রাজতন্ত্রের ইতিহাস পড়ার বিষয় হিসেবে খুবই চমৎকার বিষয়। হাজার হাজার বছর ধরেই বিভিন্ন সম্রাজ্যে রাজা/ সম্রাটদের উত্থান যেমন হয়েছে পতনও হয়েছে। বেশিরভাগেরই পতন হয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণহীন দিনযাপন ও চরিত্রগত কারণে। ইতিহাসের পাতা খুললে যেমন ভালো শাসকের নাম খুঁজে পাওয়া যায় তেমনি নিষ্ঠুর, চরিত্রহীন লম্পট রাজার সংখ্যা ও কম নয়! আজ তেমনি ৩ জন উম্মাদ ও লম্পট রাজাদের সম্পর্কে জানাচ্ছি।
১. সম্রাট ক্যালিগুলা
সম্রাট ক্যালিগুলা ৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার চাচার মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্যের নতুন সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে বসেন(তবে এই মৃত্যু নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে সংশয় আছে, অনেকেরই ধারণা ক্যালিগুলাই তার চাচা কে খুন করেছে সিংহাসনে বসার জন্য)
ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মাথায় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ঠিক যেমন তার চাচা টাইবেরিয়াস মরার আগে অসুস্থ হয়েছিলেন। সবাই ভাবলো এযাত্রায় বুঝি আর রক্ষা নেই। তারা সম্রাটের উত্তরসূরি গেমেলাসকে মানসিকভাবে সম্রাট হওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে লাগলেন। কিন্তু এক মাসের পর ক্যালিগুলা সুস্থ হয়ে উঠলেন। যেন ‘পুনর্জন্ম’ হলো সম্রাটের। অবশ্য এই পুনর্জন্ম শুভ হলো না তার জন্য। তিনি যেন এক ভিন্ন ক্যালিগুলায় রূপান্তরিত হলেন।
সুস্থ হওয়ার পর তিনি নারী সঙ্গে উন্মত্ত হয়ে উঠেন। তিনি তার শয্যাসঙ্গের জন্য হাজার হাজার নারী দাসী প্রাসাদে আনেন। এতেও তার স্বাদ মেটেনি তার এবার চোখ পড়ে শহরের সিনেটরদের স্ত্রী ও মেয়েদের প্রতি। জোড় করে সম্রাট শহরের সিনেটদের স্ত্রী ও মেয়েদের নিজের যৌনদাসী বানান।
সম্রাট কেবল এখানেই থেমে থাকে নি। নিজের সিংহাসনকে সুরক্ষা করতে নিজের প্রতিপক্ষ সকলকে মৃত্যুদন্ড দেন, তার মধ্যে তার উত্তরসূরী গোমেলাস ও ছিল।
ক্যালিগুলা উচ্চ বিলাসী জীবন যাপন করতেন। তার জন্য প্রয়োজন পড়তো প্রচুর পরিমানে অর্থের। তার জন্য তার রক্ষীরা লোকেদের থেকে জোর করে অর্থ লুট করতো। তার সাথে আরোপ করতো কয়েকগুণ বেশি কর।
ক্যালিগুলার এমন নির্মম শাসন রোমবাসীদের বেশিদিন সহ্য করতে হয়নি। শাসনের মাত্র ৪ বছরের মাথায় তার পতন হয়। ৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি একটি খেলার অনুষ্ঠানে একজন দেহরক্ষী প্রথম ক্যালিগুলাকে ছুরিকাঘাত করে বসে। এরপর মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন প্রিটোরিয়ান রক্ষী ক্যালিগুলাকে ঘিরে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ইতিহাসবিদদের মতে, মোট ৩০ বার তাকে ছুরিকাঘাত করার মাধ্যমে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর রোমবাসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। শোনা যায় পুরো শহরের মানুষ সেদিন পানীয় পান করে তার মৃত্যু উৎসব করেছিল।
২. রাজা এরিক চতুর্দশ
রাজা এরিক চতুর্দশ ১৫৬০ সালে সুইডেনের রাজা হন। তিনি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজা ছিলেন। রাজা এরিক উত্তর-পূর্ব ইউরোপের বাল্টিক অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, তাই তিনি ডেনমার্ক এবং এস্তোনিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে যুদ্ধে জরিয়ে পড়েন।
আর তাই যুদ্ধের জন্য অর্থের যোগান দিতে প্রজাদের উপর কর বাড়ানোর পাশাপাশি, এরিক সুইডিশ আভিজাত্যের ক্ষমতা সীমিত করার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি তাদের নিজের বশ্যতায় রাখার জন্য তিনি শত শত মানুষের মৃত্যুদণ্ড জারি করেছিলেন।
