পুরো রাজ্য থেকে বাছাই করা সদ্য জন্মানো কণ্যা শিশুদের নিয়মিত বিষ খাওয়ানোর আদেশ দিলেন এক রাজা। এক জন ছাড়া মারা গেল তাদের সকলেই। আর প্রতিদিন বিষপানে বেঁচে থাকা সেই একটি মেয়ে এক সময়ে হয়ে উঠল চোখ-ধাঁধানো সুন্দরী এক বিষকন্যা।
এক দিন দলবল-সহ যুদ্ধে বন্দি হয়ে, বিষকন্যাকে শত্রু শিবিরে বীণা বাজাতে পাঠালেন আক্রান্ত রাজা। সেই মেয়ের রূপ যেন এক আগল ভাঙা প্লাবন! মুগ্ধ শত্রু-রাজা তাকে ডাকলেন নিজস্ব আড়ালে। তার পরে যেই তাকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে রাখলেন অধৈর্য চুম্বন, মারা গেলেন নিজে।
গল্পটি ষোড়শ শতকের এক ফরাসি আখ্যানে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় যীশু খ্রিষ্টের জন্মের বহু আগে ভারতে বিষকন্যাদের সৃষ্টি, এরপর তা বহিঃবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত রাজারা তাদের শত্রুদের ঘায়েল করতে বিষকন্যাদের ব্যবহার করতেন।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় অৰ্থশাস্ত্র’ প্রণেতা চাণক্যও রাজাকে সাবধান করে বলেছিলেন,
“অচেনা রমণীদের ব্যবহারের আগে ধুয়ে নিতে হবে তাদের উরু। কারণ হতেই পারে, তারা বিষকন্যা!”
এলোমেলো ভাবে প্রাচীন ভারতের কিছু আখ্যানে ছড়িয়ে আছে বিষকন্যাদের কথা। তার অন্যতম হল, সোমদেব ভট্টের ‘কথাসরিৎসাগর’। শৈশব থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প বিষপানে পালিতা বিষকন্যাদের ব্যবহার করা হতো মূলত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার প্রয়োজনে। লালসার বশে বিষকন্যাদের দুর্নিবার আবেদনে সাড়া দিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা। কখনও নাচের দলে, কখনও বা উপহার হিসেবে, এই সব বিষকন্যাদের শত্রু শিবিরে ঢুকিয়ে দিত চতুর প্রতিপক্ষ. তার পরেই শুরু হয়ে যেত তাদের বিষের ছোবলে কাঙ্ক্ষিত হত্যার খবর আসার অধীর প্রতীক্ষা।
মহাবীর আলেক্সান্ডার ও বিষকন্যা
গ্রীক মহাবীর আলেক্সান্ডার পারস্যের রাজা দারায়ুস কে পরাজিত করে ভারত সীমান্তে হাজির হলেন। সীমান্তের রাজা আলেকজান্ডার কে অভ্যর্থনা জানালেন ৫ জন সুসজ্জিত তরুণীকে উপঢৌকন হিসেবে। তারা জানতো না তাদের ৫ জনের পঞ্চম কন্যাটি বিষকন্যা। তাদের সাথে আরো ছিল ঘোড়া বিভিন্ন উপহারের ঢালির সাথে পাঁচ সহচর।
পঞ্চম কন্যাটি ছিলো তাদের সকলের মধ্যে আনিন্দ্য সুন্দরী, তাই স্বাভাবিকভাবেই আলেকজান্ডারের নজর পড়লো সেই বিষকন্যার উপরে। তিনি লুব্ধ দৃষ্টিতে সেই নারীর দিকে এগিয়ে গেলেন। সেই আসলে তখন স্বয়ং আলেকজান্ডারের শিক্ষক এরিস্টটল উপস্থিত। এরিস্টটল বহুদর্শী প্রাজ্ঞ। তিনি আলেকজান্ডার কে আত্মসংবরণ করতে বললেন। আলেকজান্ডার তখন থমকে দাঁড়ালেন, এরিস্টটল তখন বললে এই রূপসী কন্যাটি আসলে ঘাতিনী, সে বিষকন্যা। আর সে কথা প্রমান করার জন্য এরিস্টটল দুজন দাসকে কাছে ডাকলেন। এবং তাদের আদেশ করলেন সেই রূপসী নারীকে চুম্বন করতে, আর সাথে সাথেই সেই দাসদের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
