বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
নজরুলের এই কথাটি যতটা সত্য তার বাস্তবতা ততেতাই তিক্ত। কারণ নারী তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পান না!
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই যেনো পুরুষের দখলে নারীর আবিষ্কারের কোনো চর্চাই হয় না। অথচ নারীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কারে কম ভূমিকা পালন করেন নি।
আজ তেমনি নারীদের ৫ টি আবিস্কার এর কথা আপনার সামনে তুলে ধরছি যা পরবর্তীতে পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে দিয়েছে।
১. ডিএনএ ডাবল-হেলিক্স স্ট্রাকচার: রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন
ব্রিটিশ রসায়নবিদ এবং এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফার, রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন, ১৯৫১ সালে কিংস কলেজে তার গবেষণার অংশ হিসাবে ডিএনএ কাঠামোর এক্স-রে ছবি তোলা শুরু করেছিলেন।
রোজালিন্ড এর পুরুষ সহকর্মী জেমস ওয়াটসন বৈজ্ঞানিক বক্তৃতায় যোগদান করছিলেন যেখানে তিনি ডাবল হেলিক্সের উপর তার কাজ উপস্থাপন করেছিলেন এবং তিনি ফ্রাঙ্কলিন এর অনুমতি ছাড়াই তা ফটোগ্রাফিক আবিষ্কারটি ব্যবহার করেছিলেন ফ্রান্সিস এইচ.সি. ক্রিক এর সাথে। ডিএনএ তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য।
ওয়াটসন ও ক্রিক এর ‘ডিএনএ-ডাবল হেলিক্স’ তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছিল এবং ১৯৫৩ সালে তাদের থিউরি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
ডিএনএ ডাবল-হেলিক্স বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। যা বিজ্ঞানীদের মানব ডিএনএ সম্পর্কে আমাদের বোঝার জন্য এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
ওয়াটসন এবং ক্রিক ১৯৬২ সালে এর জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। আর ফ্রাঙ্কলিন মারা যায় ১৯৫৮ সালে,যার অর্থ তিনি তার জীবদ্দশায় তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব পাননি।
২. কম্পিউটার প্রোগ্রামিং: অ্যাডা লাভলেস
ইংরেজি রোমান্টিক যুগের বিখ্যাত সাহিত্যিক লর্ড বায়রন ও তার স্ত্রী লেডি বায়রনের একমাত্র কন্যা, অ্যাডা লাভলেস। লাভলেসকে মূলত তার মা শাস্ত্রের দিকে চালিত করেছিলেন, তিনি ভয়ে ছিলেন মেয়েও হয়তো বাবার মতে সাহিত্যের মতো পাগলাটে ও বিপজ্জনক পদ অনুসরণ করবে। লাভলেস এর যখন মাত্র ২০ বছর বয়স তখন তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক চার্লস ব্যাবেজের সাথে তার ‘অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’ এ সহযোগিতা শুরু করেন যা ছিল একটি কম্পিউটারের প্রাথমিক মডেল।
তার কাজটি মেশিনে বিস্তৃত নোট যুক্ত করেছে যা এটিকে কেবল সংখ্যা নয় শব্দ এবং চিহ্ন দিয়েও কাজ করতে সক্ষম করেছে। তার এই নোটগুলিকে বর্তমানে আমরা এখন অ্যালগরিদম এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বলি।
যদিও ইতিহাসবিদরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে তিনি ব্যাবেজের নিজের স্মৃতিকথার “নোট” তে খুব বেশি অবদান রাখেননি বলে তিনি বীজগণিত সমাধানের জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন।
লাভলেস তার প্রাপ্য স্বীকৃতি কয়েক দশক পরে পেয়েছিলেন। আর তার সম্মানে ২০১১ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ওপেন-সোর্স প্রযুক্তিতে মহিলাদের প্রচারে সহায়তা করার জন্য ‘অ্যাডা ইনিশিয়েটিভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
৩. মনোপলি: এলিজাবেথ ম্যাগি ফিলিপস
‘দ্য ল্যান্ডলর্ডস গেম’ নামক আসল বোর্ড গেমটি পুরুষদের একচেটিয়াতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে বিদ্রূপাত্মকভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল!