এরিকের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে তার রাজত্বের প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সময়ের সাথে সাথে তিনি ক্রমশ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি সবসময় ধারণা পোষণ করতেন রাজ্যের অভিজাতরা তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে।
১৫৬৭ সালে তার মানসিক অবস্থা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত রক্ষীদের সহায়তায় স্টুর পরিবারের দুর্গে প্রবেশ করেন। স্টু পরিবার ছিল অভিজাত পরিবারের মধ্যে একটি। দুর্গে প্রবেশের পর এরিক, নিলস সভান্তেসন স্টুর সহ স্টুর পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে হত্যা করেন, যাদেরকে রাজা সরাসরি নিজেই ছুরিকাঘাত করেছিলেন।
এই ঘটনার ঠিক এক বছর পর, এরিকের সৎ ভাইয়ের নেতৃত্বে একটি সফল বিদ্রোহ হলে এরিক সিংহাসন থেকে উৎখাত হন। এরিকের সৎ ভাই সুইডেনের নতুন রাজা হন। এরিক তার বাকি জীবন কারাগারে কাটিয়েছেন এবং ১৫৭৭ সালে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন।
৩.অটোমান সুলতান ইব্রাহিম
সুলতান ইব্রাহিম তার রাজত্বের সময় তার প্রজাদের কাছে পাগল ইব্রাহিম নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৬৪০ সালে ইব্রাহিমের বড় ভাই সিরোসিসের মৃত্যুর পর ইব্রাহীম অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক হন।
ভাইয়ের শাসনামলের সময় ইব্রাহিমের বাহিরের পৃথিবীর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। তিনি উসমানীয় প্রাসাদের একটি এলাকা কাফেসের অভ্যন্তরে চার বছর কাটিয়েছেন। সেখানে সিংহাসনে উত্তরাধিকারীদের সিরোসিস দীর্ঘ ৪ বছর তালাবদ্ধ করে রেখেছিল।
মনে করা হয় বাহিরের পৃথিবীর সাথে দীর্ঘ দিনের বিচ্ছিন্নতা ইব্রাহিমের মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করেছিল।
সিংহাসনে বসার উপর ইব্রাহিম উদ্ভট সব বিলাসিতায় মেতে উঠেছিলেন। তিনি তার দাড়িকে হীরা দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন। রাজপ্রাসাদের সকল পর্দাকে তিনি এক বিরল পারফিউম দিয়ে সুগন্ধি করে রাখতেন। ইব্রাহিম বেড়াল পুষতে পছন্দ করতেন, সেই বেড়ালগুলোকে রাখতে তিনি দামী পশমের কাপড় ব্যবহার করতেন।
তবে এসব কিছুই তার সিংহাসন ও সাম্রাজ্যের জন্য খুব একটা হুমকির কারণ ছিলো না। ইব্রাহিমের নারী লালসা ছিলো তার সবচেয়ে বড় পাপ। সে অগণিত মহিলাকে তার শয্যাসঙ্গী করেছিল। বিশেষত কুমারী নারীদের প্রতি তার একধরনের ঝোঁক তৈরি হয়েছিল।
ইব্রাহিম তার সেইসব পত্নী বা যৌনদাসী যাই বলি না কেনো; কারো সাথেই সে সম্মানের সাথে আচরণ করেননি। এমনকি তিনি তার ২৮০ জন যৌনদাসীকে বস্তায় বেঁধে পানির নিচে ফেলে হত্যা করেছিলেন।
এছাড়া ইব্রাহিম তার অনেকগুলো গ্র্যান্ড ভিজিয়ারকে (সেনাবাহিনী প্রধান এমন নেতৃবৃন্দ) মৃত্যুদন্ড দেয়, নিজের ক্ষমতা সুরক্ষার জন্য। তার মনে হয়েছিল তারা যে কোনো সময় বিদ্রোহ করতে পারে। যেহেতু ইব্রাহিম উচ্চাভিলাস জীবন যাপন করতেন। তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হতো, আর তাই তিনি তার প্রজাদের উপর উচ্চ কর আরোপ করেন।
ইতিহাসের পাতায় কোনো অত্যাচারী রাজাই বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেন নি। ইব্রাহিমের ক্ষেত্রেও তা ব্যাতিক্রম হয়নি। ইব্রাহিমকে অবশেষে ১৬৪৮ সালে (শাসনের ৮ বছরের মাথায়) বন্দী করা হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।