এরপর এরিস্টটল ঘোড়া, কুকুর ও অন্যান্য প্রাণীর উপরেও বিষকণ্যার পরীক্ষা করলেন। আর সাথে সাথে তাদেরও মৃত্যু হলো। সেই মুহূর্তে আলেকজান্ডার নিজের তলোয়ার তুলে সেই বিষকন্যা কে দু টুকরো করে ফেলেন, এবং তার আদেশে সেই বিষকন্যা কে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়।
এই ঘটনার কথা সেই সময় থেকে ভারত থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বে মানুষের মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য ও বিষকন্যা
চন্দ্রগুপ্ত সদ্যই চাণক্যের দূরদর্শী চিন্তা ও সহায়তায় মৌর্যসম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু সিংহাসনে বসেও সম্পূর্ণ নিরাপদ নন এই নবীন সম্রাট। চার পাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্তের আভাস পাচ্ছিলেন চাণক্য, যার মধ্যে বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। প্রজ্ঞা আর চতুর কৌশলে চন্দ্রগুপ্তকে আগলে রেখেছিলেন চাণক্য, আর তাঁর খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য বিষ মিশিয়ে দিতেন তিনি। তিনি জানতেন, বিষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ভাবেই এক দিন তৈরি হয়ে উঠবে চন্দ্রগুপ্তের শরীর।
কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী-র সঙ্গে যে দিন না জেনে নিজের বিষ-মেশানো খাবার ভাগ করে খেলেন চন্দ্রগুপ্ত, এলিয়ে পড়লেন তাঁর স্ত্রী দুর্ভারা। ছুটে এলেন আচার্য চাণক্য। তত ক্ষণে সব শেষ. শুধু দুর্ভারার পেট চিরে আচার্য বাঁচাতে পারলেন শিষ্যের পুত্রকে। মায়ের গর্ভেই এক বিন্দু বিষ তখন নীল এক টিকা এঁকে দিয়েছে সেই শিশুর কপালে। তাই তার নাম হলো বিন্দুসার।
আর এক বার ধননন্দের ক্ষমতালোভী, কুচক্রী মন্ত্রী রাক্ষস, চন্দ্রগুপ্তের কাছে পাঠাল এক বিষকন্যাকে। ধরে ফেলে, চন্দ্রগুপ্তের চৌহদ্দি থেকে বিষকন্যাকে চাণক্য পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধে, মিত্র অথচ আকাঙ্ক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বী পর্বতকের দরজায়। মারা গেলেন পর্বতক। বিষকন্যাই সরিয়ে দিল চন্দ্রগুপ্তের পথের কাঁটা! এই নিয়েই বিশাখদত্তের রাজনৈতিক নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’। সেখানে দেখা যায় এক বার বিষ ঢেলেই ফুরিয়ে যেত বিষকন্যাদের বিষ।
পিলপাই এর সুখ্যাত উপকথা
পারসিক উপকথায় একটি বিষপ্রয়োগের ঘটনা আছে। সুলতানের বেগম জানতেন সুলতানের অনেক বাসনার একটি- গ্রীবায় চুম্বন আর সেখানেই বিষ মাখিয়ে রাখলেন তিনি। ব্যাকুল সুলতানের মনে সন্দেহের বিন্দুমাত্র লেশ ছিলো না। তিনি আনন্দের সাথে লেহন করলেন নিজের মৃত্যুকে।
এই জাতীয় বিষ প্রয়োগ সেকালের অতি সাধারণ ঘটনা। কিন্তু সাধারণ বিষ প্রয়োগ করে মৃত্যুর সাথে বিষকন্যাদের অনেক প্রার্থক্য আছে। তারা আপন অঙ্গের বিষ সঞ্চারিত করে অন্যের অঙ্গে।
ইতিহাসে কি বিষপুরুষ ও ছিল?