ম্যাগি, যিনি ছিলেন অর্থনীতিবিদ। রাজা হেনরি জর্জের একজন অ্যাকোলাইট, সেই সময়ের একচেটিয়াদের প্রতিবাদ করার সময় হেনরির জমি দখল অর্থনীতির পদ্ধতির সুবিধাগুলি প্রদর্শন করার জন্য তার গেমটি ডিজাইন করেছিলেন।
ফিলিপস ১৯০৩ সালে একটি পেটেন্টের জন্য দাখিল করেছিলেন, কিন্তু গেমটি যখন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছিল এবং বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল, তখন চার্লস ডুরো, এই গেমে কিছু নতুন সংযোজন করে সংস্করণ করে নিজের নামে কপিরাইট করেন।
তারপরে তিনি তার গেমটি পার্কার ব্রাদার্সের কাছে বিক্রি করে এর জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নিয়েছিলেন এবং আর আসল গেম ডিজাইনার ফিলিপস মূলত ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন।
৪. নিউক্লিয়ার ফিশন: লিজ মেইটনার
অস্ট্রিয়ান-সুইডিশ পদার্থবিদ, লিস মেইটনার, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ছাত্রী ছিলেন এবং জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত প্রথম জার্মান মহিলা ছিলেন। কিন্তু নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় কারন তিনি ইহুদি ছিলেন।
জার্মানি ছেড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় আসার পর তিনি নতুন উদ্যোমে কাজ চালিয়ে যান। তিনি অটো হ্যানের সাথে অংশীদারিত্ব করেছিলেন, যার সাথে তিনি ১৯৩৮ সালে পারমাণবিক বিভাজনের ধারণার রূপরেখার জন্য বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে, তাদের গবেষণা পারমাণবিকের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার জন্ম দেয়।
হ্যানই একমাত্র যিনি রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস থেকে রসায়নে ১৯৪৪ সালে পুরস্কার পেয়েছিলেন। অবশেষে, ১৯৯৪ সালে লিজ মেইটনার সম্মানিত হন, তাকে সম্মানিত করার জন্য পর্যায় সারনির একটি মৌলের বাম তার নামানুসারে করা হয়। মৌলটির নাম মেইটনেরিয়াম।
৫. রেডিও গাইডেন্স সিস্টেম: হেডি লামার
হেডি লামার কে বলা হয় বিউটি উইথ ব্রেন। সাধারণত সুন্দরী নারীরা একটু বোকা ধরনের হয়, হেডি তার একদম উল্টো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪২ সালে হেডি লামার এবং অ্যান্থিয়েল এই নতুন বার্তা পদ্ধতির জন্য প্যাটেন্ট পেলেন। কিন্তু মার্কিন নৌবাহিনী প্রযুক্তিটি ব্যবহার করতে রাজি হল না। হয়তো এক সুন্দরী চিত্রতারকা ও এক সঙ্গীতজ্ঞের তৈরি পদ্ধতিতে তাদের খুব একটা আস্থা হয়নি। ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল সংকটের সময় পদ্ধতিটি সাফল্যের সঙ্গে প্রথম ব্যবহার করা হয়।
একমাত্র জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে হেডি লামার তার যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য সম্মান পান। ১৯৯৭ সালে ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন আধুনিক বার্তা আদান-প্রদান ব্যবস্থায় লামারের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘পাওনিয়ার’ ও ‘বাল্বি ন্যাস স্পিরিট অফ অ্যাচিভমেন্ট’ ব্রোঞ্জ পুরস্কার দেয়। ২০০০ সালে মৃত্যুর পর তাকে ‘ন্যাশনাল ইনভেন্টার্স হল অফ ফেম’-এ সদস্যপদ দেয়া হয়।
নায়িকা হেডি লামারকে একসময় হলিউড ‘পৃথিবীর সেরা সুন্দরী’ আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু তিনি ঠিক হলিউডি নায়িকার ছকে বাঁধা ছিলেন না- মদ খেতেন না, পার্টিতে যেতেন না। এখন বিজ্ঞানের জগতে হেডি লামারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে স্বীকৃত হয় ‘স্প্রেড স্পেকট্রাম রেডিও’ যা আজকের জিপিএস, ব্লুটুথ, ওয়াই-ফাই, সিডিএমএ প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ করেছে।