দ্য স্লেভ বাইবেল, বা ক্রীতদাস বাইবেল হচ্ছে খ্রীস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের আমেরিকান ক্রীতদাসদের জন্য তৈরিকৃত বাইবেল এর এক নতুন সংস্করণ। মূল বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট মিলিয়ে চ্যপ্টার ছিল ১১৮৯ টি, আর স্লেভ বাইবেল এ তার সংখ্যা মাত্র ২৩২ টি।
মূল বাইবেল এর একটি বৃহৎ অংশই বাদ দেওয়া হয়েছিল স্লেভ বাইবেল বা কৃতদাসের বাইবেলে। বিশেষ করে এমন সকল অধ্যায় বা কাহিনী বাদ দেওয়া হয়েছিল, যা কৃতদাসদের তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে। আর এই কাটছাঁট করা নতুন সংস্করণের এই বাইবেল দিয়েই দীর্ঘ ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে কৃতদাসদের ক্রীস্টধর্মে দীক্ষা দেওয়া হতো।
ওল্ড টেস্টামেন্টের ৫০ ভাগ, এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের ৯০ ভাগই এই ‘স্লেভ বাইবেল’ থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে স্বাধীনতা এবং মুক্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলো। বাদ গিয়েছিল বুক অব এক্সোডাসেরও অনেক অংশ।
~ ডেভিড এন্থোনি স্মিথ
আমেরিকায় কৃষ্ণরা
কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার করার পর। দলে দলে ইউরোপের শেতাঙ্গরা সেখানে গিয়ে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলে। নতুন নতুন উপনিবেশ তৈরির সময় তারা দেখল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের মাটি তুলোর চাষের পক্ষে খুব উৎকৃষ্ট।
এই তুলোর চাষের অঞ্চলে প্রয়োজন পড়লো অতি অল্প খরচে অধিক শ্রমদানকারী অসংখ্য মানুষের, যারা চিরদিনের মতো কেনা গোলাম হয়ে দৈহিক নিপীড়নের ভয়ে বিনা পারিশ্রমিকে আমৃত্যু শ্রমদান করবে। আর তাই এই ধরনের শ্রমিক শিকার করা হলো আফ্রিকার দুর্বল অসহায় কালো মানুষদের গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে, আর ওদের খাঁচায় পুরে শেকলে বেঁধে নিজেদের দেশ ও সমাজ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা হলো কামান আর বন্দুকের ভয় দেখিয়ে সমুদ্রের পরপারে আমেরিকায়।
আর হয়ে গেলো ওরা আজন্ম ক্রীতদাস। ওদের সন্তান-সন্তুতিদের নিয়ে, আর যারা ওদের শিকার করেছিলো সেসব ক্রীতদাস-ব্যবসায়ীরা ওদের বেচতে লাগলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের ওই সব শ্বেতাঙ্গ তুলো-চাষীদের কাছে। যে-সব শ্বেতাঙ্গ ওদের কিনতো, তারা ওদের মৃত্যু ঘটালেও আইনের চোখে অপরাধী হোতো না, কেননা ওরা আইনের বলে সর্বপ্রকার মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এক ধরনের পণ্যসামগ্রী।
সে সময়টায় যেহেতু খ্রীস্ট ধর্মের প্রচার চলছিলো তাই এই শ্বেতাঙ্গ মালিকরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ দাসদেরকেও খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নিলো। তৎকালীন সময়ের আমেরিকায় ‘সোসাইটি ফর দি কনভার্সন এন্ড রিলিজিয়াস ইন্সট্রাকশন অব নিগ্রো স্লেভস ইন দ্য ব্রিটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামে একটি ব্রিটিশ মিশনারী সংস্থা ছিল। আর তারাই এই সদ্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহন করা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য এই নতুন ধরনের বাইবেল তৈরি করেছিলেন।
যেসব অংশ বাদ দেওয়া হয়েছিলো
১. ঐশ্বরিক নেতৃত্বে স্বাধীনতা
“আর প্রভু বললেন, আমি অবশ্যই মিশরে থাকা আমার লোকদের দুর্দশা দেখেছি, এবং তাদের কার্যকর্তাদের কারণে তাদের কান্না শুনেছি; কারণ আমি তাদের দুঃখ জানি; এবং আমি তাদের মিশরীয়দের হাত থেকে উদ্ধার করতে নেমে এসেছি, এবং তাদের সেই দেশ থেকে বের করে একটি ভাল দেশে এবং একটি বিশাল দেশে, দুধ ও মধু প্রবাহিত দেশে নিয়ে যেতে…” (এক্সোডাস ৩:৭-৮)
এক্সোডাসের এই অংশটিতে মূলত মিশরে ইসরায়েলাইটদের অবরুদ্ধ দশা এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুত ভূমিতে তাদের মুক্তির কথা বলা আছে। ক্রীতদাস প্রথার শিকার হওয়া আফ্রিকানরা যে বাইবেলের এই অংশটির প্রতি আকৃষ্ট হতেন, তার ঐতিহাসিক কারণ ছিল। কারণ এই ইজরায়েলাইটদের সঙ্গে তারা নিজেদের অনেক মিল দেখতে পেতেন।
কারণ তারাও তো অন্য একটি দেশে বন্দী অবস্থায় ছিলেন। তারাও মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তারা ভাবতেন, আমরা যদি ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখি, আমরাও একদিন মুক্তি পাব। ঈশ্বর আমাদের মুক্তি দেবেন। কাজেই এই কাহিনী তাদের নিজেদের কাহিনির সঙ্গে খুবই মিলে যায়। দাস প্রথার শিকার এই আফ্রিকানদের মধ্য থেকে যে আধ্যাত্মিক নেতারা তৈরি হবেন, তাদের অনেকেই কিন্তু এ থেকে অনুপ্রেরণা নেবেন।
