গেঁটেবাত কে যুগ যুগ ধরে ‘রাজাদের রোগ’ ভাবা হয়েছে। এই রোগটি বিশেষত তাদের হতো, যারা উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া শেষ করে ঘন ঘন পানীয় পান করতেন।
এই কাজগুলো ধনীরাই বেশি করতো বলে গেঁটেবাত রোগে কেবল ধনীব্যক্তিরাই সংক্রমিত হতো। রাজা অষ্টম হেনরি এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এই গেঁটেবাত রোগটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মধ্যযুগের ইউরোপে গেঁটেবাত একটি ঐতিহ্য ও সম্ভান্ত্র হয়ে উঠেছিল। অনেকেই চাইতো তার গেঁটেবাত হোক। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ফ্রান্সের ভার্সাই শহরের অনেক সাধারণ মানুষ এই রোগের ভং ধরেছিলেন, কারণ এটা ছিল রাজাদের রোগ। আর তাই সে ব্যাক্তিকে লোকজন অন্য দৃষ্টিতে দেখতো।
গেঁটেবাত কেনো হয়?
গেঁটেবাত বিভিন্ন কারণের কারণে হয়। সাধারণত মাত্র ১-২% লোক এই রোগে আক্রান্ত হয় তবে মহিলাদের তুলনায় পুরুষেরা ৫ গুণ বেশি আক্রান্ত হয়। এটি পুরুষ ও বৃদ্ধা মহিলাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিস। পুরুষরা সাধারণত ৩০ বছরের পর এবং মহিলারা মেনোপজ বা রজোনিবৃত্তির পরে বেশি আক্রান্ত হয়। বয়স বৃদ্ধি ও রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের ইউরিক এসিডের মাত্রা বেশি থাকে তবে বয়স ও ওজন বাড়লে রক্তে ইউরিক এসিডও বাড়বে।
কিছু এথনিক গ্রুপ যেমন মাউরি উপজাতি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের জনগোষ্ঠীদের রক্তে ইউরিক এসিড একটু বেশি থাকে। রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে তাকে হাইপারইউরিসেমিয়া বলে। রক্তে ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা হলো পুরুষের ক্ষেত্রে ২.০-৭.০ mg/dL ও নারীদের ক্ষেত্রে ২.০-৬.০ mg/dL।
ইতিহাসের পাতায় গেঁটেবাত
যদিও আমরা এখন বুঝতে পারি যে শরীরে ইউরিক অ্যাসিড গেঁটেবাত সৃষ্টি করে। আগেকার দিনের চিকিৎসকরা একটি সহজ কারণ দায়ী করেছেনঃ- অতিরিক্ত ভোজনবিলাসী খাবার। অনেক ডাক্তার এই রোগের থেকে মুক্তি পেতে বেড়ালের মাংস খাওয়ার পরামর্শ ও দিতেন।
১৫৭৮ সালে প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রে সবচেয়ে অদ্ভুত গেঁটেবাত নিরাময় আবিষ্কৃত হয়েছিল। লরেঞ্জ ফ্রাইস নামে একজন চিকিৎসক, একটি অস্বাভাবিক পন্থার প্রস্তাব করেছিলেন: কাটা বিড়ালছানা কে শুকরের চর্বি ও আটা দিয়ে ভেজে রোগী কে খেতে বলতেন এবং সেগুলো কে জয়েন্টগুলোতে লাগিয়ে মালিশ করতে বলতেন।
অনেক লোক আবার ইচ্ছে করে কামনা করতো গেঁটেবাত রোগে আক্রান্ত হওয়ার। তাদের ধারণা ছিল গেঁটেবাত হলে আর অন্য কোনো রোগ হবে না।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ লেখক হোরেস ওয়ালপোলের মতে গেঁটেবাত অন্যান্য অসুস্থতা প্রতিরোধ করে এবং জীবনকে দীর্ঘায়িত করে। তিনি তার এক লেখায় লিখেছিলেন জ্বর, পক্ষাঘাত বা অ্যাপোলেক্সি হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে গেঁটেবাত যদি হয় তা মন্দ কি।
যেহেতু সেসময় ধনীরা গেঁটেবাত ছাড়া অন্যান্য সাধারণ অসুখে খুব একটা আক্রান্ত হতেন না, তাই ইউরোপের সাধারণ মানুষদের মনে বিশ্বাস জন্মে যায় গেঁটেবাত হলে আর অন্য রোগ হবে না।
অনেক লোক আবার মনে করতো গেঁটেবাত হলে তাদের যৌন চাহিদা ও শক্তি দুটোই বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে ১৬ থেকে ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়টাতে।
১৫৮৮ সালে লেখক মিশেল ডি মন্টেইগনে তো তার এক লেখায় লিখেছেন, যখন একজন মানুষের পা দূর্বল হয় তার যৌন অঙ্গগুলির শক্তি বৃদ্ধি পায়।
মার্কিন লেখক, রাজনিতিবীদ ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এবং হেনরি সপ্তম গেঁটেবাত এর শিকার হয়েছিলেন
একজন পুরুষ উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য তার উদ্বেগের কারণে, রাজা হেনরি অষ্টম তার উভয় স্ত্রীকে তালাক দেন এবং ষোড়শ শতাব্দীতে ক্যাথলিক চার্চ ত্যাগ করেন।
কিন্তু হেনরির রাগ শুধু উত্তরাধিকার লাইন নিয়ে ছিল না; তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গেঁটেবাত আক্রান্তদের মধ্যে ছিলেন।
একটা সময় ছিল যখন ফ্লোরেন্সের মেডিসি রাজা গেঁটেবাতে এতটাই আক্রান্ত হয়েছিলেন যে তাকে “পিয়েরো দ্য গাউটি” বলা হত।
গেঁটেবাত শুধুমাত্র একটি রোগ ছিল না যা রাজা এবং অভিজাতদের পীড়িত করেছিল। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনেরও ছিল। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিং ১৭৮০ সালে তার স্ত্রী কে এক চিঠিতে লিখেছিলে, ‘আমি কি এমন পাপ করেছি, যে আমায় এমন ভয়ংকর দূর্দশায় পড়তে হয়েছে?’
