বই, নিউজপেপার কিংবা টিভি চ্যানেল ও নিউজ সাইটগুলোতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অপরাধী ধরার অসাধারণ কৌশল ও ব্যর্থতার কথা আপনি জানতে পারবেন। তবে জেল থেকে পালানো আসামির কথা আপনি কি কখনো শুনেছেন? কিভাবে জেলখানার এতো কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও ফাঁকি দিয়ে জেল থেকে পালিয়েছেন? আজ আপনাদের সেই গল্প শোনাবো।
জন ডিলিঞ্জার ও তার কাঠের পিস্তল
জন ডিলিঞ্জার আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এক সন্ত্রাসীদের একজন। তিনি ছিলেন ডিলিঞ্জার গ্যাঙের সদস্য যেটি ২৪টি ব্যাংক ডাকাতি, ৪টি পুলিশ স্টেশনে হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধ ও অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল। ১৯৩৪ সালে জন ডিলিঞ্জার আরিজোনা রাজ্যের টুস্কনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইন্ডিয়ানার লেক কাউন্টি জেলে।
ধরা পড়ার কিছুদিন পরেই এমন এক কান্ড করে বসেন যে জেলের পুরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হতবাক হয়ে যায়। ডিলিঞ্জার জেলখানায় বসেই ছোট একটি কাঠের টুকরো দিয়ে একটি খেলনা পিস্তল বানান। তারপর সেটিকে আসলের মতো দেখাতে জুতার কালি ব্যবহার করেন। আর সেই খেলনা পিস্তল দিয়ে জেলের প্রহরীকে ভয় দেখিয়ে সেলের তালা খুলতে বাধ্য করেন। তারপর জেল থেকে পালিয়ে যান। পালানোর সাথে তিনি সঙ্গে করে জেলারের সদ্য কেনা V-8 ফোর্ড গাড়িটিও সাথে নিয়ে যান।
তবে পালিয়ে জন ডিলিঞ্জার খুব বেশিদিন বাঁচতে পারেননি। এর কয়েকমাস পর পুলিশেরর করা ৪ টি গুলিতে জন ডিলিঞ্জার নিহত হয়। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩১ বছর।
আলফ্রেড ওয়েটজ্লার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের সময় অল্প যে ক’জন ইহুদী অসউইৎজ ডেথ ক্যাম্পের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পেরেছিলো, আলফ্রেড ওয়েটজ্লার তাদের মধ্যে একজন। তিনি এবং তার সাথে পালানো সঙ্গী রুডলফ ভ্রবা অবশ্য বিখ্যাত হয়ে আছে এ ক্যাম্পের সর্বপ্রথম বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার জন্য। ৩২ পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে উল্লেখ ছিল অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্রাউন্ড প্ল্যান, গ্যাস চেম্বারের কন্সট্রাকশন প্ল্যান, মানবদেহ পোড়ানোর চুল্লির বর্ণনা এবং গ্যাস চেম্বারে ব্যবহৃত জিক্লন বি গ্যাসের একটি ক্যানিস্টারের মোড়ক। তাদের দেওয়া এই রিপোর্টের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী নাৎসি বাহিনীর উপর হামলা চালায়, আর তাতে রক্ষা পায় প্রায় ১,২০,০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদী।
১৯৪৪ সালের ৭ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর দুটোর দিকে ওয়েটজ্লার এবং ভ্রবা পালিয়ে এক কাঠের স্তুপের আড়ালে আশ্রয় নেন। এ এলাকাটি বির্কেনয়ের কাঁটাতার দেয়া এলাকার বাইরে হলেও তা আরেকটি বড় এলাকার অংশ ছিলো যা সার্বক্ষণিক প্রহরার মাঝে রাখা হতো। ফলে পুরোপুরি মুক্তি তাদের তখনো মিলে নি। ক্যাম্পের অন্যান্য বন্দীরা তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটির চারদিকে কাঠের বোর্ড জমা করে রেখেছিলেন যাতে তারা ধরা না পড়েন। কুকুরেরা যাতে গন্ধ শুঁকেও তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে না পেতে পারে, সেজন্য সেই জায়গাটিতে তারা তামাক পাতা গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতেই সেখানে ৪টি রাত কাটিয়ে দেন পলাতক দুই বন্দী।
১০ এপ্রিল ডাচ স্যুট, ওভারকোট ও বুট গায়ে জড়িয়ে দুজন ১৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোল্যান্ডের সীমান্তের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেন। দীর্ঘ পথের দিক নির্দেশক বলতে তাদের কাছে কেবলমাত্র ছিলো বাচ্চাদের মানচিত্রের বইয়ের একটি পৃষ্ঠা।
গ্লাইডারে চড়ে পালানো
