত বসার ঘরে প্রবেশ করে।আর এই ঘরটিই পুরো নাটকের একমাত্র দৃশ্যপট। নোরার হাতে ছিলল অনেকগুলো ফুল আর অনেকগুলো কেনাকাটার ব্যাগ। সে সময় নোরার স্বামী টরভাল্ড হেলমার শব্দ শুনে তার অধ্যায়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। হেলমার নোরাকে মজা করে ও স্নেহপূর্ণভাবে সম্ভাষণ জানায়, তবে তারপর তাকে ক্রিসমাস উপহারের জন্য এত টাকা খরচ করার জন্য ধমক দেয়। এই হেলমার দম্পতির কথোপকথনে প্রকাশ পায় যে হেলমার ও তার স্ত্রী নোরাকে বহু বছর ধরে অর্থ খরচের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়েছে। তবে সামনে তাদের এই অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কারণ হেলমার সম্প্রতি তার ব্যাংকে পদোন্নতি হয়ে ম্যানেজার থেকে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছে।
তাদের দুজনকার এই কথাবার্তার সময় তাদের গৃহপরিচারিকা হেলেন জানায় তাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. র্যাংক দেখা করতে এসেছেন। সেই সময়ই একজন অপরিচিত নারীও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। এই নারীর নাম ক্রিস্টিনা লিনডে, সে নোরার স্কুল জীবনের পুরনো বান্ধবী। বহুবছর ধরে তাদের দু’জনের দেখাসাক্ষাৎ নেই। নোরা প্রথম দেখাতে তার বান্ধবীকে চিনতেই পারেনি। নোরা তখন বলে যে সে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছে যে কয়েক বছর আগে লিনডের স্বামী মারা গেছে। কিন্তু ব্যস্ততাী কারনে সে লিনডেকে চিঠি পাঠাতে পারেনি, এজন্য সে দুঃখিত। মিসেস লিনডে তখন আরো বলে যে তার স্বামীর মৃত্যুর পর সে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আর তার কোনো সন্তানও নেই।
নোরা তখন লিনডের জীবন সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে সে বলে, তুমি তো জানো যে আমার বিয়েট আগে একটি ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু বাবার হঠাৎ মৃত্যু হলে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে আমাকে একজন বুড়ো পয়সাওয়ালা লোককে বিয়ে করতে হয়। নিজের অসুস্থ মা ও ছোট দুই ভাইকে বছরের পর বছর দেখভাল করতে হয়েছে। সম্প্রতি মা মারা গেছে আর ভাইয়েরা বড় হয়েছে। তারা এখন আর তার উপর নির্ভরশীল না। এখন তার কোনো চাপ না থাকলেও তার নিজেকে শূণ্য মনে হচ্ছে। কারণ তার কাছে কোনো কাজ নেই। লিনডে তখন নোরাকে বলে টারভাল্ড হেলমার যেনো তাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়।

নোরা তার বান্ধবীকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে সে তার স্বামীর সাথে কথা বলছে তার চাকরির ব্যপারে। সে সময় কথাপ্রসঙ্গে নোরা তার বান্ধবী লিনডেকে তার জীবনের একটি গোপন কথা বলে। সে লিনডে কে বলে যে নোরার বিয়ের এক বছরের মাথায় তার স্বামী টারভাল্ড হেলমার অসুস্থ হয়ে পরে। সে সময় ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলো যেনো তারা হাওয়া পরিবর্তন করে। নোরা তখন ২৫০ ডলার লোন নিয়ে টারভাল্ডকে নিয়ে ইতালির নেপলসে হাওয়া পরিবর্তন করতে গিয়েছিল। নোরা টারভাল্ডকে এই টাকার ব্যপারে বলেছিলো, সে এটি তার বাবার কাছ থেকে এনেছে। এতোদিন সে সংসারের টাকা বাঁচিয়ে অল্প অল্প করে ঋন পরিষোধ করেছে। আর খুব শীঘ্রই তার পুরো ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে।
সেসময় ক্রগস্টেড নামের এক লোক আসেন যিনি টারভাল্ড হেলমারের ব্যংকের একজন কর্মচারী। ক্রগস্টেড যখন টারভাল্ড হেলমারের স্টাডি রুমে দেখা করতে যায় নোরা তখন অস্বস্তি অনুভব করে। ডা. র্যাংক এর কিছুক্ষণ পরে টারভাল্ডের রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর ক্রগস্টেড সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন “That man’s morally diseased.”