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
চিকিৎসার প্রথম ধাপ হলো ব্যথা কমানো। এক্ষেত্রে NSAID যেমন ন্যাপ্রক্সেন, আইবুপ্রফেন,ইনডোমেথাসিন খুবই কার্যকর। আক্রান্ত জয়েন্টে বরফ লাগালে কিছুটা উপশম পাওয়া যায়। কোলচিসিন একটি কার্যকরী ঔষধ তবে এটি বমি ও ডায়রিয়া করতে পারে। কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ রোগের তীব্রতা কমাতে খুব ফলপ্রসূ। এক্ষেত্রে আক্রান্তের জয়েন্ট কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন দিলে খুব উপকার পাওয়া যায়।
ওজন কমাতে হবে তবে খাওয়া দাওয়া একদম ছেড়ে দিয়ে নয়। কম চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া উপকারী। অ্যালকোহল এড়িয়ে চলতে হবে। বেশি পিউরিন আছে এমন খাবার কম খাওয়া ভালো যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের ডাল বিশেষ করে মসুর ডাল ও মটর ডাল। শিম , শিমের বিচি, বরবটি, মটরশুঁটি , কড়াইশুঁটি, পুঁইশাক, পালংশাক, অ্যাসপ্যারাগাস, ফুলকপি, মাশরুম, কচু, ইস্ট, লাল মাংস যেমন গরু, খাসি, ভেড়া, হরিণ, সব ধরনের হাঁসের মাংস যেমন- রাজহাঁস, জংলি হাঁস ও পাতিহাঁস; গরু ও খরগোসের মাংস, বড় পাখির বা তুর্কি মোরগের মাংস, কবুতর ও তিতির পাখির মাংস। মগজ, কলিজা, বৃক্ক,যকৃৎ,অগ্নাশয়, জিহ্বা, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও মাছের ডিম, সামুদ্রিক খাবার, কাঁকড়া ল,চিংড়ি,শামুক ইত্যাদি। উল্লেখ্য খাবার থেকে যে পিউরিন শরীরে ঢুকে তা মাত্র ১ mg/dL ইউরিক এসিড বাড়াতে পারে এবং খাবারের ব্যাপারে সংযমী হয়ে মাত্র ১৫% ইউরিক এসিড লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই খাবারের ব্যাপারে অত্যধিক সংযমী হবার প্রয়োজন নাই। ফলমূল, অন্যান্য শাকসবজি প্রচুর খেতে হবে।ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন পেয়ারা, বাতাবী লেবু, কামরাঙা,কমলা,আমড়া,বাঁধাকপি,টমেটো,আনারস,কাঁচা মরিচ, আমলকী, তাজা শাকসবজি ইত্যাদি প্রচুর খেতে হবে। এছাড়া কম পিউরিন সমৃদ্ধ আরো খাবারের মধ্যে আছে দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য (দৈ,ঘি,মাখন), ডিম, চীনাবাদাম,লেটুস, পাস্তা, সাগু, ময়দা ইত্যাদি। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে যেন প্রতিদিন ২ লিটার বা তার বেশি প্রস্রাব হয় এতে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড শরীর থেকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করবে এবং ইউরিনারি ট্রাক্টে ইউরেট জমা হয়ে পাথর হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে। যে সকল ওষুধ ইউরিক এসিড লেভেল বাড়ায় যেমন থিয়াজাইড ডাইউরেটিকস্, অ্যাসপিরিন, নিয়াসিন ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
Reference: Medium, wikipedia, history annd medical desies