সত্যজিৎ রায় (২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২) ছিলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক এবং লেখক। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। সত্যজিতের জন্ম কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্প সমাজে খ্যাতনামা রায় পরিবারে। তার পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয়: Ladri di biciclette, বাইসাইকেল চোর) দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তার কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী (১৯৫৫) ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, এর মধ্যে অন্যতম ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানুষে-আবর্তিত প্রামাণ্যচিত্র” (Best Human Documentary) পুরস্কার। পথের পাঁচালী, অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) – এই তিনটি একত্রে অপু ত্রয়ী নামে পরিচিত, এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী সত্যজিতের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বহুল স্বীকৃত। চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে বিখ্যাত হল ১৯৯২ সালে পাওয়া একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার (অস্কার), যা তিনি সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন। তিনি এছাড়াও ৩২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১টি গোল্ডেন লায়ন, ২টি রৌপ্য ভল্লুক লাভ করেন।
তিনি বেশ কয়েকটি ছোট গল্প এবং উপন্যাস রচনা করেছেন, প্রাথমিকভাবে শিশু-কিশোরদের পাঠক হিসেবে বিবেচনা করে। কল্পবিজ্ঞানে তার নির্মিত জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র গোয়েন্দা ফেলুদা এবং প্রোফেসর শঙ্কু। সত্যজিৎ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারত রত্ন সম্মাননা প্রদান করে। সত্যজিৎ ভারত রত্ন এবং পদ্মভূষণসহ সকল মর্যাদাপূর্ণ ভারতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন।
২০০৪ সালে, বিবিসির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় সত্যজিৎ ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন। হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণে ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ মৃত্যুবরণ করেন।
১#
চলচ্চিত্রের অন্যতম দক্ষতা হলো মানুষের মন বোঝার এবং তার সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা এর রয়েছে।
২#
বলিউডের চলচ্চিত্র এখন যেমন, আগে তেমনটা ছিলো না। আগে এটা স্থানীয় একটা ইন্ডাস্ট্রি ছিলো যেখানে বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা পাল্টে গিয়েছে।
৩#
সবচেয়ে মূল্যবান ও একমাত্র সমাধানগুলো লোকেরা নিজেরাই খুঁজে বের করতে পারে।
৪#
যখন আমি কোন লোকেশনে শ্যুটিং করি, নিজে নিজেই ওই লোকেশন থেকে কিছু না কিছু উদ্ভাবন করার চেষ্টা করি। হয়তো আপনি মূল জিনিসটা পরিবর্তন করতে পারবেন না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন পরিবর্তন (যা চলচ্চিত্রটিকে আরো ভালো করতে পারে) চাইলে করতেই পারেন। আমি সাধারণত এটা করে থাকি। আর যা-ই হোক, একটু হিসেবী তো হতেই হবে।
৫#
বিশেষত, (একটা চলচ্চিত্র নির্মানের) শেষ সময়ে এসে আমি প্রায়ই খেয়াল করি আমি বেশ তাড়াহুড়ো করছি। এটা খুবই বিপদজনক যখন দেখবেন আপনি সম্পানদার টেবিলে বসে তাড়াহুড়ো করছেন। আমার শুরুর দিককার সময়ের অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই বড় রকমের ভুল রয়ে গিয়েছিলো এই তাড়াহুড়োর কারনে।
৬#
আমার চিত্রগ্রাহক এবং আমি একটা মেথড নিয়ে চিন্তা করছিলাম এবং আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র থেকে এটা সবসময়ই করতাম। মেথডটা হলো, ইনডোরের শ্যুটিং দিনের আলোয় করা এবং লাইটটাকে সরাসরি না ফেলে বাউন্স করে ফেলা। আমরা দুইজনে এক ব্যাপারে ঐক্যমত্যে এসেছিলাম যে ক্যারেক্টারেরর ছায়া খুবই বিরক্তিকর একটা জিনিস।
৭#
আমি এখনো পর্যন্ত ১৭ কি আঠারোটার মতো চলচিচত্র বানিয়েছি যার মধ্যে মাত্র দু’টো মৌলিক চিত্রনাট্য, আর বাকি সবই ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে লেখা। আমার মনে হয়, ছায়া অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখার জন্যে বড় দৈর্ঘে্যর ছোটগল্পই উপযুক্ত।
৮#
আবহসঙ্গীতের ধারণা দিনে দিনে বেশ পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন (পরিচালকেরা) যতটা পারা যায় কমই ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।”
৯#
আসলে, (চলচ্চিত্রে) সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো শুভ একটা সমাপ্তি। যা-ই হোক, আপনি শুভ একটা সমাপ্তির আগে ট্র্যাজিক কোন অবস্থা এবং কিছু কান্নার সিকোয়েন্সও রাখতে পারেন, এটা ভালো কাজ দিতে পারে।”
১০#
সিনেমায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসূচক গুণগুলোই মানুষের মনের অন্তরঙ্গ বিষয় ধরতে ও যোগাযোগ ঘটাতে সক্ষম।
১১#
পরিচালকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভালোভাবে জানেন যে চলচ্চিত্রটি কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে।
১২#
যখন আপনার কাহিনীতে নতুন কোনো চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে, তখন অবশ্যই তার চেহারা ও কাপড়ের বর্ণনা বিস্তারিতভাবে দেবেন। যদি সেটা না দেন তাহলে পাঠক নিজের মতো করে ভেবে নেবে, যেটা আপনি পরে যে বর্ণনা দেবেন সেটার সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। তাই…
১৩#
আমি অনুভব করি যে নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁদের আধা অন্ধকার, অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।
১৪#
সবার শেষ কথা— বলতে গেলে সবচেয়ে জরুরি কথা হলো— আপনার প্রয়োজন একটি শুভ সমাপ্তি। যাহোক, এই শুভ সমাপ্তির আগে যদি বিষাদময় পরিস্থিতি এবং চমক সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে বিষয়টা আরো ভালো কাজ করে।
১৫#
চলচ্চিত্রের দৃশ্যরচনার অভ্যাসকে আমি শখে পরিণত করেছি। আমি খুঁজে বের করতাম কোন গল্পটি চলচ্চিত্রের জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এরপর আমি নিজস্ব ঢঙে গল্পটি লিখতাম, এরপর আসল গল্পের সঙ্গে করতাম তুলনা।
১৬#
যখন আমি মৌলিক কোনো গল্প লিখি তখন আমি এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে লিখি যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং এমন পরিস্থিতির কথা লিখি যার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমি ১৯ শতকের কোনো গল্প লিখি না।
১৭#
আমি অনুভব করি যে, নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁদের আংশিক অন্ধকার, অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।
১৮#
ডোমিনাস ওমনিয়াম ম্যাজিস্টার, এর অর্থ হল ঈশ্বর সবকিছুর অধিপতি।
১৯#
নিজের মতো করে কাজ করার সুযোগ সবসময়ই পাওয়া যায়।
২০#
যখন আমি মৌলিক কোনো গল্প লিখি তখন আমি এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে লিখি যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং এমন পরিস্থিতির কথা লিখি যার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমি ১৯ শতকের কোনো গল্প লিখি না।