ক্রগস্টেড চলে যাবার পর টারভাল্ড হেলমার এসে নোরা ও মিসেস লিনডে কে জানায় যে সে লিনডেকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে তার ব্যাংকে। কারণ জালিয়াতির কারনে সে ক্রগস্টেড কে শীঘ্রই ব্যাংক থেকে ছাঁটাই করবে। এরপর সেই কক্ষ থেকে টারভাল্ড লিনডে সকলে বিদায় নেয়।
নোরা তখন তার তিন সন্তান ইভার, বব ও এমির সাথে খেলাধুলা করছিলো, সেসময় হঠাৎ তাদের ঘরে ক্রগস্টেড ফিরে আসে। ক্রগস্টেড তখন নোরাকে জানায় তার স্বামী তাকে তার ব্যাংক থেকে খুব শীঘ্রই বরখাস্ত করতে যাচ্ছে কারন সে অতীতে দূর্নীতি করেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর সে কোনো অনৈতিক কাজের সাথে জরায় নি। সে নোরাকে বলে ক্রগস্টেড যেনো তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত না করে। আর যদি সে তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সে টারভাল্ড কে প্রকাশ করে দিবে যে নোরা তার বাবার জাল সই ব্যবহার করে টাকা লোন নিয়েছিলো। আর সেই জাল সইয়ে যে তারিখ দেওয়া হয়েছে সেটি নোরার বাবার মৃত্যুর পরের তারিখ। আর এসব কথা যদি পুলিশ পর্যন্ত যায় তাহলে নোরা ও তার স্বামীর সম্মানহানি হবে। তারা কেউই সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না।
ক্রগস্টেড চলে যাবার পর নোরা তার স্বামী টারভাল্ডকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাতে সে ক্রগস্টেড কে চাকরি থেকে বহিষ্কার না করে। কিন্তু টারভাল্ড নোরার কোনো কথাতেই রাজি হয়না। তিনি ক্রগস্টেডকে অনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে এবং বলেন এমন লোকের উপস্থিতিতেই সে শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করে।
পরের দিন অর্থাৎ ক্রিসমাসের দিন নোরা একা বসার ঘরে উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করতে থাকেন। সেসময় মিসেস লিনডে আসেন সে নোরার বল নাচের পোশাক সেলাই করতে সাহায্য করে। নোরা তখন তাকে বলে যে ডক্টর র্যাংক টিউবারকুলোসিসে অর্থাৎ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত, যা তিনি বংশগতভাবে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। মিসেস লিনডে তখন অনুমান করে যে নোরা হয়তো এই ডক্টর র্যাংক থেকে টাকা ঋণ নিয়েছেন। নোরাকে এ ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার করে।
টরভাল্ড বসবার ঘরে প্রবেশ করলে নোরা আবারো তাকে অনুরোধ করে যেনো যে ক্রগস্টেড কে বরখাস্ত না করে। সে এবারো নোরার অনুরোধ প্রত্যাখান করে করে। এবার সে বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই একটি রিজাইন লেটার তৈরি করে তাদের গৃহপরিচারিকা হেলেন কে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
এর পরের দৃশ্যে দেখা যায় ডক্টর র্যাংক আসেন এবং তিনি নোরাকে জানান যে তিনি নোরাকে তিনি ভালোবাসেন। আর শীঘ্রই তিনি মারা যাবেন তিনি চাচ্ছিলেন তার ভালাবাসার কথা প্রকাশ করতে। তিনি নোরাকে তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে: I have loved you as deeply as anyone else has.