২. দ্য স্টোরি অব জোসেফ
এর পরের অনুপ্রেরণা গল্পটি জোসেফ এর (ইসলাম ধর্মে তাকে ডাকা হয় ইউসুফ নবী নামে)। জোসেফ এর এই গল্প জেনেসিস ৩৭ থেকে ৫০ পর্যন্ত। যেখানে রয়েছে পারিবারিক প্রতারণা, বিভিন্ন পরীক্ষা ও সবশেষে চূড়ান্ত বিজয়।
জোসেফ কে তার ভাইরা হিংসে করে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। সেই ক্রীতদাস থেকে জোসেফ একসময় হয়ে উঠেন মিশরের ফেরাউন এর পর দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
“এটা সত্যি য়ে তোমরা আমার প্রতি অনিষ্ট করার পরিকল্পনা করেছিলে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরই আমার জন্য ভাল কিছু পরিকল্পনা করছিলেন| ঈশ্বরের আমার মাধ্যমে অনেকের প্রাণ বাঁচানোর পরিকল্পনা ছিল|” (জেনেসিস ৫০:২০)
এই গল্পটি কৃতদাসদের মধ্যে আশার আলোর সঞ্চালন করতে পারে ভেবে কৃতদাস বাইবেলে এই গল্পের পুরোটাই বাদ দেওয়া হয়।
৩. হামুরাবির কোড
বাইবেল এর ওল্ড টেস্টামেন্টে হামুরাবির কোডেরও উল্লেখ আছে। হামুবারি কোড হচ্ছে প্রাচীন ব্যাবিলনের প্রাচীনতম আইন এর মধ্যে একটি। এই আইনের একটি অংশ বাইবেল এর মধ্যেও ছিল। এই আইন ধারা সেসময় সমাজে ন্যায়বিচার করা হতো ধনী, গরীর কিংবা দাস নির্বিশেষে।
“কোন ব্যাক্তি যখন অন্য আরেকজনের নামে কোন অভিযোগ করবে তখন অভিযুক্তকে নদীর পানিতে ঝাপিয়ে পরতে হবে, যদি অভিযুক্ত ব্যাক্তি ডুবে যায়, তাহলে প্রমানিত হবে যে সে আসলেই দোষী এবং তখন আভিযোগকারি আভিযুক্তের ঘর বাড়ি সব পেয়ে যাবে। আর যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি কোন ধরনের আঘাত ছাড়াই নদীর পানি থেকে সাতরে তীর চলে আসতে পারে তাহলে প্রমানীত হবে যে সে আসলে নির্দোষ। এক্ষেত্রে মিথ্যা অভিযোগ আনার কারণে অভিযোগকারীর মৃত্যুদণ্ড হবে।” (হাম্মুরাবির কোড, আইন 2)
আইনের এই অংশটি দাসদের নাগরিক অধিকার এবং ন্যায়বিচারের ধারণা দিতে পারে। এমনকি সম্ভাব্য ভিন্নমত এবং অস্থিরতার বীজ বপন করতে পারে। আর তাই এই অংশটিও ক্রীতদাস বাইবেল থেকে বাদ দেওয়া হয়।
৪. সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য ঈশ্বরের দূত বা নবীদের বিচার
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে, আমোস, ইশাইয়া এবং জেরেমিয়ার মতো নবীরা সামাজিক ন্যায়বিচারের অটল ছিলেন। তারা বারবার সামাজিক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
“কিন্তু ন্যায়বিচার জলের মতো গড়িয়ে পড়ুক, এবং ন্যায়পরায়ণতা অবিরাম প্রবাহিত স্রোতের মতো।” (আমোস 5:24)
আমোসের এই শক্তিশালী উদ্ধৃতি এবং অন্যান্য নবীদের অনুরূপ শিক্ষাগুলি বিদ্রোহের জন্য অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। আর তাই এই অংশগুলোকে বাদ দিয়ে ক্রীতদাসেরর বাইবেল সংকলকেরা ক্রীতদাসদের সামাজিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার কোনও চিন্তাভাবনাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
৫. ড্যানিয়েলের গল্প
ক্রীতদাসের বাইবেল থেকে আরো একটি শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণা গল্প বাদ দেওয়া হয়েছিল। সেটি প্রোফেট ড্যানিয়েল এর গল্প। প্রোফেট ড্যানিয়েল ছিলেন, ব্যাবিলনের রাজার দরবারে সেবারত একজন ইহুদি, ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস বজায় রাখতে রাজার প্রতি প্রার্থনা করার আদেশ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর সেই অপরাদে রাজা তাকে একটি সিংহের খাঁচায় নিক্ষেপ করেন, আর সেখান থেকে দানিয়েল সুস্থভাবে বেরিয়ে আসেন।
“আমার ঈশ্বর তাঁর দূতকে পাঠিয়েছেন, এবং তিনি সিংহদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা আমাকে আঘাত করেনি, কারণ আমি তার দৃষ্টিতে নির্দোষ পেয়েছি। আমি আপনার আগে কোন অন্যায় করিনি, মহারাজ।” (ড্যানিয়েল 6:22)
এই ঘটনাকে গুলো ক্রীতদাসদের মনে আশার আলো ও বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করতে পারে তাই এই গল্পগুলোও স্লেভ বাইবেল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
১৮ শতকের মাঝামাঝিতে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী খ্রিস্টান মিশনারী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মানুষেরা এই নতুন সংস্করণের বাইবেল কে নিপীড়ন এর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।