জার্মানির স্যাক্সনি অঙ্গরাজ্যের জিকাও মুল্ড নদীর তীরে অবস্থিত শহরের নাম কোল্ডিৎজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই শহরেরই কোল্ডিৎজ দুর্গে স্থাপন করা হয়েছিল। এই দুর্গে সাধারণত বন্দী হিসেবে রাখা হতো শত্রুপক্ষের অফিসারদের। অফিসারদের জন্য তৈরি এই ক্যাম্পটি ছিলো উঁচু এক পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে। আর এই দূর্গম দুর্গ থেকেই গ্লাইডারে চড়ে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন দুই ইংরেজ পাইলট জ্যাক বেস্ট ও বিল গোল্ডফিঞ্চ।
গ্লাইডারের বিভিন্ন অংশগুলো তারা জোড়া লাগিয়েছিলেন ক্যাম্পেরই চ্যাপেলের চিলেকুঠুরিতে। তারা পরিকল্পনা করেছিলেন যে, ছাদে উঠে সেখান থেকেই গ্লাইডারে চড়ে প্রায় ২০০ ফুট নিচে থাকা মুল্ড নদী পাড়ি দিবেন। নিজেদের ওয়ার্কশপ লুকিয়ে রাখতে তারা এর চারদিকে প্রথমে দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেন যাতে জার্মান সৈন্যরা তাদের কাজকর্মের কিছু টের না পায়।
নিজেদের খাটের কাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে চুরি করে আনা কাঠ দিয়েই চলছিলো গ্লাইডার বানানোর কাজ। গ্লাইডারের ডানা বানানো হয়েছিলো মেঝে তৈরিতে ব্যবহৃত বোর্ডগুলোর সাহায্যে। আর এটি চালাতে প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক তার জোগাড় করা হয়েছিলো দুর্গেরই অব্যবহৃত অংশ থেকে তার চুরি করে। লর্নে ওয়েল্চ নামক এক গ্লাইডার বিশেষজ্ঞকে দিয়ে নিজেদের গ্লাইডারের ডিজাইন ও বিভিন্ন গাণিতিক হিসেবনিকেশ পরীক্ষাও করিয়ে নিয়েছিলেন তারা। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাদের নির্মানাধীন সেই গ্লাইডারের নাম ছিলো ‘কোল্ডিৎজ কক’।
তবে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই হোক না কেন, বেস্ট এবং গোল্ডফিঞ্চ তাদের গ্লাইডারে চড়ে কোল্ডিৎজ দুর্গ থেকে পালাতে পারেননি। কারণ তাদের কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে, তখনই মিত্রবাহিনী দুর্গের দখল নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলে প্রায় ২০০ ফুট উঁচু দিয়ে উড়ে উড়ে জেল থেকে পালানোর যে অবিশ্বাস্য পরিকল্পনা তারা করেছিলেন, তা কেবল স্বপ্নই থেকে গিয়েছিলো।
আলকাত্রাজ থেকে পালানো
যুক্তরাষ্ট্রের আলকাত্রাজ দ্বীপে অবস্থিত আলকাত্রাজ জেলখানাটি ছিলো সেসময়ে অত্যন্ত সুরক্ষিত, সার্বক্ষণিক নজরদারিতে ঘেরা এক জেলখানা। এখান থেকে কেউ যে পালাতে পারে সেই কথা চিন্তাও করা যেতো না। আর সেই অচিন্ত্যনীয় জিনিসটিই বাস্তবে দেখিয়ে পুরো দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো তিন অপরাধী- ফ্রাঙ্ক মরিস, জন অ্যাংলিন ও ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন।
সময়টা ১৯৬২ সালের ১১ জুন। ফ্রাঙ্ক মরিস, জন আংলিন ও ক্ল্যারেন্স অ্যাংলিন এই তিন অপরাধী ছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। কিন্তু তারা খুঁজছিলেন মুক্তির পথ, আর তাই কাজে লাগালেন তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে। এজন্য তারা সাবান আর টয়লেট টিস্যু দিয়ে প্রথমে তৈরী করলেন মানুষের মাথা। এরপর মাথায় আসল চুল লাগিয়ে সেই কৃত্রিম মাথাগুলোকে কাঁথা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিলেন যাতে রাতের বেলায় প্রহরীরা যখন পাহারা দেওয়ার জন্য আসবে, তখন যেন বুঝতে না পারে।
জেল থেকে পালানোর প্রায় এক বছর আগে থেকে তারা তাদের সেলের দেয়ালে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে গর্ত খুঁড়ছিল। সেই গর্তটি গিয়ে শেষ হয়েছিলো এক অব্যবহৃত সার্ভিস করিডোরে। সেই সার্ভিস করিডোর থেকে তারা ভেন্টিলেশন শ্যাফট বেয়ে উঠে যান একবারে ছাদে। এরপর ছাদ থেকে নেমে আবার আরেকটি বেড়া ডিঙোতে হয় তাদের। সেখান থেকে তারা সোজা চলে যান সমুদ্রের পাড়ে।
এরপর জেলের গুদাম থেকে চুরি করে আনা রেইনকোট ও সিমেন্ট দিয়ে তারা তৈরি করেন র্যাফ্ট। এরপর রাত দশটার দিকে তারা আলকাত্রাজ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এফবিআই আর কখনোই সেই তিনজনের কোনো সন্ধান পায় নি। ১৭ বছরের অনুসন্ধান শেষে তারা বলে যে, এ তিনজন অবশ্যই সাগরের পানিতে ডুবে মরেছে!
তথ্যসূত্র: বিবিসি,হিস্ট্রিডটকম,বিজনেস ইন সাইড