নোরা প্রথমে ডাক্তার র্যাংকের এমন এই স্বীকারোক্তিতে বিস্মিত হন এবং কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করেন। তিনি ড. র্যাংককে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখতেন, কিন্তু তার প্রেমের কথা শুনে অস্বস্তিতে পড়েন। নোরা ভেবেছিল সে ড. র্যাংক থেকে কিছু অর্থ সহায়তা চাইবে কিন্তু এমন প্রস্তাবের পর নোরা আর কোনো সাহায্য চাইতে পারে না।
ড. র্যাংক চলে যাবার পর ক্রগস্টেড এসে নোরাকে জানায় যে টারভাল্ড তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। কিন্তু এখন সে শুধু চাকরিই ফেরত চায় না বরং আরো উচ্চ পদ পেতে চায়। আর যদি তা পেতে নোরা তাকে সাহায্য না করে তাহলে সব ঘটনা সে চিঠির মাধ্যমে টারভাল্ড হেলমারকে জানিয়ে দেবে।
টারভাল্ড চলে যাবার পর মিসেস লিনডে নোরাকে বলে যে সে ক্রগস্টেডের সাথে কথা বলবে। ইতোমধ্যে ক্রগস্টেড একটি চিঠি টারভাল্ড হেলমারের পোস্ট বক্সে রেখে চলে গেছে। যেখানে সে বিস্তারিত বর্ণনা করেছে নোরার জাল সই নিয়ে অর্থ লোন নেবার বিষয়ে। মিসেস লিনডে ক্রগস্টেডের সাথে দেখা করে। এই ক্রগস্টেড লিনডের সেই পুরনো প্রেমিক যাকে ছেড়ে সে একজন ধনী বুড়ো লোককে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলো। লিনডে তখন তাকে প্রস্তাব দেয় যে সে তাকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু তাকে তখন পরিবারের জন্য বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়েছিলো। এখন সে একজন বিধবা আর ক্রগস্টেড একজন বিপত্নীক আর তার অনেকগুলো সন্তানও রয়েছে। তারা এখন চাইলে একে অপরকে বিয়ে করে বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারে। ক্রগস্টেড তখন সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। সে তখন লিনডেকে বলে যে তার এখন সেই চিঠিটি ফেরত নিয়ে আসা উচিত। নয়তো এই চিঠির জন্য নোরার সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হবে। তখন লিনডে ক্রগস্টেড কে বাধা দিয়ে বলেন যে, সত্য প্রকাশ পেলে নোরা ও টরভাল্ডের সম্পর্ক আরও ভালো হবে।
টারভাল্ড এই চিঠি পড়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তিনি নোরাকে দোষারোপ করতে থাকেন। নোরাকে মিথ্যাবাদী, প্রতারক এবং অপরাধী হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি অনুভব করেন যে নোরার এই কাজ তার সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান নষ্ট করবে। টারভাল্ড নোরাকে আরো বলেন যে, “Now you have destroyed all my happiness. You have ruined all my future.” তিনি আরো ইঙ্গিত দেন যে তিনি নোরাকে আর আগের মতো ভালোবাসতে পারবেন না। তবে সমাজের দৃষ্টিতে তাদের দাম্পত্য টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে স্ত্রী হিসেবে রাখবেন।
এরপর ক্রগস্টেড থেকে টারভাল্ড হেলমারের কাছে আরো একটি চিঠি আসে। সেখানে সে জানায় সে নোরার সব অভিযোগ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর ঋণটি নোরা তার বাবার নামে নিয়েছিলো আর সেটি সে ইতোমধ্যে প্রায় শোধ ও করে ফেলেছে। এই চিঠি পড়ার পর টারভাল্ড হেলমার আনন্দিত হয়ে নোরাকে ক্ষমা করতে চায়।
কিন্তু নোরা তখন তার জীবন নিয়ে উপলব্ধি করে ফেলেছে। সে বুঝতে পেরেছে সে আসলে একটা পুতুলের সংসার করছে। আর তাই নোরা তার স্বামীকে বলেছিলো, I have been your doll-wife, just as at home I was Papa’s doll-child.
একসময় সে তার বাবার পুতুল ছিলো, তখন সে বাবার কথামতো চলতো। এখন সে তার স্বামীর কথামতো চলছে। তার নিজের কোনো স্বাধীনতা কখনোই ছিলো না। তার তিন সন্তানেরাও এখন তার পুতুল হিসেবেই বড় হচ্ছে।
নোরা টারভাল্ড হেলমারকে জানায় সে নিজেকে ও নিজের জীবনকে বুঝবার জন্য এই সংসার ছেড়ে চলে যাবে। এরপর নোরা দরজা খুলে বাইরে চলে যান, এবং নাটক শেষ হয় দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ দিয়ে।