বিষকন্যাদের নিয়ে যেসব উপকথা ও ইতিহাস প্রচলিত আছে সেসব বিশ্বাস করলে বিষপুরুষ ও যে ছিল তা ও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে।
বিষকন্যা দের উৎপত্তিস্থল ভারতেই ছিলো বিষপুরুষ। তদের মধ্যে একজন গুজরাতের সুলতান মাহমুদ শাহ। তিনি ঐতিহাসিক পুরুষ। খ্রীষ্টীয় ষোড়শ শতকের সূচনায় পশ্চিম – ভারতে সকলের মুখে মুখে তাঁর নাম। পশ্চিমী ভ্রমণকারীদের কলমেও তার উপাখ্যানের কথা শোনা যায়।
ভারথেমা লিখেছেন,মাহমুদের বাবা পুত্রকে ছোটবেলা থেকেই বিষ খাইয়ে মজবুত করে তুলেছিলেন। মতলব ছিল শত্রুরা যেন পুত্রের ওপর কখনও বিষ প্রয়োগ না করতে পারে। তার বিবরণ অনুযায়ী মাহমুদ নিয়মিতভাবে নানা ধরনের বিষ সেবন করতেন। তিনি পান চিবিয়ে যদি কারও গায়ে পিক ছিটোতেন তাহলে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল।
আরও একটি খবর দিয়েছেন পশ্চিমের এই পর্যটক গুজরাতের বিষপুরুষ সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন : সুলতানের অন্দরে তিন – চার হাজার নারী আছে। রাত্রে যে মেয়েটি সুলতানের শয্যাসঙ্গিনী হলো, পরদিন আর তাকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যেত না। বিষধর সুলতানের প্রেমালিঙ্গনে মৃত্যু অবধারিত।
তার বারবোসার ভ্রমণ – কাহিনীতেও আছেন গুজরাতের এই মাহমুদ। তিনি লিখেছেন তার সঙ্গে যে রমণীই রাত্রি যাপন করুক মৃত্যু। অনিবার্য। প্রিয় সহচরীরা সব রাত্রিশেষে শবে পরিণত !
মাহমুদ এই দৃশ্য সব সময় নিশ্চয় উপভোগ করতে পারতেন না । তার দেহ বিষপূর্ণ হলেও হৃদয়ে হয়তো বিষের ছোঁয়া তখনও লাগেনি। এজন্যেই তিনি নাকি এর একটা প্রতিকারও খুঁজে বের করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে থাকত একটি আংটি। নায়িকা সেটি মুখে পুরে সুলতানকে স্পর্শ করলে কোন ক্ষতি হতো না তার। মাহমুদকে আনন্দ দানের পরেও যে রূপসীরা বেঁচে ছিল তারা নাকি ওই আংটির মায়াবলেই।
ভারতের ইতিহাসে আরো একজন বিষপুরুষের নাম পাওয়া যায় তার নাম নাদির শাহ।
তার নিঃশ্বাসেও নাকি ছিল বিষ। দু’টি তরুণী সৌখিন নাদিরের দাঁত পরিষ্কার করছিল। সুলতানের তপ্ত নিঃশ্বাস স্পর্শে একজনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হলো। অন্যজন কোনমতে প্রাণে বেঁচেছিল। এ কাহিনী পশ্চিমীরা শুনেছেন বালুচি উপজাতিদের মুখে।
পরিশেষ
বিষকন্যারা ছিলো নিছক পেশাদার ঘাতিনী কিংবা মোহিনীবেশী গুপ্তচর মাত্র। তাদেরকে কেবল নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিল সেকালের ধুরন্ধর রাষ্ট্রবিদ, কূটনীতিক ও সমর-বিশারদরা।
আর ধরা পড়লে হয়তো তাদের কেটে ফেলা হতো টুকরো টুকরো করে, না হয় পুড়িয়ে মারা হত জ্যান্ত! মূলত রাজপুরুষদের শরীরি আকাঙ্ক্ষার সুযোগ নিয়েই গুপ্তহত্যার সফল কৌশল হিসেবে উঠে আসে বিষকন্যারা –এমনও মনে করার কারণ রয়েছে। অষ্টম শতকের পরে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে বিষকন্যাদের কাহিনী।